প্রেমের দুই রূপ আবির্ভূত

প্রেম কী, প্রেম কী কেবলই দেহাশ্রয়ী, নাকি অসীম কোনো বোধ যা আত্মার সঙ্গে মিশে যায়- তৈরি হয় নতুন এক বোধ। প্রেম সম্পর্কে বাংলা সাহিত্যের সেরা দু-তিনটি উপন্যাসের একটি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘শেষের কবিতা’। এবারে রবিঠাকুরের সেই শেষের কবিতা উপন্যাস নিয়ে নতুন পাঠ বিভাগে লিখেছেন- কাজী রুমানা শারমীন

শেষের কবিতা- মানে শেষ কবিতা নয়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবদ্দশার শেষ দিকের রচনার মধ্যে অন্যতম একটি শ্রেষ্ঠ রচনা এই- শেষের কবিতা। উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় ১৩৩৬ সালের ভাদ্র মাসে কিন্তু এর পূর্বে ১৩৩৫ সালের ভাদ্র থেকে চৈত্র পর্যন্ত দীর্ঘ আট মাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। উপন্যাসটি রচিত হয়েছিল কবির দাক্ষিণাত্যে ভ্রমণের সময়কালে। শেষের কবিতার সবকিছুই অভিনবত্বে ভরপুর, এমনকি এর রচনাশৈলীতেও। শেষের কবিতা শুধু রবীন্দ্র উপন্যাস ধারায় নয়, সমগ্র বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন দিক থেকে অভিনব। এমন ভঙ্গিতে বাংলা সাহিত্যের আর কোনো উপন্যাস রচিত হয়নি। এই উপন্যাসের ভাষা শৈলী থেকে শুরু করে উপমার প্রয়োগ সবই হঠাৎ বিদ্যুৎ ঝলকের মতো দীপ্তিমান। উপমা-উৎপ্রেক্ষা-শ্লেষের অভিনবত্বের সঙ্গে মিলেছে বর্ণনার কবিত্বময়তা। আকাশের সোনার রঙের ওপর চুনি গলানো পান্না গলানো আলোর আভাসগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে; মাঝে মাঝে পাতলা মেঘের ফাঁকে ফাঁকে সুগভীর নির্মল নীল, মনে হয় তার ভিতর দিয়ে- যেখানে দেহ নেই শুধু আনন্দ আছে- সেই অমর্ত্যজগতের অব্যক্ত ধ্বনি আসছে। ধীরে ধীরে অন্ধকার হলো ঘন। সেই খোলা আকাশটুকু, রাত্রি বেলার ফুলের মতো, নানা রঙের পাঁপড়িগুলো বন্ধ করে দিলে, এই ধরনের ভাষারীতি, ভাষার প্রয়োগের মাধুর্য অনস্বীকার্য। এই উপন্যাসের আরেকটি অনবদ্য দিক হলো- গদ্য বর্ণনার ফাঁকে ফাঁকে পাত্র-পাত্রীর কবিতার ব্যবহার যা গ্রন্থখানির সামগ্রিক তাৎপর্য বোঝার জন্য অনস্বীকার্য, অপরিহার্য। 

এই উপন্যাসের স্থান-কাল-পাত্র-পাত্রী সবই তৎকালীন ইঙ্গ-বঙ্গ সমাজের। যেখানে অমিত একটি কৃত্রিমতার সাধনায় নিমজ্জিত। লেখক রবীন্দ্রনাথ উপন্যাসে কৃত্রিমতার ওপর স্বাভাবিকতার স্থান নির্দেশ করেছেন, যা উপন্যাসের সমাপ্তিতে লক্ষ্যণীয়। এই স্বাভাবিকতাই যে গল্পের প্রধান পাত্র-পাত্রীর জীবনের দিক নির্দেশনের সহায়ক হয়েছে তা বলাই বাহুল্য। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে প্রেমের দুই রূপ- একটি, দেহাশ্রয়ী জৈববৃত্তির প্রাধান্য; অন্যটিতে, অসীমের সাধনা। এই উপন্যাসেও কবির প্রেমতত্বের সীমা-অসীমের আধ্যাত্মিক ধারনার প্রভাব বিস্তৃত। অর্থাৎ পার্থিব দেহাশ্রয়ী প্রেম এবং অতিন্দ্রীয় প্রেমধারণা এখানে বেশ উল্লেখযোগ্যভাবে বৈচিত্র্য লাভ করেছে। শেষের কবিতায়-ও প্রেমের এই দুই রূপ পরিস্ফুট। লাবণ্য মূলত ছিলো ভালোবাসার সসীম রূপের প্রবক্তী, অন্যদিকে অমিত প্রেমের অসীমতায় বিশ্বাসী। এরা পরস্পরের কাছ থেকে প্রেমের অন্যরূপের মহিমা উপলব্ধি করেছে কিন্তু জীবনের প্রাত্যহিক চাহিদা রক্ষার তাগিদে অর্থাৎ প্রেমের সসীম প্রেরণায় শোভনলালকে স্বীকার করে নিয়েছে লাবণ্য। অন্যদিকে অমিত লাবণ্যের স্মৃতির মধ্যে প্রেমের পূজা মূর্তির সন্ধান পেয়েছে কিন্তু পরিবর্তনশীল বাস্তব জগতের প্রেমও সে পেতে চেয়েছে কেতকীকে বিয়ে করে। এই কথাই অমিত তার ভাষাতে শংকরকে বলেছে- ‘যে ভালোবাসা ব্যাপ্তভাবে আকাশে মুক্ত থাকে সে দেয় যশ, যে ভালোবাসা বিশেষভাবে প্রতিদিনের সবকিছুতে যুক্ত থাকে সে দেয় আষ্টঙ্গ- দুটোই আমি চাই।’ ঘড়ায় তোলা জল ও দীঘির জলের রূপক দিয়ে কবি আবারও এই কথারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। প্রেমে মানুষের মুক্তি সব সময় কিন্তু যা ভালোবাসা তাই বন্ধন। 

 প্রেমের এই দুই রূপের মধ্যে স্বভাবতই দ্বন্দ্ব আছে- তাই লাবণ্য আর অমিতের মিল হয়নি। কারণ রবিঠাকুর নিজেই বলেছেন- ‘যেখানে খুব করে মিল সেখানেই মস্ত বিরুদ্ধতা।’ জীবনের সমস্ত সাধনার ক্ষেত্রে যেমন প্রাপ্তিলাভ সহজ নয়, প্রেমের ক্ষেত্রের তেমনি সীমা-অসীমের মিলন দূরহ, সাধারণভাবে শেষের কবিতার বলার ভঙ্গি বা লেখনী আপাত তরল-সরল হলেও এর কাহিনী জীবন লাভ করেছে বাস্তব মনস্তাত্বিক ভিত্তির ওপর যেখানে আবেগতাড়িত প্রেম ও জীবনমুখী প্রেমের পার্থক্য এবং সুস্পষ্ট বোধ। শুধু তাই নয়- যখন অমিতকে খুঁজতে তার বোন শিলং চলে আসে, অমিত সেসময়ে অস্বাভাবিক উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, তাতে লাবণ্যর অর্ন্তদৃষ্টি জাগ্রত হয়েছে যে- তাদের দু’জনে শুধু স্বভাবেই গরমিল নয়, তাদের মাঝে সামাজিক ব্যবধানও দুস্তর। তাই উপন্যাসের পরিণতিতে লাবণ্য চলে যায় শোভনলালের সসীম প্রেমের কাছে আর অমিতও আশ্রয় করে কেতকীতে যা আমাদের বাস্তব জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। শেষের কবিতায় তাই অমিতের পরিবর্তন লক্ষ্যণীয়- লভিয়াছি চির স্পর্শমণি; আমার শূন্যতা তুমি পূর্ণ করি গিয়েছ আপনি 

তেমনি লাবণ্য শোভনলালের পাঠানো- তোমারে দিইনি সুখ... নিজের করে নিয়েছো। প্রেমে লাবণ্য স্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী, ভালোবাসার অত্যাচার তার পছন্দ নয়, ভালোবাসার পাত্রকে মুক্তিদান মৃত্যুর শামিল হলেও- অসম্ভব নয়। প্রেম সম্পর্কে দু’জনের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যায়নের ইঙ্গিত এতে সুস্পষ্ট। নিত্য ধাবমান চিরন্তন কালের পটভূমিতে এক প্রেম মৃতুঞ্জয়, অপরিবর্তিত। অন্যদিকে- এই নশ্বর পৃথিবীর মাটির ভালোবাসা নারীর প্রাত্যহিক প্রেমের পূজার ব্যঞ্জনা- লাবণ্যের ‘শেষের কবিতা’র এই বোধ সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ ও অমিত লাবণ্যের প্রেমলীলার গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //