বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এক বিপন্ন বিস্ময়

ইউরোপসহ পৃথিবীর নানা অংশে নানা প্রান্তে রাষ্ট্রগুলোর মধ্যকার সীমান্ত প্রাচীর ক্রমে উঠে যেতে থাকলেও এশিয়ার এই অঞ্চলে, বিশেষত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার আন্তঃরাষ্ট্রীয় সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া কেবল বেড়েই চলেছে। ভারত ইতিমধ্যে দুই দেশের মধ্যে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত পথ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘিরে ফেলেছে। 

এর মধ্যে একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে আবার বিদ্যুতায়িত করে রাখা হয়েছে। নদীপথের সীমান্তেও কাঁটাতারসহ নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরির উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সীমান্ত যেখানে অবাধ ও উন্মুক্ত হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সর্বাত্মক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেয়ে, একে অন্যের উন্নয়নে সৎ প্রতিবেশীর ভূমিকা পালন করে চলেছে- সেখানে বাংলাদেশের তিন দিকে বিদ্যুতায়িত কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করে বাংলাদেশকে কার্যত অবরুদ্ধ করে এক ধরনের কারাগারে পরিণত করা হয়েছে। প্রতিবেশী মানবিক বা প্রাকৃতিক কোনো দুর্যোগে পাশের বাড়িতে যে আশ্রয় নেবে, নিরপত্তা খুঁজবে সে সুযোগও অবশিষ্ট নেই।

সীমান্ত রক্ষীবাহিনী বিএসএফসহ ভারতীয় পক্ষের বারংবার অঙ্গিকার সত্ত্বেও তাদের বাংলাদেশিদের হত্যা বন্ধ হয়নি। বিজিবি-বিএসএফ এর মধ্যকার চুক্তি ও সমঝোতা অনুসারে সীমান্তে হত্যা ‘শূন্যতে’ নামিয়ে আনার কথা বলা হলেও বিএসএফ তা রক্ষা করেনি। প্রায় প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো সীমান্তে বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল বাদে পৃথিবীর অন্য কোনো সীমান্তে যুদ্ধ পরিস্থিতি ছাড়া এই ধরনের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জানা যায় না। ধারাবাহিক ঠাণ্ডা মাথার এ সব হত্যাকাণ্ড বন্ধে বিজিবিকে যেমন তৎপর দেখা যায় না, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকেও কার্যকর রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ দৃষ্টিগোচর নয়।

তিস্তার পানিসহ অভিন্ন ৫৪টি নদীর পানিপ্রবাহের ওপর বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা এখনো পর্যন্ত আদায় করা যায়নি। বরং উজানে ভারত অনেক নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে সেচযন্ত্র বসিয়ে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার অব্যাহত রেখেছে। আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান ও প্রতিবেশী বাংলাদেশের আকুতি অগ্রাহ্য করে বলতে গেলে গায়ের জোরেই ভারত বাধ নির্মাণ, আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প, শুকনো মৌসুমে পানি প্রত্যাহার, বর্ষা মৌসুমে অতিরিক্ত পানি বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া প্রভৃতি তৎপরতা চালু রেখেছে। মমতা ব্যানার্জির কথিত বিরোধিতা ও তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সমীকরণে ‘বাংলাদেশ’ ভারতের পানি রাজনীতির অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে।

বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা ছিল শেখ হাসিনার সর্বশেষ দিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে তিস্তার পানিচুক্তিসহ অমীমাংসিত বিষয়ে অগ্রগতি হবে; তা হয়নি। বরং তিস্তার পানি আনার পরিবর্তে উল্টো ভারতকে ফেনী নদীর পানি প্রত্যাহারের চুক্তি করা হল। ১.৮২ কিউসেক পানি খুব বেশি নয় সত্য; কিন্তু এর মধ্য দিয়ে ফেনী নদী থেকে ভারত কর্তৃক অন্যায়ভাবে ৩৫টি পাম্প বসিয়ে অনেক বছর ধরে পানি প্রত্যাহারের গর্হিত কাজকে পরোক্ষভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়।

গেল ৫ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলে ভারতীয় নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে ২০টি পর্যবেক্ষণ রাডার বসানোর চুক্তি ও সমঝোতার বিষয় ভারতীয় গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ না করা হলেও যেটুকু বেরিয়ে এসেছে তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এসব রাডারের নিয়ন্ত্রণ, তার তথ্য-উপাত্ত কি সত্যি সত্যি ভারতীয় নৌবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তাদের কাছ থেকেই কি বাংলাদেশকে তথ্য-উপাত্ত জানতে হবে- ইত্যকার নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ইতিমধ্যে দেখা দিয়েছে। 

জানা গেছে, ইতিপূর্বে ২০১৫ সালে ভারত বাংলাদেশের উপকূলে এই রাডার স্থাপনের প্রস্তাব করেছিল, সরকার তখন এই অঞ্চলে একে ভারতীয় সমরনীতির কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে সে প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। কিন্তু এখন কেনো ভারতীয় নিয়ন্ত্রণে রাডার ব্যবস্থাপনার এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে হলো, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সে ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট ও পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এই চুক্তি বা সমঝোতা এই অঞ্চলে মার্কিন-ভারতের চীনবিরোধী ভূরাজনৈতিক রণনৈতিক বলয়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করার কৌশলগত পদক্ষেপ কিনা সে ব্যাপারেও বাংলাদেশ বা ভারতের কোনো ব্যাখ্যা নেই। তবে ভারতীয় বিভিন্ন গণমাধ্যম যেসব তথ্য ও বিশ্লেষণ হাজির করেছে তা থেকে এটা স্পষ্ট যে, এসব চুক্তি ও সমঝোতা দেশের সার্বভৌমত্ব, জাতীয় স্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তাকে গুরুতরভাবেই বিপন্ন করবে।

বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দর ও মোংলাবন্দর ভারতীয় বাণিজ্যিক পণ্যের ব্যবহারের জন্য অনেক আগেই খুলে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র শুল্কে এখন তাকে আরও সহজ ও সূলভ করে তোলা হয়েছে। ভারতীয় বিনিয়োগ ও পণ্যের জন্য বাংলাদেশ ও তার বাজারকে ক্রমান্বয়ে মুক্ত ও অবাধ করে দেওয়া হচ্ছে। এ কারণে বাংলাদেশ এখন ভারতের রেমিট্যান্স আয়ের দিক থেকে চতুর্থ স্থানে উন্নীত হয়েছে। অথচ একই ধরনের সুযোগ থেকে বাংলাদেশ এখনো বঞ্চিত। ভারতে বাংলাদেশি পণ্য ঢোকার ক্ষেত্রে এখনো শুল্ক ও অশুল্ক নানা বাধা বিদ্যমান। আর এই কারণে বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্যিক ভারসাম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রতিকূলে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ভারতের উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যসমূহে বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত বাণিজ্যেরও বিস্তার ঘটছে না।

উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক বোঝাপড়া ও কূটনৈতিক দর-কষাকষির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের হাতের পাঁচ ছিল ট্রানজিট-করিডোর ইস্যু। অযত্ন, অবহেলা, অদক্ষতা, অপেশাদারী মনোভাব ও সর্বোপরি দেশের স্বার্থ উপেক্ষা করে প্রায় অমীমাংসিত সমস্যাসমূহের সমাধান না করে একতরফাভাবে ভারতের চাহিদামতো তাদেরকে ট্রানজিট-করিডোর সুবিধা প্রদান করা হয়েছে। বন্ধুত্বের পরাকাষ্ঠা দেখাতে যেয়ে তিতাস নদীর ওপর বাঁধ দিয়ে ত্রিপুরার জন্য পণ্য পরিবহনের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। সরকারের এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ট্রানজিট-করিডোরের জন্য ভারতের কাছ থেকে মাশুল চাওয়াকে ‘অবন্ধুসূলভ’ আচরণ হিসাবে আখ্যা দিয়েছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনার পর এখন নামেমাত্র ট্রানজিট শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশ ও তার জনগণ যখন ভারতের প্রতি প্রায় একতরফা বন্ধুত্বের নজীর স্থাপন করে আসছে, তখন ভারতে বাংলাদেশ বিরোধী তৎপরতা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদানের জন্য তাদেরকে ৫০ বছর পরও ফুলেল সংবর্ধনা প্রদান অব্যাহত রেখেছি, যখন তাদেরকে পরম বন্ধু হিসেবে বিবেচনা করে প্রতিবেশীর উষ্ণতা নিয়ে বসবাস করার আকুতি প্রকাশ করি, তখন এই সুযোগে ভারত আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলতে তৎপর। আসামের নাগরিকপুঞ্জি থেকে বাদ পড়া ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করে যেভাবে তারা উত্তেজনা ও সাম্প্রদায়িক প্রচারণা অব্যাহত রেখেছে; এনআরসির নাম করে ভারতীয় নাগরিকদের বাংলাদেশে পুশ ইন করার ঘটনা দেখা যাচ্ছে তা কোনো সৎ প্রতিবেশীর পরিচয় নয়। 

বিজিপির চরম হিন্দুত্ববাদী উগ্রসাম্প্রদায়িক ও বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা বাংলাদেশের জন্য গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যখন বলা হচ্ছে বাংলাদেশ ভারতের বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ শিখরে, তখন রোহিঙ্গা ইস্যুতেও বাংলাদেশ ভারতকে পাশে পায়নি। বরং তাদের ভূমিকা মায়ানমার সরকারের পক্ষেই। দুঃখজনক হলেও সত্য যে ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদি সমাধানে বাংলাদেশ ধারাবাহিকভাবে বলিষ্ঠ ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে পারছে না। 

ভারতের সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক আদালতের দ্বারস্ত হতে হয়েছিল। ছিটমহল সমস্যারও মোটামুটি একটি সমাধান হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে নতুন নতুন বিপদের জালে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। ভারতকে খুশি রাখতে সুন্দরবন বিনাশী রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প অব্যাহত রাখা হয়েছে; রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্পের বর্জ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব ভারতকে দেওয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের এসব দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদি সমাধানের ওপর বাংলাদেশ ও তার জনগণের অস্তিত্ব অনেকাংশে নির্ভরশীল। 

সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের টিকে থাকাও এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত। একটি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে যে রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে, সে রাষ্ট্রের দায় রয়েছে সার্বভৌমত্ব, জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত ও নিরাপদ রাখার। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত এসবের প্রতি উপযুক্ত মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করেনি। বরাবরই বাংলাদেশকে তারা তাদের বাধ্যগত ও অনুগত রাষ্ট্র বানাতে সক্রিয় থেকেছে। এদেশের শাসকশ্রেণি ও সরকারসমূহই এই ক্ষেত্রে তাদের বড় বাহন হিসেবে কাজ করে আসছে। সমতা, ন্যায্যতা, পারস্পরিক স্বাথের্র স্বীকৃতি ও আন্তর্জাতিক বিধি-বিধান অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সমস্যাদির সমাধান না করে এদেশের সরকারগুলো নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক ক্ষমতার পেছনে ভারতের সমর্থন অব্যাহত রাখতে বরাবরই অনুগত ভূমিকা পালন করে আসছে। 

গত এক দশকে এই সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। সরকারের ক্ষমতার পেছনে জনগণের ম্যান্ডেট না থাকায় সাধারণ কূটনৈতিক দরকষাকষির ক্ষমতাও তারা হারিয়ে ফেলেছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ পক্ষের অদক্ষতা, অযোগ্যতা, পেশাদারি প্রস্তুতির অভাব। একারণে ভারতীয় পক্ষের মুসাবিদা করা চুক্তি ও সমঝোতায় স্বাক্ষর করে আসা ছাড়া বস্তুত তাদের আর কিছু করার থাকে না। সরকারের ভারত তোষণ নীতি, জামদানি শাড়ি আর ইলিশ মাছ পাঠানোর কূটনীতি দিয়ে যে আমাদের দ্বিপক্ষীয় ইস্যুসমূহের সমাধান ও বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা ও জাতীয় স্বার্থ নিশ্চিত হবে না তা পরিষ্কার। 

আমরা কেউ আমাদের প্রতিবেশী বদলাতে পারব না। আমরা এদেশের জনগণ আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সমমর্যাদা নিয়ে বসবাস করতে চাই। সে জন্য দরকার বলিষ্ঠ নীতি-কৌশল। বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেমন বলেছেন, ‘ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো’! প্রথমেই দরকার আত্মমর্যাদাহীন আত্মসমপর্ণের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাবের আমূল পরিবর্তন। তা না হলে বাংলাদেশ ও তার জনগণ ভবিষ্যতে আরও গুরুতর সংকটে নিপতিত হতে পারে। আমরা নিশ্চিত এদেশের জনগণ তা হতে দেবে না; এটাই ভরসা।

সাইফুল হক, 
সাধারণ সম্পাদক 
বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //