নজরুলের আদর্শিক চৈতন্যের অনুভব মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাস

নজরুলের মৃত্যুক্ষুধা প্রথম মহাযুদ্ধ পরবর্তীকালের রচনা। এ কারণে যুদ্ধোত্তর যুগের অর্থসংকট, শ্রেণিবৈষম্য, নগরচেতনার প্রকাশ এবং উপলদ্ধির সার্থক রূপায়ণ ঘটেছে। বিশ শতকের প্রথম দুই দশক বিদ্রোহী কবির শৈশব-কৈশোর অতিক্রান্ত করার সময়টা ছিল বিক্ষুব্ধ আর অস্থিরতার। আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক প্রশাসনিক এবং সাংস্কৃতিক বলয়ের পালাক্রমের এক উত্তাল কালপর্ব। তার ওপর ১৯১৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এমন পারিপার্শ্বিক টানাপড়েনে সৃজনশীল চিন্তানায়করা উদ্বিগ। রাজনৈতিক অঙ্গন সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিষবাষ্পে জর্জরিত। সেই সঙ্কটাপন্ন সামাজিক অব্যবস্থায় নজরুল তাড়িত হন বিশেষ এক বোধ আর আদর্শিক চৈতন্যের নির্মল অনুভবে।

সৃষ্টির আনন্দ আর আবেগে বিভোর নজরুল মননশীল জগতেও এক প্রতিভাদীপ্ত লেখক। স্থিতিশীল জীবন নজরুলের বাস্তব জীবনে দেখা না গেলেও তার শৈল্পিক জগৎ ছিল এক সুসংবদ্ধ। এখানে তিনি অনন্য ও কালের যথার্থ নির্মাতা। তার বিখ্যাত উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ সেই সম্ভাবনার এক উজ্জ্বল। ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাসটি ১৯৩০ সালে প্রকাশ পায়। প্রায় দুই বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস ‘সওগাত’ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও কয়েকটি সংখ্যায় তা অনুপস্থিত থাকে। উপন্যাসটি রচনার সময় কাজী নজরুল ইসলাম পুরো পরিবার নিয়ে কৃষ্ণনগরে বাস করতেন। এলাকার নাম ছিল ‘চাঁদ সড়ক’। খ্রিষ্টান মিশনারি এবং মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাটির কলহ-বিবাদ, ধর্মীয় মতভেদ, আর্থিক টানাপড়েন, সম্পর্কের অন্তর্দ্বন্দ্ব, নিত্যদিনের জীবন প্রবাহ সব মিলিয়ে নজরুলের মানবিক চেতনার বিদগ্ধ রচনা তারই সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি কবির এই ‘মৃত্যুক্ষুধা’ উপন্যাস।

একেবারে কাছ থেকে দেখা সাধারণ মানুষের জীবন-ঘনিষ্ঠতার যে যথার্থ অবয়ব নজরুলের সৃজন ও দ্যোতনায় গতি পায় তারই বিশিষ্ট আয়োজন এই উপন্যাসটি। মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের ঘটনাবহুল বিষয়বস্তু ও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক আর ধর্মীয় আবহ গ্রন্থের আবেদনকে যে মাত্রায় নিয়ে যায় তা যেমন সমকালীন বিক্ষুব্ধ ব্যবস্থাকে স্পষ্ট করে, একইভাবে ঔপন্যাসিককেও এক বিশিষ্ট মর্যাদায় দাঁড় করায়। সামাজিক বিভেদ, ধর্মীয় বিরোধ, শ্রেণিবিভক্ত সমাজের অসঙ্গতি এবং শাসন-শোষণের সুতীব্র আঁচড় নজরুল কখনো মানতে পারেননি। তার পরিচ্ছন্ন অনুভব যেমন কবিতায়, সঙ্গীতে একইভাবে তার কথাশিল্পেও।

ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের সময়ে সকল অত্যাচার নির্যাতন ও নিগ্রহের বিরুদ্ধে লড়াই করা অত সহজ ব্যাপার ছিল না। কারাবাস থেকে আরম্ভ করে বই বাজেয়াপ্ত করাসহ বিভিন্ন ধরনের দ-ের বোঝা নজরুলকে বহন করতে হয়েছিল। কিন্তু অদম্য ও নির্ভীক বিদ্রোহীকে কোনোভাবেই থামানো যায়নি। মৃত্যুক্ষুধা সেই বোধেরই রচনাশৈলী যা সমকালীন সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এক শক্ত প্রতিবাদ। নিম্নবিত্তের শ্রম বিনিয়োগকারীরাই তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্র। উপন্যাসের শুরুতে লেখক যা বলেন- ‘জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে এদের পুরুষেরা জনমজুর খাটে অর্থাৎ রাজমিস্ত্রি, খানসামা, বাবুর্চিগিরি বা ওই রকমের কিছু একটা করে। আর মেয়েরা ধান ভানে, ঘর-গেরস্তালির কাজকর্ম করে, বাঁধে, কাঁদে এবং নানা দুঃখ-ধান্ধা করে পুরুষের দুঃখ লাঘব করার চেষ্টা করে। বিধাতা যেন দয়া করেই এদের জীবনের দুঃখকে বড় করে দেখার অবকাশ দেননি। তাহলে হয়তো মস্ত বড় একটা অঘটন ঘটত। এরা যেন মৃত্যুর মাল গুদাম। অর্ডারের সঙ্গে সঙ্গে সাপ্লাই। আমদানি হতে যতক্ষণ, রপ্তানি হতেও ততক্ষণ।’ 

চরম দুঃখ আর কষ্টের ভাসমান স্রোতে বহমান নজরুলের নিজের জীবনটাই তো ছিল অতি সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের মতো। এক সময় সেখান থেকে উঠে আসতে যে লড়াই করতে হয়েছিল বলেই বোধহয় সেই কারণে তার সাহিত্যের সিংহভাগজুড়ে আছে অসহায়, নিঃস্ব এবং নিরীহ মানুষের করুণ আর্তি। মৃত্যুক্ষুধা সেই ধারারই একটি অনুপম সৃষ্টি।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্রই গল্পের গতিময়তায় অনন্য। মূল চরিত্র ঠিক করা এখানে খুব কঠিন। কোনো সময় মনে হয় গজালের মা-ই প্রধান নারী চরিত্র। কিন্তু উপন্যাসের নিজস্ব ধারায় মেজ বউয়ের যে সাবলীলতা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্বের অবিচলতা তাতে মনে হয় অন্য সব চরিত্র মøান হয়ে যায় তার স্বাতন্ত্র্যিক বৈশিষ্ট্যে। ঘটনা পরিক্রমায় মেজ বউ চরিত্রটি উপন্যাসে যে দীপ্তি ছড়ায় তার কিরণ শেষ হয়েও পরিণতি লাভ করে না।

মৃত্যুক্ষুধা উপন্যাসে নজরুল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে দেখিয়েছেন সমাজ ব্যবস্থাই কোনো মানুষের চরিত্রের গতি নির্ণয় করে দেয়, তার ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটায়। 

গজালের মা তার বয়স, অভিজ্ঞতা আর প্রাত্যহিক জীবনের টানাপড়েনে প্রচলিত ব্যবস্থার কাছে নিজেকে সমর্পিত করে। কিন্তু অকাল বিধবা মেজ বউয়ের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক টানাপড়েনে ঘর থেকে বের হওয়া মেজ বউ ধর্মীয় বাতাবরণের এক পরিবর্তিত অধ্যায়েরও শিকার হয়। মুসলমান থেকে একেবারে ক্রিশ্চিয়ান হওয়া তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার এক অসহনীয় পরিস্থিতি। যার শিকার হতে হয় উঠতি বয়সে অনাগত জীবনের নতুন করে কোনো কিছু পাওয়ার এক প্রত্যাশিত আকাক্সক্ষা। তৎকালীন সময়টা চিন্তা করলে বুঝতে কষ্ট হবে না খ্রিষ্টান মিশনারিরা কীভাবে এদেশীয় হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মান্তর করার এক অপকৌশলে মেতে উঠেছিল। উপন্যাসের আকর্ষণীয় চরিত্র মেজ বউকে সেভাবেই লেখক পাঠকের সামনে হাজির করেছেন। পাশাপাশি এসব ঘটনার সামাজিক বিরোধগুলোকে অত্যন্ত সহজ এবং সাবলীলভাবে পাঠকের কাছে নিয়ে আসা হয়েছে।

হিন্দু, মুসলমান এবং খ্রিষ্টানদের যে ধর্মগত বিভেদ তা কোনো এক সময় মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যেতেও বেশি দেরি লাগে না। সূক্ষ্ম বিরোধগুলো অতি সাধারণ এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের ভাবায়ও না তেমনভাবে। যেমন প্যাঁকালে মুসলমান হয়েও ক্রিশ্চিয়ান কুর্শির প্রেমের সাগরে ডুবে যায়। এক সময় বিয়েও করে বসে। সমাজচ্যুত হওয়ার আশঙ্কায় অন্যত্র পালিয়েও যায়। উপন্যাসের একটি বিশিষ্ট চরিত্র এই প্যাঁকালে। সুপুরুষ প্যাঁকালে উদীয়মান কিশোরীদের স্বপ্নের মানুষ। তার মধ্যে কুর্শি তার আকাক্সিক্ষত নারী। কুর্শির জন্য সে সব কিছু করতে পারে এবং করে দেখায়ও। মানুষের সহজাত ভালোবাসা, আবেগ আর প্রীতির বাঁধনে বাধা প্যাঁকালে এবং কুর্শি। প্রতিটি মানুষের জীবনের উল্লেখযোগ্য আর অপরিহার্য পর্যায় মায়া-মমতায় সিক্ত এই চিরায়ত বন্ধন যা লেখক কুর্শি আর প্যাঁকালের মধ্যে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত করেন। ঘটনার টানাপড়েনেও যে বন্ধন আলগা হয় না। বিয়ের আগে একবার প্যাঁকালে পালিয়ে গেলেও পরে পছন্দের মানুষ কুর্শির সঙ্গেই জীবনের মালা গাঁথে। 

উপন্যাসের এক পর্যায়ে বিপ্লবী দলের সংগঠক আনসারের উপস্থিতি। বৈপ্লবিক আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী সে। গোপন আস্তানায় তাদের সাংগঠনিক এবং বিভিন্ন সামাজিক কার্যকলাপ পরিচালিত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অন্তরালে এই কার্যক্রম চালাতে গিয়ে এসব বিপ্লবীকে অনেক ঝামেলাও পোহাতে হয়। ছন্নছাড়া এবং অনিশ্চিত জীবনের ঘানি টানতে টানতে কখনো বা কোথাও গিয়ে আস্তানা গাড়ে কয়েক দিনের জন্য। দেশমাতৃকার শৃঙ্খল মোচনে উদ্দীপ্ত আনসার সমাজের ছোটখাটো অনেক ঘটনারও অংশীদার হয়ে যায়। আনসারের কাছে ধর্মীয় বিভেদ তেমন কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু এর কারণে যেসব অনাহূত অবস্থার মুখোমুখি হতে হয় সেটাই তাকে ভাবিয়ে তোলে। বিত্তশালী মুসলমান পরিবারের যুবক আনসার এই উপন্যাসের নায়ক। দারিদ্র্য, ক্ষুধা, দুর্ভিক্ষের পরিপ্রেক্ষিতে সপরিবার মেজ বউয়ের মুসলিম থেকে খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। অন্যদিকে রুবি আনসারকে ভালোবাসলেও রুবির পিতা তাকে বিয়ে দেয় আইসিএস পরীক্ষার্থী মোয়াজ্জেমের সঙ্গে। মোয়াজ্জেমের মৃত্যুর পর বিধবা রুবির জীবনে নেমে আসে সমাজের বিধিনিষেধ। মেজ বউয়ের ক্রিশ্চিয়ান হয়ে এলাকা থেকে চলে যাওয়াটাও তেমনি এক দৃষ্টিকটু ব্যাপার যা আনসারকেও চিন্তিত করে। যদিও মেজ বউ তার চারিত্রিক দৃঢ়তায় নিজের সমস্যা নিজেই সমাধান করার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এবং এক সময় তা করেও। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম তার স্বভাবসুলভ বৈপ্লবিক চেতনায় প্রতিটি চরিত্রে যেভাবে প্রচলিত ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দৃঢ় মত ব্যক্ত করেন একইভাবে তা প্রথাসিদ্ধ সমাজের একটি সচিত্র প্রতিবেদনও বটে। ব্যক্তি চরিত্রের নানা সম্ভাবনা আর অসঙ্গতি সব মিলিয়ে উপন্যাসের যে গতি প্রকৃতি সব সময় তা স্রষ্টার নিয়ন্ত্রণেও থাকে না।

মৃত্যুক্ষুধার অনেক মৃত্যুর নির্মম পরিণতি যেমন পাঠককুলকে ব্যথিত করে তার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় প্রতিদিনের মৌলিক চাহিদা ও হাহাকার। আপনজনের মৃত্যু যন্ত্রণা এক সময় অভ্যাসে পরিণত হয় কিন্তু নিত্য ক্ষুধার অসহনীয় পেষণ একেবারে সহ্য সীমার বাইরে। লেখক উপন্যাসটা লিখেছেন নিজের দেখা একটি বস্তি এলাকার ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের বিভিন্ন রকমের জীবন ও ঘটনাপ্রবাহে। 

গজালের মার প্রথম তিন সন্তানই মৃত। প্যাঁকেল বেঁচে থেকেও ছন্নছাড়া, গৃহহীন। মায়ের সঙ্গে পুরো সংসারের আবর্তে সে কখনোই পড়তে চায়নি। এমনকি কুর্শির সঙ্গেও নয়। নিজেকে নিয়েই নিজে ব্যস্ত। 

মেজ বউ রূপে-গুণে সাধারণের নজরকাড়া এক দৃঢ়চিত্তের নারী। নিজের ইচ্ছেতেই দুই সন্তানকে বাদ দিয়ে ক্রিশ্চিয়ান ধর্ম গ্রহণ করা। বড় ছেলের মৃত্যুর পর আবার ঘরে ফিরে আসা। সেখানেও তার বিপন্ন অবস্থার আঁধার কাটে না। উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র বিধৃত হয়েছে দুঃখ কষ্টের এক নিদারুণ নির্মমতায়, যেখানে সুখ আলেয়ার আলো হয়ে দেখা দেয়। নারীজীবনের দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা এবং সমাজের বাস্তবচিত্র এই উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে। উপন্যাসের কাহিনি, চরিত্র চিত্রণ ও রোমান্টিকতার  বিচারে কবি কাজী নজরুল ইসলামের দ্বিতীয় উপন্যাস ‘মৃত্যুক্ষুধা’ গদ্য সাহিত্যের এক অসাধারণ শিল্পকর্ম।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //