বাইডেনে আস্থা কুর্দিস্তানের!

যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে জো বাইডেনের জয়কে স্বাগত জানিয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কুর্দিদের একটি বড় অংশ। 

সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট বাইডেন কুর্দিদের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে পরিচিত। তার জয় আশা জাাগানিয়া কুর্দি সম্প্রদায়ের জন্য। তারা মনে করছেন, বাইডেনের শাসনামলে ট্রাম্পের অহিতকর নীতিমালা থেকে খানিকটা স্বস্তি পাবেন। এমনকি কেউ কেউ আশা করছেন, স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্নপূরণে তাদের পক্ষেই কথা বলবে বাইডেন প্রশাসন। 

২০১৫ সালের মে মাসে আধা-স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান রিজিওন অব ইরাকের (ইরাকের কুর্দিস্তান অঞ্চল) প্রেসিডেন্ট মাসৌদ বারজানিকে বাইডেন বলেছিলেন, ‘জীবদ্দশায় একটি স্বাধীন কুর্দিস্তান দেখব আমরা।’ তবে প্রশ্ন রয়েছে- এ ধরনের আশাবাদ কতটা বাস্তবসম্মত?

তিন দশক ধরে কুর্দিদের সমর্থক বাইডেন। এ নিয়ে সন্দেহের অবকাশ খুব কম। ১৯৯১ সালে সাদ্দাম হুসেইনের অধীনে ইরাকি সেনাকে উত্তর ইরাকের মুক্ত কুর্দি অঞ্চল দখলে মদদ দেয়ার জন্য তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের তীব্র সমালোচনা করেছিলেন তিনি। ২০০২ সালে কুর্দি পার্লামেন্টকে আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, ‘পাহাড়ই আপনাদের একমাত্র বন্ধু নয়।’ ইরাক আক্রমণের পর ২০০৩ সালে বাইডেন একটি ফেডারেল মডেলের প্রস্তাব দেন। মডেলটির কারণেই গৃহযুদ্ধ ঘিরে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা নিরসনে সহায়তার জন্য কুর্দি, সুন্নি ও শিয়া অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বায়ত্তশাসনে পৌঁছানোর একটি ধাপ হিসেবে এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছিলেন কুর্দিরা।

কুর্দিদের বিষয়ে ট্রাম্প প্রশাসন গৃহীত নীতিমালারও কঠোর সমালোচনা করেছেন বাইডেন। ২০১৯ সালে তুরস্ককে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার কুর্দি বাহিনী সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফোর্সকে আক্রমণের জন্য সবুজ সংকেত দেন ট্রাম্প। এ ঘটনায় ট্রাম্পকে এ যাবৎকালের সবচেয়ে বেপরোয়া, অক্ষম শাসনকর্তা বলে মন্তব্য করেন বাইডেন। তবে ভুলে গেলে চলবে না, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ব্যক্তিটি যথেষ্ট বাস্তববাদী। কুর্দিদের প্রতি তার সহানুভূতি থাকতেই পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে সবসময় কুর্দিদের পক্ষে কাজ করবেন না তিনি।

আগামী বছরের ২০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়ে তিনি নিজ দেশের স্বার্থকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন। নতুন শাসনামলে মধ্যপ্রাচ্যের জন্য তৈরি এজেন্ডাতেই কুর্দিদের প্রতি সমর্থন দেয়ার ক্ষেত্রে তার সদিচ্ছা সীমাবদ্ধ থাকবে। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার দুই শাসনামলে তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। সেসময় ইরাক ও সিরিয়ার সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে তার এমন মনোভাবই পরিলক্ষিত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ সিদ্ধিতে তিনি কুর্দি নেতাদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ককেই হাতিয়ার করেছিলেন। প্রকৃত অর্থে কিছু ক্ষেত্রে তিনি বাাগদাদের বদলে কুর্দিদের কৌশলগত অবস্থান শক্তিশালীকরণ থেকে বিরত রেখেছিলেন। ইরাকে কুর্দি স্বায়ত্তশাসনকে সমর্থনকালে বাগদাদের সাথে কুর্দি রাজধানী ইরবিলকে চুক্তি করার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। বিতর্কিত প্রদেশ কিরকুক কুর্দি অঞ্চলের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত থাকায় ব্যক্তিগতভাবে বারজানিকে কুর্দি সংবিধানে ভোট বিলম্বিত করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বাইডেন। 

এ ঘটনা ইরাকে কুর্দি ও আরবদের মধ্যে জাতিগত সংঘাতের জন্ম দেয়। এছাড়া এটি ইরাকে মার্কিন স্বার্থকেও ক্ষুণ্ন করে। ২০১০ সালে কুর্দি নেতা জালাল তালাবানিকে ইরাকের রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফা দিতে অনুরোধ করেছিলেন ওবামার সাথে বাইডেনও; কিন্তু তালাবানি এ অনুরোধ না রেখ নিজ পদে অক্ষুণ্ন থেকেছেন। ওবামা-বাইডেনের অনুরোধের ঢেঁকি গিললে বাগদাদে কুর্দিদের ক্ষমতা কমে যেত, তা বলাই বাহুল্য। সাবেক ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নুরি আল-মালিকিকেও সমর্থন জুগিয়েছেন বাইডেন। ইরাকের ওই সাবেক প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালে ইরবিলের বাজেটের আকার কমিয়েছিলেন। এছাড়া ইরাকের সেনাবাহিনী থেকে কুর্দিদের অবাঞ্ছিত করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ দুটি ঘটনাই কুর্দিদের জন্য অস্বস্তিকর ছিল।

কুর্দিদের প্রতি বাইডেনের কর্মকাণ্ডের আদ্যোপান্ত বিশ্লেষণ করে মিডল ইস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষক ইয়েরেভান সাঈদ আল জাজিরায় লেখা এক নিবন্ধে বলেন, প্রকাশ্যে কুর্দিদের প্রতি বাইডেনের যতই সমর্থন থাকুক না কেন, আদতে তার রেকর্ড ভালো-মন্দে মেশানো। ব্যক্তিভাবে মানবাধিকার ও স্বাধীনতায় বিশ্বাসী বাইডেন। কুর্দিরা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অধিবাসী হোক, তা তিনি চাইতেই পারেন; কিন্তু বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জিং ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে এর পরিণতি কি হতে পারে, সে সম্পর্কেও যথেষ্ট ওয়াকিবহাল বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ বাইডেন। ২০০৭ সালে এই বাইডেনই কুর্দি নেতাদের স্বাধীন দেশের স্বপ্ন দেখতে নিষেধ করেছিলেন। 

তাদের সতর্ক করেন বলেন, ‘তুর্কি ও ইরানিরা আপনাদের জীবন্ত খেয়ে ফেলবে। আক্রমণ করবে। ধ্বংসাত্মক যুদ্ধ হবে।’ সেইসাথে জোর দিয়ে বলেছিলেন, আমেরিকার পক্ষে তাদের রক্ষা করা একেবারেই অসম্ভব। সম্প্রতি ইয়েরেভান সাঈদ ইরাকের কুর্দিস্তান সফর করেছেন। এ সময় স্বাধীন কুর্দিস্তান সম্পর্কে বাইডেনের ২০১৫ সালের মে মাসের মন্তব্য ও ওবামা প্রশাসনের অস্পষ্ট বক্তব্য নিয়ে কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কুর্দি কর্মকর্তা এ গবেষককে জানান, তখন মনে হয়েছিল- ওয়াশিংটন তাদের দীর্ঘকালীন ‘ইউনাইটেড ইরাক’ নীতি থেকে বেরিয়ে গেল। 

এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম, ওবামা-বাইডেন স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য আমাদের সবুজ সংকেত দিয়েছেন। কারণ তারা বলেননি, এটি করবেন না।’ বারজানির ঘনিষ্ঠ এক সাংবাদিকও একমত পোষণ করেন এই কর্মকর্তার সাথে। তিনি বলেন, ‘আমরা স্পষ্ট বার্তা ও বিবৃতি বুঝতে পারি; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র আমাদের তা দেয়নি।’ সুতরাং, এমন ভুল বোঝাবুঝি এড়াতে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনের জন্য কুর্দিদের প্রতি গৃহীত নীতিমালা স্পষ্ট করে দেয়া গুরুত্বপূর্ণ। তা না হলে অস্থিতিশীল হয়ে উঠবে এ অঞ্চল। আর এর প্রভাব পড়বে এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায়।

ইয়েরেভান সাঈদ বলেন, ‘বাইডেন তাদের জন্য কি করবেন, তা নিয়ে কুর্দিদের বসে থাকা হবে একেবারেই অনুচিত। সমর্থন প্রদান বা বিরোধ সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর বা অপেক্ষা করার পরিবর্তে তাদের উচিত নিজের দিকে নজর দেয়া। প্রকৃত অর্থে, তারা নিজেদের জন্য নিজেরা কি করতে পারে। তাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- কুর্দি প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করা, আইনের অনুশাসন সমর্র্থন, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমন ও বাকস্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের বিকাশ। এসব বিষয়ে অগ্রগতিকে স্বাগত জানাবে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাাসনও। কারণ এসব বিষয়ে উন্নতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সহজ হবে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের খেয়ালি নেতৃত্ব ও বেপরোয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর কুর্দিদের জন্য নিজেদের সঠিক পথে চালিত করতে উপরোক্ত বিষয়ে উন্নতি করা খুব গুরুত্বপূর্ণ। এভাবেই হয়ত কুর্দিরা পাবে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন ও মুক্তির পথ।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //