ক্রমবর্ধমান অপরাধ এবং সামাজিক অস্থিরতা

দেশে আশঙ্কাজনকভাবে অপরাধের নানা ঘটনা বেড়ে চলেছে। সাম্প্রতিককালে যেসব মারাত্মক ঘটনা ঘটছে এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো খুন, ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পরে হত্যা, একাধিক ব্যক্তির সমন্বয়ে দলীয় নিপীড়ন-নিগ্রহ ইত্যাদি। ফলে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে। আইনের অদৃশ্যমান উপস্থিতি, বিচারকাজে মন্থরগতি, আইন প্রয়োগে শিথিলতা এইসব মিলে দেশ বা সমাজ এখন কঠিনতম সময় পার করছে। 

গত কয়েক বছর ধরে এসব ঘটনা ঘটছে এবং ক্রমেই বেড়ে চলছে বিপজ্জনক হারে। ২০১২ সালে, অর্থাৎ সাত বছর আগে বিশ্বজিতের হত্যার ঘটনা দিয়ে, যতটা মনে পড়ে, এসব ঘটনার শুরু। এর আগে এসব ঘটনা যে ছিল না তা নয়, তবে এত ব্যাপকহারে হত্যা-দ্বন্দ্ব-কলহ-মারধর ইত্যাদির খবর শোনা যেত না। ২৪ বছরের যুবক বিশ্বজিতের অস্বাভাবিক মৃত্যু বা হত্যা স্তম্ভিত করে দিয়েছিল পুরো জাতিকে। বিশ্বজিৎ একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। সে ছাত্র ছিল না, রাজনীতির সঙ্গে কোনো সম্পৃক্ততা ছিল না, কারো সঙ্গে তার ব্যক্তিগত বিরোধের কথাও শোনা যায়নি। সে ছিল পেশায় একজন দর্জি। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোট দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধ ডেকেছিল। বিশ্বজিৎ দাস জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা হেঁটে পার হওয়ার সময় আন্দোলন বিরোধীরা তাকে আঘাত হানা শুরু করে। বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে অনেক মানুষের ভিড়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার দায়ে অভিযুক্ত ৮ জনকে আটক করা হয়। কিন্তু মামলাটি এখনো আপিল বিভাগে নথিভুক্ত ও অমীমাংসিত আছে। হাইকোর্ট এদের মধ্যে দুজনকে মৃত্যুদণ্ড, আর ৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছে। বাকি দুজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। তবে সবাই এখনো পলাতক রয়েছে।

এরপর বিগত কয়েক বছরে এই ধরনের বা এর চেয়েও তীব্র, বুকে শেল বিদ্ধ করা একের পর এক ঘটনা ঘটে চলেছে। এসবের কোনোটা রাজনীতি সংশ্লিষ্ট, কোনটা বা নারীঘটিত ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যা, আবার কোনোটা উচ্ছৃঙ্খল জনতার গণপিটুনি, নিগ্রহ-নিপীড়নের পরে হত্যা। অতি সম্প্রতি (৯ অক্টোবর’ ২০১৯) ঢাকায় বুয়েটের ছাত্র আবরার, বরগুনার রিফাত শরিফ হত্যা, ফেনীর সোনাগাজীতে মাদ্রাসার ছাত্রী নুসরাতকে লাঞ্ছিত ও পুড়িয়ে মারা, তনু হত্যা, সাংবাদিক সাগর-রুনিসহ নানা লোমহর্ষক ঘটনা ঘটেছে রাজধানী ঢাকা ও ঢাকার বাইরে। কিছু কিছু ঘটনা সংঘটিত হয়েছে বেশ কিছু দায়িত্বশীল প্রত্যক্ষদর্শীর সামনেই। এমনকি কোথাও কোথাও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকের সামনেই সংঘটিত হয়েছে। দৈনিক কাগজে অনেক সময় এসব ঘটনা গুরুত্বহীনভাবে পড়ে থাকে ভেতরে বা শেষের পাতার এক কোণে। তাই তেমন চোখে পড়ে না। কিন্তু ইন্টারনেট তথ্যসূত্রে জানা যায়- ঢাকা ছাড়াও কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন, মানিকগঞ্জ, ঝিনাইদহ, যশোর, রংপুর, বগুড়া, ঢাকার ধামরাই, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, বরিশালে, ভোলা, খুলনাসহ দেশের সব এলাকায় চলছে এই ধরনের তাণ্ডবলীলা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ এক সমীক্ষায় বলেছে- ‘গত মাসে প্রতিদিন সারাদেশে কমপক্ষে ৭ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে (সূত্র : ইন্টারনেট)’। এসব মর্মান্তিক ঘটনার এফআরআই হচ্ছে কখনো কখনো, কিন্তু মামলার অগ্রগতি হচ্ছে না। কখনো তদন্ত ও বিচার কাজ সমাধা হচ্ছে; কিন্তু মামলা অমীমাংসিত ও বিচারাধীন থেকে যাচ্ছে। আবার কখনো কখনো তদন্ত শেষ হলেও বাস্তবক্ষেত্রে তার প্রয়োগ হচ্ছে না। কাজেই মুখ থুবড়ে পরে থাকছে নিরীহ সরল সোজা মানুষগুলোর জীবনের অসহায় মর্মান্তিক কাহিনী। আমাদের যন্ত্রণাদগ্ধ হৃদয়ে ‘ভুলে যাবার’ প্রলেপ পড়ছে। শুধু তাদের নিকটাত্মীয়রাই ক্ষতবিক্ষত মন নিয়ে অস্বাভাবিক জীবনযাপন করছে। 

ইংরেজিতে খুব প্রচলিত একটা কথা আছে- Justice delayed, justice denied বা বিলম্বিত বিচারের অর্থই হলো বিচার প্রত্যাখ্যান। গত ২ নভেম্বর ছিল CPRJ এর (Committee to   protect reports of journalists) বার্ষিক প্রতিবেদন উপস্থাপন দিবস। গত বছরের ‘শাস্তি থেকে রেহাই’ (Impunit) শীর্ষক গবেষণা জরিপে CPRJ বলেছে- গত দশ বছরে ক্রাইম রিপোর্টিং এর কারণে প্রায় ৩১৮ জন সাংবাদিক খুন হয়েছে এবং এদের মধ্যে শতকরা ৮৬টি কেসই এখন পর্যন্ত অমীমাংসিত অবস্থায় রয়েছে। সিপিআরজের গবেষণা সমীক্ষা অনুযায়ী সাংবাদিকদের ওপর অপরাধী ও স্বেচ্ছাচারী সংগঠনগুলোর আক্রমণ দিন দিন বাড়ছে। তাই শাস্তি থেকে রেহাই এর (Impunit) রেওয়াজটি বন্ধ করা জরুরি হয়ে পড়েছে, যাতে সাংবাদিক ও তাদের পরিবারেরা তাদের প্রাপ্য সুবিচার পায়। 

তবে শুধু সাংবাদিকরাই আক্রমণের শিকার হচ্ছেন তা নয়, বরং আমাদের দেশসহ বিশ্বব্যাপী ধর্ষণ, হত্যা, নিপীড়ন, নিগ্রহসহ নানারকম অপরাধ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। কেন এরকম হচ্ছে, তা প্রশাসন ও রাজনৈতিক নেতানেত্রীসহ আমাদের সবার গভীরভাবে ভাবা দরকার। বিজ্ঞজনরা এর পেছনে যেসব কারণ উল্লেখ করে থাকেন সেগুলো হলো, এই যে কিছু জনতা একতাবদ্ধ হয়ে একজনের ওপর উপর্যুপরি আক্রমণ করছে, এর প্রধান কারণ হলো সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। এ ছাড়া আইনের প্রতি মানুষের আস্থাহীনতা ও অশ্রদ্ধা; আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ও আইন প্রয়োগে শিথিলতা এবং সম্পদের অসমবণ্টন ইত্যাদি নানা কারণে এসব অপরাধ ঘটছে। এ ছাড়া অন্যান্য আরও যে কারণগুলো আছে তা হলো- মানুষের মধ্যে সমাজ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে এক ধরনের নিরাপত্তাবোধের অভাব, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতিতে জীবন নির্বাহের জন্য তাদের কঠিন সংগ্রাম ও হতাশা। আর এসবের কারণে সমাজে এক ধরনের প্রচণ্ড অস্থিরতা ও নৈরাজ্যের সৃষ্টি হচ্ছে। 

সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধি ও নৈরাজ্যের এতগুলো কারণ উল্লিখিত হলেও যেটা এর প্রধান কারণ বলে সবাই মনে করছেন তা হলো শাস্তি থেকে রেহাই বা ইম্পিউনিটি। প্রকৃতপক্ষে অপরাধ দমনের সবচেয়ে বড় উপায় অপরাধীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান। অন্ততঃপক্ষে কিছু দুর্র্ধর্ষ অপরাধী যদি শাস্তি পায় তাহলে অবশ্যই অপরাধ প্রবণতা কমে আসবে। বহু বছর আগের ঘটনা হলেও কারও ভুলে যাবার কথা নয় ১৯৭৮ সালে সালেহা এবং ১৯৮৯ সালে শারমীন রীমার হৃদয়বিদারক হত্যার ঘটনা। যৌতুকলোভী স্বামী ডাক্তার এহতেশাম উদ্দিন ইকবাল তার নিজের বাড়ির গৃহপরিচারিকার সঙ্গে পরকীয়ায় জড়িয়ে স্ত্রী সালেহাকে হত্যা করে। মাত্র চার মাস তদন্তের পর এই ঘটনার রায় দেওয়া হয়। তবে পুনরায় ময়নাতদন্ত হয় এবং কিছু দেরিতে হলেও প্রকৃত অপরাধীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয় ১৯৮১ সালে। অন্যদিকে স্বনামধন্য ধনী পরিবারের সন্তান মুনির হোসেন তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রী শারমিন রীমাকে হত্যা করে। বিয়ের মাত্র তিন মাসের মাথায় স্বামীর সঙ্গে চট্টগ্রাম বেড়াতে গিয়ে খুন হন শারমিন রিমা। মাত্র একবছরে এই হত্যাকাণ্ডরে বিচার শেষ হয় এবং চার বছর পর ১৯৯৩ সালে মুনিরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। 

এই দুটি বিচারের রায় দ্রুততম সময়ে কার্যকর হওয়ার ফলে মানুষের মনে যেমন ক্ষোভ কমে আসে, তেমনি আইনের প্রতি শ্রদ্ধা বেড়ে যায়। ফলে এ ধরনের অপরাধও অনেকটা কমে এসেছিল। কিন্তু সাম্প্রতিককালের আলোচিত অপরাধমূলক ঘটনাগুলোর বিচারের রায় কার্যকরের কথা সেভাবে শোনাই যায় না। বরং বছরের পর বছর মামলাগুলো ঝুলে থাকে।

হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়ন, নিগ্রহ, গণপিটুনি ইত্যাদি যে কোনো ধরনের অপরাধের কথাই বলি না কেনো- সব অপরাধই সমাজ থেকে নির্মূল করতে হলে কিছু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রয়োজন আছে সমাজ ও জনগণের কল্যাণেই। তাই ইম্পিউনিটি বা শাস্তি থেকে রেহাই-এর সংস্কৃতি থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতেই হবে। তা নাহলে ভবিষ্যতে আমাদের জীবনে নেমে আসবে অন্ধকারের ঘোর ঘনঘটা।

খুরশীদা হক
লেখক, সাংবাদিক।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //