প্রশ্নবিদ্ধ মার্কিন গণতন্ত্র

যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্র অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশ নাজুক অবস্থানে রয়েছে। এ পরিস্থিতি বুঝতে শুধু চলতি বছরের দিকে তাকালেই যথেষ্ট। 

অভিশংসন, মহামারি, দাবানল ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি রুথ বেডার গিন্সবার্গের মৃত্যুর পর তার পদপূরণ নিয়ে দ্বন্দ্ব তা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এর ওপর আসন্ন নির্বাচনে কতটা সমতা থাকবে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা তো রয়েছেই। 

ধারণা করা হচ্ছে- এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে এবার মার্কিন রাজনীতিতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। রাজনৈতিক দলগুলোয় বড় ধরনের রদবদল হতে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র এর আগেও রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি হয়েছে। আর প্রতিটি সংকট থেকে বের হওয়ার পর দেশটির রাজনীতি ও অর্থনীতিতে অতি জরুরি রূপান্তর দেখা গেছে। এ কারণে চলতি বছরও রাজনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

বিশদভাবে বলতে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে এখন ‘সিক্সথ পার্টি সিস্টেম’ চলছে। ১৯৮০ সাল থেকে এ ব্যবস্থা চলছে। বিগত শতাব্দীতে দলগুলোর মধ্যে স্থিতিশীল প্রতিযোগিতা ছিল, তাদের ক্ষমতাতেও বজায় ছিল ভারসাম্য। এসব দলের মধ্যে অর্থনীতিতে সরকারের ভূমিকার মতো ইস্যুগুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। ১৭৯৬-১৮২০, ১৮৩২-১৮৫৬, ১৮৬৮-১৮৯২, ১৮৯৬-১৯২৮, ১৯৩২-১৯৬৮ ও ১৯৮০ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দলগুলোর অস্তিত্ব হিসাব করা হয়েছে। রাজনীতির প্রতিটি পার্টি সিস্টেমে আপাদমস্তক রূপান্তর ঘটেছে। অভিজাত জোটগুলোর মধ্যে নানা কারণে চিড় ধরলেও মূলত সামাজিক সংকটকে কেন্দ্র করেই এসব দলে পরিবর্তন এসেছে। প্রথম ফাইভ পার্টি সিস্টেম ২৪, ২৪, ২৪, ৩২ এবং ৩৬ বছর ধরে এরকম সময় টিকে ছিল। 

আমরা যদি এই হিসাব ধরি, তাহলে বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলোরও ভেঙে পড়ার সময় চলে এসেছে। তবে দেখা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ৬০ বছর পর পরও পরিবর্তন এসেছে। মূলত জটিল রাজনৈতিক সিস্টেমের কারণে রাজনীতিতে সত্যিকারের পরিবর্তন আসতে কোনো ধরাবাঁধা সময় দেখা যায়নি। তবে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সময়টি একেবারেই অন্যরকম। নানারকম ইস্যুর সম্মুখীন হচ্ছে দেশটি। রাজনীতিতে শুধু অতিরিক্ত পক্ষপাতিত্বই নয়, তীব্র জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বিভেদও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। তবে অতীতের পারফরম্যান্স ধরে ভবিষ্যতে কিছু পাওয়ার বিষয়টি পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।

যুক্তরাষ্ট্রের অনন্য ইলেক্টোরাল সিস্টেমের কারণে এখানকার রাজনীতিতে সবসময়ই দুটি প্রভাবশালী জাতীয় রাজনৈতিক দল থাকে। এ দুটি দলই বেশকিছু শরিক দল নিয়ে জোট গঠন করে। যখনই একটি দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করতে যায়, তখন তাকে জাতীয় স্বার্থের বিষয়টি দেখতে হয়। তবে একটা সময় দেখা যায়, নানারকম স্বার্থের কারণে জোটের শরিক দলগুলো অনেক লম্বা সময় ধরে নিজেদের বন্ধন অটুট রাখতে পারে না। জোটকে একত্রিত করে রাখা নীতিগুলোও একটা সময় এসে আর তেমন কাজে আসে না। 

শুধু তা-ই নয়, যে শাসনের আদর্শ আগের সমস্যাগুলো সমাধান করতো, তা একসময় ভবিষ্যত সমস্যার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়; নতুন আদর্শের ওপর দল পরিচালনার দাবি সৃষ্টি হয়। এ ছাড়া দেশের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক পরিবর্তন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক এবং অভ্যন্তরীণভাবে ক্ষমতার আপেক্ষিক ভারসাম্যেও বদল নিয়ে আসে। 

তবে ভোটাভুটির ক্ষেত্রে একেবারে কঠোরভাবেই সব নিয়ম মানতে হয়। বিশেষ করে দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় বিরোধী পক্ষ যদি আপনার চাহিদাগুলো পাত্তা না দেয়, তাহলে কোনো জোট ভেঙে যাওয়ার বড় মূল্য দিতে হয়। আর তাই দেখা যায়, অর্থনৈতিক মন্দা অথবা বড় ধরনের বিরোধের মতো ঘটনা ঘটলেই জোটে ভাঙন দেখা দেয়। উদাহরণ হিসেবে ১৮৩২-১৮৫৬ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান পার্টি সিস্টেমের কথা বলা যায়। অ্যান্ড্রু জ্যাকসন এবং মার্টিন ভ্যান বোরেনের প্রতিষ্ঠিত পপুলিস্ট ঘরানার ডেমোক্র্যাটিক পার্টি এবং হুইগ পার্টির মধ্যে তুলনামূলক ভারসাম্যপূর্ণ প্রতিযোগিতা বিদ্যমান ছিল। 

যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন খাল এবং শুল্ক নিয়ে এই দলগুলোর মধ্যে বিতর্ক হতো; কিন্তু দাসত্ব ইস্যুটি নিয়ে তারা ভেতরে ভেতরে বিতর্ক করত। উল্লেখ্য, দুটি দলেরই উত্তরাঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে শাখা ছিল; কিন্তু যখন তারা পশ্চিমে কার্যক্রম সম্প্রসারিত করতে চাইল, তখন দাসত্ব ইস্যুটি আর এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না, ফলে দল দুটি বিভক্ত হয়ে পড়ে। একসময় গৃহযুদ্ধ শুরু হয় এবং নতুন জোটের আবির্ভাব ঘটে।

এর প্রায় এক শতাব্দী পর মহামন্দার ধাক্কায় ১৯৩২-১৯৬৮ সালে এ সময়ে আবার পার্টি সিস্টেমের উত্থান হয়। ডেমোক্র্যাটদের আধিপত্যে নর্দার্ন এবং সাউদার্ন ডেমোক্র্যাটদের নিয়ে ‘নিউ ডিল’ নামে নতুন জোট গঠন করা হয়। কল্যাণ রাষ্ট্রের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তারা একত্রিত হলেও শেতাঙ্গদের পক্ষে কতটা থাকা হবে, তা নিয়ে এখানে মতবিভেদ ছিল।

যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমানে বিদ্যমান পার্টি সিস্টেমের উদ্ভব ১৯৮০ সালের দিকে। এ সময় রিপাবলিকান ও ডেমোক্র্যাট উভয় দলই নিজেদের পছন্দের শরিক নিয়ে জোট গঠন করে। তবে ‘নিওলিবারেলিজম’ হয়ে ওঠে উভয় দলেরই আধিপত্যশীল অর্থনৈতিক আদর্শ। ‘নিওলিবারেলিজম’ এর স্পষ্ট অর্থ নেই। মূলত এই টার্মটি দিয়ে বাজার ও বেসরকারীকরণকে জননীতি এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রাথমিক উপাদান হিসেবে তুলে ধরা হয়। চার বছর আগে এই পার্টি সিস্টেম শেষ অংশে প্রবেশ করে। তখন অর্থাৎ ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নতুন পার্টি সিস্টেম চালু হওয়ার আভাস দিচ্ছিল। সেসময় নতুন নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমানের ইকোনমিক্যালি পপুলিস্ট রিপাবলিকান পার্টির অগ্রদূত। নির্বাচনে প্রার্থী থাকাকালে প্রচারণায় তিনি কল্যাণ রাষ্ট্র এবং অভ্যন্তরীণভাবে উৎপাদন কার্যক্রম চালুর পক্ষে জোর দিয়েছিলেন। তবে এই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের জন্য নীতি অবকাঠামো এবং দলে অভ্যন্তরীণ ঐকমত্যের অভাব ছিল। নিজস্ব নমনীয়তা, ব্যক্তিত্ব এবং ‘র‌্যাডিক্যাল ডেমোক্র্যাটদের’ ওপর দোষ চাপিয়ে ট্রাম্প মূলত পার পেয়েছেন। 

অন্যদিকে চলতি বছর অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি নীতিগত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে ডেমোক্র্যাটরা। দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের ক্ষমতায় আসা ঠেকানোর ওপর মনোযোগ দেওয়ার ফলে দলের মধ্যকার বিভাজনও দূর করতে সক্ষম হয়েছে। এর ফলে অভ্যন্তরীণ ঐক্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে ট্রাম্পের ব্যর্থতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের দলীয় রাজনীতিতে বিভাজন খুব সাধারণ বিষয়। 

এখন যুক্তরাষ্ট্রে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলই অনেক বেশি জাতীয়করণে ঝুঁকছে এবং চব্বিশ ঘন্টাই গণমাধ্যমের কাছাকাছি রয়েছে। ফলে যে কোনো ইস্যুই খুব দ্রুত চরম সংকটের মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছে যায়। তবে দেখা গেছে বড় ধরনের জাতীয় সংকটে নতুন প্রশাসনিক আদর্শের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা হয়; আর একে কেন্দ্র করেই নতুন জোট গঠিত হয়। চলমান সংকট কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট হয়নি; তবে মহামারি একে বড় করে তুলেছে। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক ধরন অনুযায়ী, এটিই বড় ইস্যু হয়ে উঠতে পারে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, চারদিকের ব্যাপক অসন্তোষ এবং অস্থিরতার মতো বিষয়গুলো অতীতে গণতান্ত্রিক সংস্কারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা রেখেছে। এই মুহূর্তে মার্কিন জনগণও বর্তমান পরিস্থিতি থেকে মুক্তি চাইছে। 

পিউ রিসার্চ সেন্টারের সাম্প্রতিক জরিপে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন মার্কিন নাগরিকের মধ্যে ছয়জনই মনে করে দেশটির সরকার গঠনের মৌলিক নকশা এবং কাঠামোতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পুনর্নির্মাণ আবশ্যক হয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //