সংসার অতটা জটিল সমীকরণ নয়

নারী ‘অবলা’ এই শব্দটাকে কবে বলেছে খুব জানতে ইচ্ছে করে। নারী আর পুরুষ বিভাজনের তর্ক নয়, বরং বলতে চাই ‘অবলা’ জাতীয় শব্দের সঙ্গে গল্প কবিতায় নারীকে জুড়ে দেওয়ায়, নারীরা দুর্বল এসব ধারণা আমাদের মজ্জাগত হয়ে গেছে। ফলে নারীকে একজন মানুষ হিসেবে দেখবার চেষ্টা হুমড়ি খেয়ে পড়ছে এই একবিংশ শতাব্দীতেও। অন্যদিকে, বিশ্বজুড়েই নারীকে বার বার মাতৃত্বের সঙ্গে জড়িয়ে শক্তির আধার আখ্যা দেয়া হয়। মাতৃত্ব, সে তো স্বর্গীয় অনুভূতি। শুধু ১০ মাস না বরং সন্তানকে গর্ভে ধারণ থেকে শুরু করে, সম্পূর্ণ মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য যে অপরিসীম সাহস, ধৈর্য আর শারীরিক মানসিক শক্তির প্রয়োজন তা বোধহয় একমাত্র নারীর পক্ষেই সম্ভব। কিন্তু এই ‘শক্তির আধার’ শব্দ দুটির বোধ মানুষ সীমিত করে ফেলেছে। নারীর শক্তি যেনো কেবল মাতৃত্বেই সীমাবদ্ধ। আর তাই হয়তো মাতৃত্বের সঙ্গে সম্পৃক্ততাহীন নারীর সব শক্তিশালী অবদান হারায় অস্বীকৃতির অতলে। তা সে শক্তি যতই প্রবল হোক না কেন! বিধাতার সিদ্ধান্তে যেসব নারী মাতৃত্বের অনুভূতি থেকে বঞ্চিত তাকে আরও একধাপ পিছিয়ে দেই আমরা, কারণ আমাদের চোখে কেবল মাতৃত্বই নারীর অন্যতম শক্তি। নারী আর মাতৃত্ব যেন মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ফলে সমাজের প্রচলিত এই সব ধ্যান-ধারণার বিপরীতে মাতৃত্ববঞ্চিত নারীদের ভেতর বিশাল এক অপরাধবোধ তৈরি হয়। কারণ আমাদের বেঁধে দেওয়া অতি উচ্চারিত স্তুতি বাক্য অনুযায়ী তো সে ‘শক্তিহীন’।

সেই ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে, সংসার ভেঙে গেলে তাই সব দোষ ওই নারীর কপালেই জোটে। অথচ বিবাহিত প্রতিটা নারী পুরুষ আর তাদের অভিভাবকরা জানে সংসার কারো একার নয়, দুজনের। তারপরেও কেউ বলে না শুধু নর কিংবা নারীর নয়, সংসার সুখের হয় দুজনের স্বপ্ন, গুণ আর অপারগতার হিসেব মিলিয়ে সমীকরণ টানতে পারার গুণে।

স্কুলের প্রথমদিন। বাবা মায়ের অস্থিরতার শেষ নেই। শত হোক আদরের সন্তান জীবনের এক নতুন অধ্যায় শুরু করছে। সেখানে কত রকম দায়িত্ব আছে। নিজের সন্তানের দোষ গুণ সব বাবা-মাই জানে। তাই কত সতর্ক করে দেয়- ঠিক কোন কোন ব্যবহার স্কুলে করা যাবে না। বন্ধু কীভাবে তৈরি করতে হয়, কেমন করে আর দশটা মানুষের সঙ্গে চলতে হয় ইত্যাদি। প্রথম ক্লাস শুরু হবার আগে থেকেই চলতে থাকে সে শিক্ষা। বিয়েও তো জীবনের আরেক নতুন অধ্যায়। সালাম এবং অভিবাদন জানাই মেয়ের বাবা মায়েদের কারণ, শুধু তারাই তার কন্যা সন্তানকে শেখান কেমন করে জীবনের সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে পা ফেলতে হয়, শিখিয়ে দেন তার দায়-দায়িত্ব। অথচ ছেলেদের শিক্ষা কিন্তু অপূর্ণই থেকে যায়। যদিও বাবা মায়ের কাছ থেকে এই শিক্ষা তারও প্রাপ্য ছিল। বিয়ের আগেই তার জানা উচিত ছিল, সংসার সুখের করবার সমীকরণ টানা কত জটিল। দুজনের দোষ-গুণ আর সর্বোপরি দায়িত্বশীলতার ওপরই নির্ভর করে জটিল সেই সমীকরণ মিলে যাবার ধাঁধা। সাংসারিক দায়িত্ব সম্পর্কে ছেলেদের একেবারে কোনো শিক্ষা না পাওয়াও একদিক থেকে ভালো হতো, যদি সমাজ থেকে পাওয়া কুশিক্ষাটুকু না পেতো। সারাজীবন যে ছেলে মা কে ‘অবলা’ হিসেবে জেনে এসেছে, সে কেমন করে হঠাৎ একজন সবলাকে মেনে নেবে। কে তাকে বলবে রন্ধনশৈলী মেয়েদের গঠনতন্ত্রে লেখা নেই। সে পারে কারণ, সে জানে তাকে পারতে হবে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী, সব মহলে যে ছেলে দেখেছে পুরুষ মানেই সেরা, তার পক্ষে বিয়ের প্রাথমিক মোহ কেটে যাবার পর কিভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নারীও কোনো অংশে কম নয়? 

সে জেনে এসেছে বাবা, দাদা, চাচা সব ক্ষেত্রে পুরুষ মানেই স্বাধীন। তার যে কোনো ইচ্ছাই যথার্থ আর নারীর স্বাধীনতা কেবল হেঁসেলে। সে ছেলে হঠাৎ কেমন করে মেনে নেবে, মেয়েদেরও ইচ্ছে হয় স্বকীয়তার? আর এই চাওয়া কোনো পাপ নয়, বরং নারীর অধিকার। সংসার যে আদতে দুজনের দায়িত্ব, তা তাকে কে বোঝাবে? সংসারের মত জটিল অঙ্ক কি কেবল ‘আর্থিক-উপার্জন’ আর ‘বাদ-বাকি যাবতীয় কাজ’ এই দুই ভাগে বিভাজন করা যায়? এই বিভাজন তো বড্ড বেশি ভারসাম্যহীন। ‘যুগ যুগ ধরে করেছেনা মা খালারা’- এই প্রশ্ন যদি তোলা হয়, তাহলে বলবো ইতিহাসের পাতা খুলে দেখুন। মা খালারা এখন যুদ্ধ শেষে জীবনের শেষকালে এসে সবাইকে সুখী রেখে নিজের সুখকে ভুল গেছে। একদিন যখন তাদের বয়স ছিল, স্বপ্নও ছিল। সমাজের গাঁটবাধুনীতে অন্যের স্বপ্ন পূরণকেই সে নিজের বলে মেনে নিয়েছে এত বছরে। কিন্তু এই যুগে কোনো শিক্ষিত মেয়ে একজন ‘স্বপ্ন-হত্যাকারীর’ জীবনসঙ্গিনী হবার স্বপ্ন দেখে না। অথচ সমীকরণটা খুব একটা জটিল ছিল না। সহজ সুন্দরভাবে দেখলেই কেটে যায় যুগ যুগ ধরে জমানো জঞ্জাল। ‘সংসার’- শব্দটা শুনলেই কানে বাজে তরু আর সুমনের ঘর। একটা ছোট মেয়ে আর একটা ছেলে ওদের। বিয়ের আগেই দুজনে প্রতিজ্ঞা করেছিল সুন্দর একটা ঘরের। যেখানে কাজ শেষে দুজন দুজনকে সময় দেবে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত। সে সময়টা ওরা দেয় দুজন মিলে ঘরের কাজগুলো সারতে সারতেই কিংবা ছেলে-মেয়েদের পড়াবার সময়। কখনো সব কাজ শেষে তাদের ছোট বারান্দায়, হোক না সে ১০ মিনিট কিংবা ঘণ্টা কয়েকের জন্য। সেই ছোটবেলাকার মতো আঙুলে আঙুল ছুয়ে করা প্রতিজ্ঞা তারা ভাঙেনি কখনো। সংসার মানে ওরা বুঝেছিল ‘একটু কম একটু বেশি’, ‘আজ আমি কাল তুমি’- এই মিলিয়ে স্বপ্ন পূরনের ছোট এক যাত্রা। প্রতিজ্ঞা করেছিল অভিমান-রাগ-ক্ষোভ নিজেরাই মিটিয়ে নেবে। কখনোই তৃতীয় পক্ষ জড়াবে না তাদের মাঝে। সংসারের সমীকরণ সরল ছিল না তরুদেরও। কালো মেঘের ছায়া পড়েছে হামেশাই। কিন্তু প্রতিজ্ঞা ভাঙেনি কেউ। রাগ অভিমানের পাহাড় কেটে কখন যে মায়া তাদের আবার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছে ভাবতেই অবাক হয় তরু, সুমন। সংসার মানে এমন কিছুই তো হতে পারতো। অথচ তা কিন্তু হয়নি।

একটা ভয়ংকর তথ্য দেই। ২০১৮ সালের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী সারাদেশে ডিভোর্সের হার গত সাত বছরে ৩৪% বেড়েছে। ঢাকা শহরে মাসে গড়ে ৭৩৬টি, মানে প্রতি ঘণ্টায় ১টি ডিভোর্সের আবেদন পত্র জমা পড়ছে। আনুমানিক যদি একটি/দুটি সন্তান তাদের থাকে, তাহলে ঘণ্টায় ১টি অথবা দুটি শিশু জীবনের সবচেয়ে কঠিন অনিশ্চয়তার সম্মুখীন হচ্ছে। আর এর পরিণতি কতটা ভয়ংকর তা বলাই বাহুল্য। এ তো গেল যেসব পরিবার ডিভোর্সের আবেদনপত্র জমা দেন তাদের কথা। ডিভোর্স তো আর একদিনের কথায় হয় না। বিলম্বিত পারিবারিক বিরোধে অসহায় অনেকেই। সমাজ, সন্তানের অনিশ্চয়তা- এই সব ভেবে ডিভোর্সে যাবার সাহস ও সুযোগ হয় না সবার। তাই বলে দ্বন্দ্বও মিথ্যে হয়ে যায় না। ওই চার দেয়ালের ভেতর প্রতিনিয়ত আশা-বাঁধা আর ভাঙার টানাপোড়নে দম বন্ধ করা এক পরিবেশ তৈরি হয়। আর সেই পরিবেশে আর যাই হোক, সন্তানদের সুস্থ মানসিকতার মানুষ হিসেবে বেড়ে ওঠা অনিশ্চয়তায় পড়ে বৈকি। নিজ সন্তান ছেলে হোক বা মেয়ে, তাদের সুস্থ পরিবেশে বেড়ে ওঠার কথা বাবা-মা দুজনকেই ভাবতে হবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //