আগুনের পরশমণি

শহরের গেরিলা মুক্তিবাহিনীর গল্প

বাংলাদেশের মানুষের জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের নাম ১৯৭১। স্বাধীনতা এবং বিজয় এই কাঙ্ক্ষিত দুটি শব্দই ছিল সেই সময়ের বেশি আলোচিত। আজ যেমন ফিলিস্তিনের জনগণ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে সেরকম। সেই সময়ের ঘটনা নিয়ে আজ অবধি বহু গল্প, উপন্যাস, কবিতা, গান, সিনেমা, নাটক ইত্যাদি হয়েছে, হচ্ছে এবং আরও হবে। এটাই স্বাভাবিক। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় আমরা এই স্মৃতি নিয়ে বীরদর্পে এগিয়েছি। সামনের সময়গুলোতেও সেই বিজয় আখ্যানই আমাদের পাথেয়। স্বাধীনতার যুদ্ধের ওপর লেখা উল্লেখযোগ্য বইয়ের কথা বললে বিশেষভাবে বলতে হয় জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস ‘আগুনের পরশমণি’ উপন্যাসটি প্রয়াত পাঠকপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক অনেক সাহিত্য রচনা করেছেন। লিখেছেন কালজয়ী সব উপন্যাস। প্রতিটি উপন্যাসই সাহিত্যের বিবেচনায় এক অমূল্য সম্পদ। 

এসব উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধকালীন পরিস্থিতি সুচারুরূপে বর্ণনা করেছেন; কিন্তু এই বইটি একটু আলাদা। বইটির কাহিনির ধারা বর্ণনাতেও রয়েছে বৈচিত্র্য। আগুনের পরশমণি উপন্যাসটি পরিবারকেন্দ্রিক এবং শহরের গেরিলা মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধের কাহিনি ঘিরে আবর্তিত হয়েছে। এর মধ্যেই আছে প্রেম-ভালোবাসার উপাখ্যান। পরে এটি নিয়ে চলচ্চিত্রও হয়েছে। সেটিও দর্শকপ্রিয় এবং দারুণ সুখ্যাতি কুড়িয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন বাকের ভাই খ্যাত বিখ্যাত অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর। বিখ্যাত সব বই থেকে বিখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাণ অতীতেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে। এটা যেমন বাংলাদেশে তেমনি বাইরেও রয়েছে। সেসব বইয়ের মতো চলচ্চিত্রও দর্শকের মাঝে সাড়া ফেলে দেয়। এটা সবচেয়ে বেশি নাড়া দেয় সেই সব দর্শককে, যারা সেই বইটি পড়েছে তাদের। আমার কাছে তাই মনে হয়। পাঠকরা সে সময় দর্শক হয়ে চেষ্টা করেন যে বই থেকে পর্দায় কাহিনিটি এসেছে সেটি কতটুকু সামঞ্জস্য হয়েছে। বইয়ের চরিত্রগুলো পর্দায় ঠিকমতো এসেছে কি না। এসব প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খায়। সে কারণে সাধারণ দর্শকদের থেকে এসব বই পড়া দর্শকদের আগ্রহ এবং বিশ্লেষণে একটা পার্থক্য থাকে। 

বাংলা সাহিত্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে বহু উপন্যাস এবং তা থেকে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। উদাহরণ অনেক রয়েছে। প্রতিনিয়তই নতুন নতুন সাহিত্য সৃষ্টি হচ্ছে। সাহিত্যের একেকটি শাখা নতুন করে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন পরিস্থিতিকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরছে। কবিতা, ছড়া, ছোটগল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে পাঠকদের কাছে উপস্থাপন করছেন লেখকরা। ভবিষ্যতেও আরও অনেক সাহিত্যকর্ম রচিত হবে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। যুদ্ধের প্রভাব বরাবরই ভয়ংকর ও ক্ষতিকর। যুদ্ধ বিশ্বের সেরা কিছু সাহিত্য ও শিল্পকর্মের সূতিকাগারও। প্রতিটি জাতির ক্ষেত্রেই এটা হয়েছে। বাঙালি জাতির সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ দেশের প্রধান সব লেখকের হাতেই পেয়েছে নতুন মাত্রা। অর্থাৎ লেখক বা কবি হওয়ার সত্তায় একাত্তরের ঘটনাবলি বাদ দেওয়ার কোনো শক্তি নেই। আর তা করতে হলে লেখক হবেন অর্ধেক বাকি অর্ধেক মৃত। এটা আমার মত। আগুনের পরশমণি উপন্যাসের প্রধান চরিত্রে আসলে বদিউল আলম নামের মুক্তিযোদ্ধাকে মনে হলেও আসলে আরও পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলোও অন্যতম প্রধান চরিত্র। যে পরিবারে এসে বদিউল আলম ওঠেন বা আশ্রয় নেন ঢাকা শহরের সেই পরিবারের কর্তা মতিন সাহেব। যিনি মহাবিপদ জেনেও পরিবারের কাউকে কিছু না জানিয়ে, এমনকি তার স্ত্রী সুরমাকেও কিছু বলেননি আশ্রয় দেন সেই মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারকে। এই সাহস সকলের থাকে না। মতিন সাহেবের ছিল। যেখানে ঢাকা শহর তখন একটা মৃত্যুকূপ সেখানে এটা যে কতবড় ঝুঁকিপূর্ণ ছিল তা বলাই বাহুল্য। যদিও গল্প কিন্তু কাহিনি পড়লে তা মনে হয় বাস্তব। নিজেকে গল্পের যে কোনো চরিত্রের সাথে মেলালেই গা শিউরে ওঠে। কতটা ভয়ংকর ছিল সে সময়ের পরিস্থিতি। প্রথমেই সময়ের বর্ণনায় রয়েছে, জুলাই মাসের ছয় তারিখ। বুধবার। উনিশশ একাত্তর সন। একটি ভয়াবহ বছর। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুঠির ভেতর একটি অসহায় শহর। শহরের অসহায় মানুষ। চারদিকে সীমাহীন অন্ধকার। সীমাহীন ক্লান্তি। দীর্ঘ দিবস এবং দীর্ঘ রজনী।

ঢাকা শহরে বদিউল আলমের সাত মুক্তিযোদ্ধা সাথে নিয়ে একের পর এক সফল অপারেশন করা মতিন সাহেবের মনে স্বাধীনতার আশার সঞ্চার করে। তিনি রাতে আকাশবাণী শুনতে গিয়ে আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন। এখানে একটি কথা  বলতে হয় যে, এই ঘোর সংকটময় পরিস্থিতিতে মতিন সাহেবের বড় মেয়ে রাত্রি মুক্তিযোদ্ধা বদিউল আলমের প্রেমে পড়ে। যদিও সেই প্রেমের কথা কেউ জানত না বা সেই সুযোগও ছিল না। কিন্তু তার মা বিষয়টি ঠিক আঁচ করতে পারে। এই কঠিন সময়ের ভেতরেও রাত্রির বদিউল আলমের প্রতি টান পাঠককে বিমুগ্ধ করে। যদি সত্যি সত্যি তাদের মিলন হতো উপন্যাসের শেষে খারাপ হতো না। কিন্তু সেটা হয়নি। বুদ্ধিমান লেখক পাঠকের এই আবেগটুকু ধরে রেখেছেন। মতিন সাহেবের স্ত্রী সুরমা। তিনি অসম্ভব বুদ্ধিমতী একজন মহিলা। ঘটনা দেখেই বলে দিতে পারেন। মেয়ের বদিউল আলমের প্রতি দুর্বলতা যেমন তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, সেভাবেই চিনতে পেরেছিলেন বদিউল আলমকে। তাকে বলতে হয়নি তিনি মুক্তিযোদ্ধা। এই বুদ্ধিমতী মহিলাটিকে মনে হয় কিছুটা ভয় পেতেন মতিন সাহেব! প্রথম বর্ণনায় মনে হবে তিনি বেশ রাগী এবং গম্ভীর ধরনের মানুষ। এরকম একজন উটকো মানুষকে এ সময় আশ্রয় দেওয়া নিয়ে তিনি বেশ বিরক্তও ছিলেন। কারণ ঘরে দুটো মেয়ে রয়েছে। তবে ধীরে ধীরে তিনি বদিউল আলমের সাথে মাতৃত্বসুলভ আচরণ করতে শুরু করেন। উপন্যাসটিতে খুব বেশি চরিত্র নেই। কাহিনির বর্ণনায় চরিত্র আসে। প্রয়োজন হয়নি বলেই আসেনি। সাত জনের দলের আরও কয়েকজনের বর্ণনা এসেছে। কিন্তু তা বদিউল আলমের চিন্তায়। এখানে বদিউল আলমই প্রধান চরিত্র। তার পরের চরিত্রটিতেই রয়েছেন অস্থির ধরনের মতিন সাহেব। গল্পটিতে পুরো ঢাকা শহরের পরিবেশ থমথমে। সবাই যেন কিছু একটা ঘটার অপেক্ষা করছে। এক অথবা হাজার হাজার মৃত্যু দানব চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এরকম এক পরিবেশ বর্ণনা করা হয়েছে। বদিউল আলম গুলি খাওয়ার পরের ঘটনাগুলো আরও বেশি উপন্যাসটি পাঠকের দিকে টানতে থাকে। একদিকে একটি পরিবারের অচেনা আহত মুক্তিযোদ্ধাকে বাঁচানোর আপ্রাণ প্রচেষ্টা এবং অন্যদিকে আশফাক নামের দলের অন্য এক মুক্তিযোদ্ধার মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার পর নির্মম অত্যাচার সত্ত্বেও মুখ না খোলা। কিছুটা আবেগ, কিছুটা বাস্তব এসব কিছুই শেষ পর্যন্ত উপন্যাসটিতে রয়েছে। ঐ রকম একটি রাতে কোনো ডাক্তার পাওয়া যায়নি বদিউল আলমের চিকিৎসার জন্য। এটাই বাস্তব। শেষ পর্যন্ত একটি নতুন সকাল হয়। একটি ভোর।  সেই ভোর দেখার সৌভাগ্য সকলের হয় না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //