মিলান কুন্দেরা, জীবনশিল্পের চিরায়ত রূপ

দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ৯৪ বছর বয়সে মারা গেলেন ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইইটনেস অব বিইং’ খ্যাত চেক ঔপন্যাসিক মিলান কুন্দেরা। চেকোস্লোভাকিয়ার ব্রনোতে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া মিলান কুন্দেরা একদম ছোট থেকেই গান ও পারফর্মিং আর্টের সাথে পরিচিত হন। তার বাবা লুডভিক কুন্দেরা ছিলেন সেই সময়ের একজন গুরুত্বপূর্ণ সঙ্গীত তাত্ত্বিক। ছোট থেকেই সঙ্গীত শিখে আসা মিলানের উপন্যাসের পরতে পরতে মিউজিক্যাল আবহ পাওয়া যায়। সাহিত্য ও নন্দনতত্ত্ব নিয়ে পড়া শুরু করলেও পরে প্রাগের ফিল্ম একাডেমিতে ভর্তি হন মিলান কুন্দেরা। ১৯৫২ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করার পর একাডেমিতেই প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন। কুন্দেরা ১৯৫৫ সালে ‘দ্য লাস্ট মে’র মাধ্যমে নিজের সাহিত্যের পারদর্শিতার জানান দেন। নিজের সাহিত্যে সোশ্যাল রিয়েলিজমকে অস্বীকার করার ফলে ১৯৫৪ সালে ও ১৯৭০ সালে কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বরখাস্ত হয়েছিলেন তিনি। 

১৯৭৫ সালে কুন্দেরা তার সংস্কারবাদী স্বপ্ন ত্যাগ করে নির্বাসন নেন ফ্রান্সে। পরবর্তী জীবনে তিনি ফ্রেঞ্চ ঔপন্যাসিক হিসেবেই পরিচিতি পান। তার নিরীক্ষাধর্মী কাজ, সাহিত্যের মধ্য দিয়ে দর্শন, মনস্তত্ত্ব ও রাজনৈতিক যাত্রার জন্য পাঠকদের মধ্যে অনেক আলোচিত তিনি। বেশ কয়েকবার সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিলেন এই চেক লেখক। 

মিলান কুন্দেরা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতি লাভ করেন তার উপন্যাস অবলম্বনে ফিলিপ কাউফম্যানের ১৯৮৮ সালের সিনেমা ‘দ্য আনবিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’-এর মাধ্যমে। এটা তার একটি মনোদার্শনিক উপন্যাস। এর একদম গভীরে লুকিয়ে আছে নিৎশের ‘চিরন্তন প্রত্যাবর্তন’-এর শৈল্পিক রূপ। নিৎশে বলেছেন, অনন্তকাল ধরে এই পৃথিবীতে সব কিছু, মানুষ, বিভিন্ন রকম ঘটনা, অনুভূতি, প্রায় একই রকম করে বার বার ফিরে আসে। 

উপন্যাস শুরু হয় এভাবে, পুরো সভ্যতা যদি বিশ্বাস করত যে সব কিছুই- অতীতের দুঃখ, হতাশা, ভয় যদি বার বার ফিরে আসে তাহলে জীবনকে অনেক ভারী লাগার কথা, যেন জীবনের স্রোতের বিপরীতে নিজেকে নিয়ে সাঁতার কাটছে; কিন্তু অনেকেই ধরে নেয় যে জীবনটা এমন না, কোনো দুঃখ ভয়, অনুভূতি বার বার জীবনে একই রকম করে ফিরে আসে না, এজন্য তাদের কাছে জীবনকে হালকা লাগে, অসহ্যরকম হালকা। 

উপন্যাসে থমাস একজন ডাক্তার যে তার স্ত্রীকে ভালোবাসে, এর সাথে আরও একজন নারীর সাথে যৌন জীবন কাটিয়ে বেড়ায়। ভালোবাসার মধ্যে কমিটমেন্ট যে জীবনের জন্য বেড়াজাল তা মনে করে থমাস জীবনটা অনেক হালকাভাবে নিয়ে স্বাধীন থাকতে চায়। অন্যদিকে নিজেকে পুরোপুরি থমাসের জন্য সঁপে দেওয়া তেরেসার চাওয়া পাওয়ার জায়গাগুলোর মধ্যে সব সময় বিশ্বস্ততার জায়গাটা অপূর্ণ থেকে যায় উপন্যাস জুড়ে। অন্য কারও কথা না মেনে দুজন মানুষের অকৃত্রিম জীবন যাপনের পেছনে ছোটার গল্প ‘দ্য আন বিয়ারেবল লাইটনেস অব বিইং’। গল্পের প্রধান চরিত্র থমাস ও তেরেসার ছুটে চলার গল্পের মাধ্যমে কুন্দেরা শুধু এটুকু বলতে চেয়েছেন জীবনের নিজস্ব কোনো অর্থ নেই, শুধু মাত্র অকৃত্রিমতা ছাড়া। 

উপন্যাসের জন্য পরিচিত হলেও একজন কবি ছিলেন মিলান কুন্দেরা। আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হন তার ‘দ্য জোক’, ‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ উপন্যাসগুলোর জন্য। নিজের মতো করে উপন্যাসের একটা শিল্পকলা রপ্ত করেছিলেন। প্রহসন লেখায় ছিল তার পাকা হাত। এর সঙ্গে গদ্য এবং নাটকও লিখেছেন তিনি। 

‘দ্য বুক অব লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’-এ তিনি আধুনিক সমাজে মানুষের অর্থহীন অস্তিত্বের মধ্যে হেসে খেলে ভুলে গিয়ে জীবন যাপন করা মানুষের গল্প বলেছেন। অন্যদিকে ‘দ্য ফেস্টিভাল অব ইনসিগ্নিফিক্যান্স’-এ যৌনতা, চাহিদা, শিল্পকলা ও ইতিহাসের সাথে জীবনের অস্তিত্বের বন্ধুত্বের এক গীতিকাব্য রচনা করেছেন তিনি।

আইডেন্টিটি উপন্যাসে দেখা যাচ্ছে জীবনের এক সময়ে মানুষ তার খুব কাছের মানুষকে চিনতে পারছে না। প্রিয় মানুষের একান্ত ব্যক্তিগত পরিচয়কে ধরতে না পারার সাথে সাথে নিজের পরিচয় নিয়েও সন্দেহ করছে। পাঠকের চিন্তার জগতে নাড়া দিয়ে কুন্দেরা গল্পকে বাস্তব আর অবাস্তবের মধ্যবর্তী গোলকধাঁধার মধ্য দিয়ে নিয়ে যান। পাঠক ঠিক ঠাওর করতে পারে না তার জীবনে কোনটা বাস্তবে ঘটেছে আর কোনটা কল্পনা মাত্র। 

একজন পাঠক কীভাবে তার লেখাকে পড়বে সেটা নিয়ে তিনি বিশদ ভেবেছেন বলে তার উপন্যাসে দর্শন মনস্তত্ত্বে এক অন্যরকম পরিবেশনা দেখতে পাওয়া যায়। কুন্দেরার বেশির ভাগ উপন্যাসে তার ব্যক্তিগত জীবনকে সামনে নিয়ে এসেছেন। যারা নিজেদের প্রথাবিরোধী বলে মনে করে, তারা কুন্দেরার লেখার মাঝে বিদ্রোহের বুনন দেখতে পাবেন। একজন পাঠক কুন্দেরার উপন্যাস পড়েন। কারণ সে কুন্দেরা হতে চায় কিংবা জীবনের কোনো না কোনো সময়ে হয়তো ‘কুন্দেরা’ হতে চেয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //