মার্কিন নির্বাচনে ইসলামোফোবিয়া

যুক্তরাষ্ট্রে ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামার জয়ের পর অনেকেই ভেবেছিলেন, জর্জ বুশ প্রশাসনের যেসব নীতির কারণে শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের ফলে মুসলিমদের সন্দেহভাজন অপরাধী হিসেবে দেখা হচ্ছিল, তার পরিবর্তন ঘটবে। 

অথচ ওবামা দুই বার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরও, যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়ার উত্থানের বিপরীতে তাকে কোনো জোরালো পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি। শান্তির জন্য নোবেল জেতার পরেও ওবামা প্রশাসনের অধীনে মূলত যুদ্ধ, নজরদারি ও অভিবাসন নীতির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রে ইসলামোফোবিয়ার ভয়াবহ উত্থান ঘটে। 

মার্কিন সমাজে আজ যে মুসলিমবিদ্বেষী ও বর্ণবাদী প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তা বুশ ও ওবামা প্রশাসনেরই সৃষ্টি। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এসব বিদ্বেষে হাওয়া দিয়েই ক্ষমতাসীন হয়েছেন।

ওবামা প্রশাসন বিতর্কিত ‘ইউএস প্যাট্রিয়ট অ্যাক্ট’ নবায়ন ও এর পরিসর বৃদ্ধি করেছে। মার্কিন বিমান হামলায় নিহত নিরস্ত্র মুসলিমদের ওবামা ‘শত্রু যোদ্ধা’ বলে চিত্রিত করেছেন। সেইসাথে উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণে তার সহিংস প্রতিরোধ মার্কিন মুসলিমদের জীবনে পুলিশি নজরদারিকে সাধারণ ঘটনায় পরিণত করে। ওবামা আমলেই তালিকা করে বিশ্বব্যাপী হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। ‘সন্দেহভাজন সন্ত্রাসী’ উল্লেখ করে মার্কিন নাগরিকদের বিনা বিচারে বছরের পর বছর আটকে রাখা হয়। বুশ প্রশাসনের সময়ে যে ইসলামোফোবিয়ার ধারণা বৃদ্ধি পাচ্ছিল, ওবামা তা শুধু গ্রহণই করেননি, বরং এর উত্থানে কার্যকর ভূমিকা রেখেছেন।

১২ বছর পর মার্কিন নাগরিকরা আবারো ভোট দিতে চলেছেন, যেখানে তাদের সামনে রয়েছে প্রকাশ্যে ইসলামোফোবিয়ার পক্ষে প্রচারণা চালানো এক রিপাবলিকান প্রশাসন। ভোটারদের সামনে প্রশ্ন হলো- ডেমোক্র্যাট জো বাইডেন ও কমলা হ্যারিস বিজয়ী হলে কি এই ভয়ংকর ইসলামোফোবিয়ার কোনো পরিবর্তন হবে?

ইসলামোফোবিয়ার সংজ্ঞায়ন

১৯৯৭ সালে ব্রিটিশ গবেষণা সংস্থা রানিমেড ট্রাস্ট ‘ইসলামোফোবিয়া: অ্য চ্যালেঞ্জ ফর আস অল’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ইসলামোফোবিয়া শব্দের প্রচলন সম্পর্কে বলা হয়- “ইসলামোফোবিয়া শব্দটির প্রচলন হয়েছে, কারণ একটি নতুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে- যার একটি নাম দরকার। মুসলিম-বিদ্বেষ ও মুসলিমদের প্রতি উগ্র দৃষ্টিভঙ্গির বিস্তার ঘটেছে উল্লেখযোগ্যভাবে ও সাম্প্রতিক সময়ে এর বিস্তার এতটাই দ্রুত হারে হচ্ছে যে, এর একটি নাম দরকার- যেন এই ধরনের ঘটনাকে চিহ্নিত করা যায় ও তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। প্রায় একইভাবে ইউরোপের ইতিহাসে একটি সময় ছিল, যখন নতুন একটি শব্দের দরকার হয়ে পড়েছিল তৎকালীন ইহুদি-বিদ্বেষের (অ্যান্টি সেমিটিজম) ভয়াবহতাকে প্রকাশ করার জন্য। ‘ইসলামোফোবিয়া’ শব্দটির প্রচলন সমাজ থেকে এই সমস্যাগুলো দূর করতে পারবে না; কিন্তু আমরা আশা করি, এটা হয়তো দীর্ঘমেয়াদে মানুষের ধারণার বদল ঘটাতে ও মানুষে মানুষে সম্পর্কের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।” 

ওই প্রতিবেদন অনুসারে- ব্যক্তির আচরণ, সামাজিক অনুশীলন, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে যদি মুসলিম জনগোষ্ঠীকে বৈষম্য করা হয়, তাদের প্রকাশ্যে বা গোপনে সামাজিকভাবে এড়িয়ে চলা বা বয়কট করা হয়, তাদের প্রতি ধর্মান্ধ আচরণ করা হয়, কিংবা শারীরিক বা মৌখিক বা অনলাইনে আক্রমণ করা হয়, ওই আক্রমণগুলোকে ‘ইসলামোফোবিয়া’ বলা হবে।

যুদ্ধ: ইসলামোফোবিয়ার ভিত্তি

সমাজে ক্রমবর্ধমান মুসলিমবিদ্বেষী অনুভূতিতে ভর করে যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আগ্রাসন চালাতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রুটগারস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দীপা কুমার বলেন, ‘মার্কিন সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটানোর জন্যই ইসলামিক সন্ত্রাসের ভয় উৎপাদন করা হয়েছে।’ 

৯/১১ সন্ত্রাসী হামলা এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। মুসলিমবিদ্বেষী পরিবেশে যুক্তরাষ্ট্র ২০০৩ সালে নির্লজ্জভাবে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের মিথ্যা অভিযোগে ইরাকে আগ্রাসন চালায়। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের সব মুসলিমদেরই অপরাধী হিসেবে চিত্রিত করা হয়। যুদ্ধকেন্দ্রিক ইসলামোফোবিয়ার বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে পশ্চিমা মিডিয়া। যারা ক্রমাগত মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা আগ্রাসনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে গেছে, এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি ৯/১১ হামলার সংযোগ ঘটাতে ইরাকে একটি মার্কিন কারাগারের নাম রাখা হয় ওই হামলায় নিহত এক দমকলকর্মীর নামে। ২০০৩ সালে ইরাকি জনগণের ওপর ফেলা একটি বোমার নামকরণ করা হয় ৯/১১ হামলায় নিহত এক ব্যক্তির নামে। এ মার্কিন উদ্যোগ ব্যাপকভাবে কাজও করেছে। এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯/১১ হামলার পর জন্মগ্রহণকারী মার্কিন নাগরিকদের এক-পঞ্চমাংশই মনে করেন, ওই হামলার জন্য প্রয়াত ইরাকি নেতা সাদ্দাম হুসেইন দায়ী।

ইরাক আগ্রাসনের মূলে বুশ প্রশাসন থাকলেও, এতে ডেমোক্র্যাটরা সমানভাবে সমর্থন দিয়ে গেছে। ২০১৬ সালে দলটির জাতীয় কনভেনশনে খিজির খানকে হাজির করা হয়, যার মার্কিন সেনা কর্মকর্তা ছেলে ইরাক যুদ্ধে নিহত হন। এখানে ডেমোক্র্যাটরা এক মুসলিম ব্যক্তিকে কনভেনশনে হাজির করে মুসলিমবিদ্বেষী আগ্রাসনের ন্যায্যতা দিয়েছে। সেইসাথে হিলারি ক্লিনটনের প্রতি সমর্থন জানিয়ে  ট্রাম্পের প্রকাশ্য ইসলামোফোবিয়ার বিরুদ্ধে খিজির খানকে ব্যবহার করা হয়।

এবারো এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ২০২০ সালের জাতীয় কনভেনশনেও ইরাক যুদ্ধের জয়জয়কার! ২০০৩ সালে বুশ প্রশাসনের আগ্রাসন চালানোর অনেক আগে থেকেই ইরাক দখলের পক্ষে জোরালো কণ্ঠস্বর জো বাইডেনকে প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন দেয়া হয়। বাইডেনের মনোনীত ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী কমলা হ্যারিসও সামরিক বাহিনীর একনিষ্ঠ সমর্থক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। এমনকি করোনাকালেও মার্কিন সামরিক বাহিনীর দানবীয় বাজেটে কাটছাঁটের বিপক্ষে তিনি। কমলা নীতিনির্ধারণী সংস্থা সেন্টার ফর অ্য নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির সাথে যুক্ত। এ সংস্থাটি মার্কিন সমরবাদের প্রণোদনাকারী, যার মূল ভিত্তি মুসলিমবিদ্বেষ।

ইসরায়েল ও মার্কিন ইসলামোফোবিয়া

ইসরায়েলের প্রতি মার্কিন দ্বিদলীয় ব্যবস্থার নিরঙ্কুশ সমর্থন ইসলামোফোবিয়ার আরেকটি দিক, যার মূলে রয়েছে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইসরায়েলি সেটেলারে বসতি নির্মাণ। এক্ষেত্রে মার্কিন নাগরিকদের ট্যাক্সে উৎপাদিত ইসরায়েলি ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের সাথে আরেকটি বড় হাতিয়ার হলো ইসলামোফোবিয়া। 

২০১২ সালে বিভিন্ন মার্কিন শহরে প্রচারিত একটি বিজ্ঞাপনের কথা স্মরণ করা যেতে পারে, যেখানে ‘বর্বর’ জিহাদিদের বিরুদ্ধে ‘সভ্য’ ইসরায়েলিদের সমর্থন করার আহ্বান জানানো হয়। ২০১৪ সালে ইসরায়েল ‘অপারেশন প্রটেকটিভ এজ’ নামে অবরুদ্ধ গাজায় এক আগ্রাসী অভিযান চালায়, যাতে পূর্ণ সমর্থন জানায় ওবামা প্রশাসন। আবার এ আগ্রাসন চলাকালেই মার্কিন মুসলিম নেতাদের সম্মানে ইফতারের আয়োজনও করেন ওবামা। মার্কিন মুসলিম সমাজ ইফতার বয়কটের ডাক দেয়। তাদের অভিযোগ, ওবামা ফিলিস্তিনি নিধনযজ্ঞে সমর্থন দিয়ে মুসলিমদের বন্ধু সাজার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি ফিলিস্তিন ইস্যুকে ধামাচাপা দিতে চেয়েছেন।

ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত থাকে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ডানপন্থী সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী বলে ঘোষণা করেন। সেইসাথে পশ্চিম তীরকে সংযুক্ত করার ইসরায়েলি পরিকল্পনায়ও সমর্থন দেন। অপরদিকে কমলা হ্যারিস জানিয়েছেন, ইসরায়েলের প্রতি তার নিঃশর্ত সমর্থন রয়েছে। বাইডেনের অবস্থানও এর বাইরে কিছু নয়। 

হিন্দুত্ববাদ ও মার্কিন-ভারত জোট

ক্ষমতায় আসার পরপরই ট্রাম্প ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। উগ্র ডানপন্থী মতাদর্শিক অবস্থানের কারণেই তারা ‘সহজাত মিত্র’। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ট্রাম্পের ভারত সফরের সময়ে দিল্লিতে হিন্দুত্ববাদীদের উসকানিতে সংঘটিত দাঙ্গায় অর্ধশতাধিক মানুষ নিহত হন। তবে এ নিয়ে ট্রাম্পের মুখে কোনো কথা ছিল না। আগামী নির্বাচনে ট্রাম্প জয়ী হলে মুসলিমবিদ্বেষী এ মিত্রতা আরো সুদৃঢ় হবে বলে মনে করা হচ্ছে। 

ডেমোক্র্যাটিক পার্টি কমলা হ্যারিসের কৃষ্ণাঙ্গ-এশীয় পরিচয়কে ‘অগ্রগতির পরিচায়ক’ বলে প্রচার করছে। তবে বাইডেন প্রেসিডেন্ট হলে ট্রাম্প আমলের নীতিগত কোনো পরিবর্তন হবে না বলে তিনি নিজেই জানিয়েছেন। সেইসাথে মোদির হিন্দুত্ববাদী, মুসলিমবিদ্বেষী নীতিতেও বাইডেনের সমর্থন বজায় থাকবে বলে ডেমোক্র্যাটরা জানিয়েছে। 

এটি পরিষ্কার হয়, যখন বাইডেনের নির্বাচন পরিচালনাকারী কমিটি অমিত জানি নামের এক হিন্দুত্ববাদের কট্টর প্রচারককে সমন্বয়কারী হিসেবে নিয়োগ দেয়। 

ভোটে নেই পরিবর্তন

মার্কিন মুসলিম নাগরিকরা বাইডেনকে ভোট দিতে পারেন। ট্রাম্পের প্রকাশ্য মুসলিম বিদ্বেষের প্রতিক্রিয়া হতে পারে এটি। তবে এর মধ্য দিয়ে ইসলামোফোবিয়ার উত্থানে কোনো পরিবর্তন আসবে না। বড় জোর ট্রাম্পের সময়ে যে মুখোশটা খসে পড়েছিল, সেটি আবার পরে নিতে পারে মার্কিন ব্যবস্থা। 

২০২০ সালের নির্বাচনে যে দলই জয়ী হোক না কেন, ইসলামোফোবিয়া মার্কিন সমাজে নির্ধারক হয়েই থাকবে।

স্টকটন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক নাজিয়া কাজী বলেন, ‘যারা এই অচলাবস্থা নিয়ে হতাশ, তারা মার্কিন নির্বাচনী ব্যবস্থার বাইরে পরিবর্তনের কথা বলছেন। তারা ঋণ, যুদ্ধ, জলবায়ু ধ্বংসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ও সংগ্রামী আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের কথা বলছেন, যা রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় পক্ষই এড়িয়ে গেছে।’ 

তিনি আরো বলেন, ‘বাদামি চামড়া দিয়ে ইসলামোফোবিয়া ঢেকে রাখার বিরোধিতা করার এখনই সময়। প্রতিবার মার্কিন নির্বাচনের সময় আন্তরিক, চিন্তাশীল নাগরিকদের আন্দোলনে শামিল হতে হবে, কারণ এ ব্যবস্থা আর জনগণের সেবা করছে না। মার্কিন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সবচেয়ে প্রতারণামূলক ও স্থায়ী এ উপাদানটিকে (নির্বাচন) আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে আসার এখনই সময়।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //