মণিপুরী ভাষা ও শিক্ষা কার্যক্রম: বাংলাদেশ পরিপ্রেক্ষিত

প্রাক কথন
বাংলাদেশ মাতৃভাষার জন্য আত্মদানের অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী এক দেশ। উনিশ শ’ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন ছিলো বাংলা ভাষাকে তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের আন্দোলন। বস্তুত, একুশের চেতনাই ছিলো কোনো ভাষার প্রভুত্ব নয়, সকল মাতৃভাষাকেই যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠা করা। বায়ান্নের ভাষা আন্দোলনের সেই অনন্য অর্জন ‘ইউনেস্কোর’ স্বীকৃতির মাধ্যমে আমাদের প্রাণের ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ আজ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে পরম শ্রদ্ধায় এবং ভালোবাসায়। এই দিবসের মৌল চেতনাই হলো পৃথিবীর সকল মাতৃভাষাকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে যথাযোগ্য মর্যাদায় এবং সমানভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। এই দায়িত্ব প্রধানত রাষ্ট্র এবং সরকারের। 

বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। তবে বাংলা ছাড়াও এদেশে রয়েছে অনেকগুলো ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর নিজ-নিজ মাতৃভাষা। বাংলা-বাংলাদেশের প্রধানতম ভাষা এবং রাষ্ট্রভাষা-ই শুধু নয়, ভাষা হিসেবে এর উৎকর্ষ এবং অন্তর্গত ঐশ্বর্য ও উজ্জ্বল অবস্থানের কারণে এদেশে পাদপ্রদীপের সমস্ত আলো প্রক্ষেপিত হয়েছে কেবল এই ভাষারই উপর- আর বাকি ভাষাগুলো থেকে গেছে অনুজ্জ্বল অন্ধকারে। আর এভাবে এইসব ভাষা ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার শঙ্কার মুখে পতিত হচ্ছে। এই ক্ষুদ্র ভাষাগুলোর যেমন সাংবিধানিক বা প্রাতিষ্ঠানিক কোনো স্বীকৃতি নেই, তেমনি এই সব ভাষার উন্নয়ন ও বিকাশে রাষ্ট্র বা সরকারের তেমন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগও নেই। যদিও সাম্প্রতিক সময়ে দেশের ক্ষুদ্র ভাষাসমূহের উন্নয়নে বা ঐসব ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে বর্তমান সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করছেন। কিন্তু এগুলো প্রয়োজনের তুলনায় এখনও অপ্রতুল।

বাংলাদেশে প্রধান জাতিসত্তা বাঙালির পাশাপাশি অন্যান্য সংখ্যাস্বল্প যেসব ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী রয়েছে, তাদের অন্যতম মণিপুরী জাতি। নৃতাত্ত্বিক উৎসের বিচারে মঙ্গোলীয় মহাজাতির টিবেটো-বার্মিজ শাখার কুকি-চীন গোষ্ঠীর বলে সাধারণভাবে পরিচিত মণিপুরী জনগোষ্ঠী অভ্যন্তরীণ কলহ ও যুদ্ধ-বিগ্রহজনিত নানা কারণে বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের আদি আবাসস্থল মণিপুর রাজ্য ছেড়ে বাংলার শ্যামল-কোমল প্রান্তরে এসে বসতি স্থাপন শুরু করেছিলো আজ থেকে প্রায় চারশত বৎসর আগে। তবে এতদঞ্চলে ব্যাপকভিত্তিক মণিপুরী বসতিস্থাপনের ঘটনা ঘটে অষ্টাদশ শতকের তৃতীয় দশকে যখন প্রায় সাত বৎসরকাল মণিপুর কার্যত বার্মিজদের শাসনাধীন ছিলো। 

এক সময় ঢাকা, নেত্রকোণা এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মণিপুরী বসতি গড়ে উঠলেও এখন কেবল বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের নানা স্থানেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মণিপুরী জনগণ। মণিপুরী জাতির ভাষার নাম ‘মণিপুরী ভাষা’। বাংলাদেশে মণিপুরী পরিচয়ে তিনটি জনগোষ্ঠী রয়েছে; মৈতৈ বা মূল মণিপুরী জনগোষ্ঠী, মৈতৈপাঙল বা মণিপুরী মুসলিম এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী। মৈতৈপাঙল বা মণিপুরী মুসলিম এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী মণিপুর রাজ্যের আদি বাসিন্দা নন, ইতিহাসের নানা পর্যায়ে নানা কারণে এদের মণিপুরে বসতি স্থাপন। মৈতৈপাঙল বা মণিপুরী মুসলিম জনগোষ্ঠী মিশ্র রক্তধারার এবং তাদের মাতৃভাষা মৈতৈ বা মণিপুরীদের মতো মণিপুরী ভাষা। কিন্তু বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিক উৎসের বিচারে যেমন ইন্দো-এরীয়ান জনগোষ্ঠীর, তেমনি তাদের ভাষাও ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাপরিবারের, মণিপুরী ভাষা থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। আমি আমার এই প্রবন্ধে কেবলমাত্র মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য এবং বাংলাদেশে এই ভাষার অবস্থান ও শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো।

মণিপুরী ভাষা
ভাষাতাত্ত্বিক বিচারে মণিপুরী ভাষা ‘টিবেটো-বার্মিজ’ ভাষাপরিবারের কুকি-চীন গোষ্ঠীর অন্তর্গত বলে পণ্ডিতেরা মনে করেন। মণিপুরী ভাষা নিজেদের মধ্যে ‘মৈতৈলোন’ নামেও পরিচিত। মণিপুরীদের মূলভূমি, এককালের স্বাধীন রাজ্য, বর্তমানে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য- মণিপুরের আইনসভায় পাশকৃত ‌‌'The Manipur Official Language Bill-1979'- এ বলা হয়েছে- 'Manipuri Language means '‌Meitei Lon' written in Bengali script and spoken by the majority of Manipur population.' (Bill No. 10 of 1979)।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বর্তমানে যারা ‘মণিপুরী’ নামে পরিচিত, বা, মণিপুরী ভাষা-সাহিত্য ও সংস্কৃতি বলতে যে ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বুঝানো হয়ে থাকে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধ পর্যন্ত তা মৈতৈ জাতি বা মৈতৈ ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি নামে পরিচিত ছিল। মণিপুর রাজ্যের প্রাচীন নাম ছিলো ‘মৈতৈলৈপাক’। মণিপুরে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক প্রচার ও প্রসারের প্রেক্ষিতে সিলেট থেকে আগত একজন হিন্দু ধর্ম প্রচারক অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মহাভারতোক্ত মণিপুরের প্রসঙ্গ টেনে এনে তখন ‘মৈতৈলৈপাক’ নামে পরিচিত এ রাজ্যের নূতন নামকরণ করেন ‘মণিপুর’। দেশের প্রধান অধিবাসী মৈতৈরা তদনুযায়ী ‘মণিপুরী’ নামে ক্রমশ পরিচিত হয়ে ওঠেন। মণিপুরে ব্রিটিশ আগমন সূচিত হলে ‘মণিপুর’ এবং ‘মণিপুরী’ শব্দগুলো দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরবর্তীতে ১৮৯১ সালে স্বাধীন মণিপুর রাজ্য ব্রিটিশদের সম্পূর্ণ করতলগত হওয়ার পর পুরোপুরিভাবেই ‘মৈতৈ’ শব্দের স্থান গ্রহণ করে ‘মণিপুরী’। তবে এক্ষেত্রে ‘মণিপুরী’ শব্দটি ব্যবহৃত হয় নৃতাত্ত্বিক পরিচিতিসূচক ‘মৈতৈ’ শব্দের সমার্থক শব্দ হিসেবে। 

মণিপুরী ভাষা অত্যন্ত প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। মণিপুরের বিখ্যাত পণ্ডিত ও গবেষক ডব্লিউ য়ুমজাউ সিংহের ভাষায়-  ‌‌'.. All these facts doubtlessly show that Manipuri as a spoken language has been in existence prior to the age of the Epic or at least to the compilation of the Mahabharata as a book. Hence its age is at least 3400 years old.' (Parishad: 1970 : 35)। পণ্ডিতরাজ অতোম্বাপু শর্মা এবং ভাষাচার্য সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও এই অনুমিতিকে সমর্থন করেছেন। (Chatterjee : 1973-74 : 33)। মৈতৈলোন বা মণিপুরী ভাষা হাজার বছর ধরে ভারতের মণিপুর রাজ্যের সরকারি ও রাজ্যভাষা এবং সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ পর্যন্ত শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে প্রচলিত হয়ে এসেছে। এছাড়াও ‘মণিপুরী ভাষা’ মণিপুর বিশ্ববিদ্যালয়, আসাম বিশ্ববিদ্যালয়, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়. গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, নয়াদিল্লীর সাহিত্য একাডেমী এবং মণিপুর, আসাম, দিল্লী, পশ্চিমবঙ্গসহ বিভিন্ন শিক্ষাবোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত। ১৯৭২ সালে ভারতের সাহিত্য একাডেমির স্বীকৃতি প্রাপ্তির পর ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু করে প্রতি বছর মণিপুরী সাহিত্যের নির্বাচিত কোনো গ্রন্থকে একাডেমি পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করা হচ্ছে। আকাশবাণী ইম্ফালসহ আকাশবাণীর বিভিন্ন কেন্দ্রের মণিপুরী অনুষ্ঠানের প্রচারমাধ্যমও মণিপুরী ভাষা তথা এই মৈতৈলোন। বাংলাদেশ বেতার, সিলেট কেন্দ্র থেকেও গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে মৈতৈ লোন বা মণিপুরী ভাষায় মণিপুরী অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। তাছাড়া ১৯৯২ সালে ভারত সরকার মণিপুরী ভাষাকে ভারতীয় সংবিধানের অষ্টম তপশীলে অন্তর্ভূক্তির মাধ্যমে ভারতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন।(The Constitution (78th Amendment) Bill, 1992 (Bill No. 142 of 1992)। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ভারতীয় সংবিধানে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে যে মণিপুরী ভাষাকে ভারতের অন্যতম জাতীয় ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে তা হলো ‘মৈতৈ লোন’ হিসেবে সাধারণভাবে পরিচিত ভারতের মণিপুর রাজ্যের সরকারি ভাষা হিসেবে হাজার বছর ধরে প্রচলিত ‘মণিপুরী ভাষা’। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘মৈতৈ লোন বা ভাষা’ ও ‘মণিপুরী ভাষা’ এক ও অভিন্ন। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় Census of India-1971- এর একটি অংশ এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে- 'Manipuri/Meithei - Both the names refers to one and the same language. Meithei language form a sub-group within the broad Kuki-Chin group of the Tibeto-Burman Sub-family.' (Census of India : 1971 : 160)|। এই প্রসঙ্গে Dr. G. A. Grierson- এর মন্তব্যটিও প্রণিধানযোগ্য- 'The state of Manipur is a very polyglot tract of country. The principal language is Meithei or Manipuri.' (Grierson : 1903 : 419).  বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার লেখক ড. কে পি সিনহাও তাঁর 'The Bishnupriya Manipuri Language' গ্রন্থে বলেছেন, 'The Meitheis call their language `Meitai’ or `Manipuri’. This language being the state language of Manipur, is now called simply `Manipuri'. (Sinha : 1981 : 1)। ভাষাচার্য ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ও অনুরূপ মন্তব্য করেছেন। (Sanajaoba : 1991 : 275)। 

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মণিপুর ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষ করে আসাম এবং ত্রিপুরায়, স্কুল পর্যায়ে মণিপুরী ভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ আছে। সেখানে সেইসব গ্রন্থগুলো ‘মণিপুরী ভাষা’র বই হিসেবেই প্রকাশিত হয়, ‘মৈতৈ মণিপুরী ভাষা’ নয়। আবার ত্রিপুরায় রাজ্য সরকারের উদ্যোগে মণিপুরী ও বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী উভয় ভাষায় একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ‘ত্রিপুরা চে’ (মণিপুরী ভাষার ‘চে’ শব্দটির অর্থ কাগজ) নামের এই পাক্ষিক পত্রিকা সরকারীভাবেই ‘মণিপুরী ভাষা’ ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় পৃথক পৃথকভাবে প্রকাশ করা হয়। উল্লেখ্য, ‘মৈতৈ মণিপুরী ভাষা’য় নয়। কারণ ‘মৈতৈ মণিপুরী’ নামে কোনো ভাষা নেই, এই ভাষার নাম ‘মণিপুরী ভাষা’। 

প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় উল্লেখ করতে চাই যে, ভারতে জাতীয় জনগণনার পাশাপাশি ভাষাভিত্তিক একটি জনগণনার (সেন্সাস) রিপোর্টও প্রকাশিত হয়। ২০১১ সালের ভারতের জাতীয় সেন্সাস রিপোর্টের অংশ হিসেবে প্রকাশিত ভাষাভিত্তিক রিপোর্টে (Paper 1 of 2018, LANGUAGE, Census of India 2011) ‘মণিপুরী ভাষাকে’ ‘টিবেটো-বার্মিজ’ ভাষাপরিবারের অন্তর্গত এবং সংবিধানের ‘এইথ সিড্যুলভুক্ত’ ২২টি ভাষার অন্যতম হিসেবে দেখানো হয়েছে। এই রিপোর্ট অনুযায়ী মণিপুরী ভাষাভাষীর সংখ্যা ভারতে মোট ১৭,৬১,০৭৯ জন এবং এর মধ্যে মণিপুর রাজ্যে এই সংখ্যা ১৫,২২,১৩২ জন। অপরপক্ষে এই সেন্সাস রিপোর্টে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী জনগোষ্ঠীর ভাষাকে ‘বিষ্ণুপুরীয়া’ ভাষা হিসেবে ‘ননসিড্যুলড’ ৯৯টি ভাষার অন্যতম হিসেবে ‘ইন্দো-ইউরোপীয়’ ভাষাপরিবারের অন্তর্গত হিসেবে দেখানো হয়েছে। ‘বিষ্ণুপুরীয়া’ ভাষার আওতায় ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ এবং ‘মণিপুরী বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা’কে দেখানো হয়েছে। রিপোর্ট অনুযায়ী ‘বিষ্ণুপুরীয়া’ ভাষাভাষীর সংখ্যা ভারতে মোট ৭৯,৬৪৬ জন, যার মধ্যে মণিপুর রাজ্যে এই সংখ্যা ১,২৮৮ জন। 

মণিপুরী ভাষার মতোই মণিপুরী সাহিত্যও খুব প্রাচীন। মণিপুরী সাহিত্যের প্রাচীনতম নিদর্শন হিসেবে ধরা হয় ‘ঔগ্রী’কে, যা ৩৩ খ্রিস্টাব্দে মণিপুররাজ পাখংবার সিংহাসনারোহণকালে দেবতার উদ্দেশে নিবেদিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। তবে এটি ছিলো মৌখিক সাহিত্য এবং প্রথম লিখিত সাহিত্যসৃষ্টি হিসেবে যে গ্রন্থের কথা উল্লেখিত হয় তা হলো তৃতীয় শতাব্দীতে রচিত বলে অনুমিত একটি গদ্যগ্রন্থ- ‘পোইরৈতোন খুনথোকপা’। এই গ্রন্থে প্রথম শতাব্দীতে রাজত্বকারী রাজা পাখংবা’র সময়ে মণিপুর উপত্যকার কেন্দ্রবিন্দুতে ক্ষমতা দখলের লড়াই সূচিত হলে পাখংবার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভুত একটি শক্তিশালী দলের প্রধান হিসেবে ‘পোইরৈতোন’-এর আগমন ও বসতিস্থাপনের কাহিনি বিবৃত হয়েছে (Nilkanta : 1982 : 101)। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ পাদে এসে মণিপুরী সাহিত্যের দিগ¦লয়ে সূত্রপাত ঘটে আধুনিকতার- যার পরিপুষ্টি বিংশ শতাব্দীর প্রথম পাদে বাংলা ও ইংরেজী সাহিত্যের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে এসে। বাংলা সাহিত্যের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে লাভ করা নবতর চেতনাবোধ এবং বাংলা সাহিত্যের উন্মুক্ত দরোজা দিয়ে প্রবেশ করা পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রগল্ভ বাতাস মণিপুরী সাহিত্যের আঙ্গিক বৈশিষ্ট্য ও আন্তর-চেতনায় এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সূচিত করে। মণিপুরী সাহিত্যে আধুনিকতার এই উন্মেষকালের প্রধান কবি সাহিত্যিকরা হলেন লমাবম কমল, খ্বাইরাকপম চাউবা এবং হিজম অঙাংহল। এ সময়কালের অন্যতম উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো চৌত্রিশ হাজার পদ সম্বলিত খাম্বা-থোইবীর চিরন্তন প্রেমের মহাকাব্য হিজম অঙাংহল-এর ‘খাম্বা-থোইবী শৈরেং’। 

মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য সময়ের সাথে যথেষ্ট উৎকর্ষ অর্জন করেছে এবং পূর্ব-ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষা ও সাহিত্য হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছে। ভাষাচার্য ড. সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়- 'Among the various Tibeto-Burman languages, the most important in literature certainly of much greater importance than Newari is the Meithei or Manipuri language. ... Manipur had quite a separate alphabet of its own which is found in old manuscripts. The beginning of this old Manipuri literature may go back to 1500 or 2000 years.'(Khelchandra Singh, N; `Early Manipuri Poetry' published in `MANIPUR PAST AND PRESENT'; Vol-2, Edited by Prof. Naorem Sanajaoba; New Delhi 1991)। তিনি অন্যত্র বলেছেন, 'The Meitheis or Manipuris are the most advanced section of the Kuki-Chin people.' (Chatterjee : 1951 : 77)। আর ইতিহাসবিদ প্রফেসার জ্যোতির্ময় রায়ের মতে মণিপুরী সাহিত্য বর্তমানে দ্রুত বিকাশমান এবং পূর্ব-ভারতে এর স্থান তৃতীয়- বাংলা এবং অসমীয়ার পরেই (Chatterjee :1973 : 1)।

স্বকীয় সাহিত্যেই শুধু নয়, অনুবাদের ক্ষেত্রেও মণিপুরী সাহিত্য যথেষ্ট সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। মণিপুরী ভাষায় অনূদিত হয়েছে রামায়ণ, মহাভারতের মতো কালজয়ী সাহিত্যকর্ম; মেঘদূত, ইলিয়াড, ওডেসীর মতো ক্লাসিক সাহিত্য; ঋগে¦দ, বিভিন্ন পুরাণ, শ্রীমদ্ভগবতগীতা, উজ্জ্বল নীলমনি, ভক্তি রসামৃত, মনু সংহিতা, বাইবেলসহ বিভিন্ন ধর্মের বিখ্যাত গ্রন্থাবলি; কালিদাস, ভাস, ভবভুতি, বাণভট্টসহ প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যিকবৃন্দ এবং রবীন্দ্রনাথ, শেক্সপীয়ার, টলস্টয়, হোমার, বার্নাড শ’, সোফোক্লিস, বঙ্কিম, শরৎসহ বিশ্ব-সাহিত্যের মহৎ রূপকারদের অনন্য সব সাহিত্যকর্ম। বঙ্কিমচন্দ্রের সকল উপন্যাস এবং শরৎচন্দ্রের প্রায় সমগ্র রচনাবলিই অনূদিত হয়েছে মণিপুরী ভাষায়। মণিপুরী সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য অনেক সৃষ্টিকর্মও আজ অনূদিত হয়েছে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায়।

মণিপুরী লিপি
মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপিপদ্ধতি আছে। খ্রিস্টিয় প্রথম শতকে মণিপুররাজ পাখংবা এই লিপির উদ্ভাবন করেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ মেলে। তখন এর সংখ্যা ছিলো ১৮। পরে সপ্তদশ শতাব্দীতে মহারাজা খাগেম্বা কর্তৃক উচ্চারণকে অধিকতর প্রমিত করার লক্ষ্যে গুরু উচ্চারণের আরও ৯টি বর্ণ সংযোজন করা হয়। ফলে, মণিপুরী লিপির মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ২৭ টি। এছাড়া আছে ৮ টি হসন্ত বর্ণ এবং ৮ টি অক্ষরচিহ্ন বা - কার। মণিপুরী বর্ণমালায় স্বরবর্ণ এবং ব্যঞ্জনবর্ণের আলাদা কোনো বিভাজন নেই। তবে বর্ণমালায় ৩টি বর্ণ আছে, যা স্বরধ্বনি হিসেবে গৃহীত। বাকি স্বরধ্বনিগুলো ‘A’ বা অতিয়া (অ) বর্ণের সাথে বিভিন্ন অক্ষরচিহ্ন যুক্ত করে তৈরি করা হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে মহারাজ গরীবনেওয়াজের শাসনামলে মণিপুরে হিন্দু ধর্মের ব্যাপক বিস্তৃতি লাভের প্রেক্ষাপটে ধর্মপ্রচারকের পরামর্শে রাজা হিন্দু ধর্মকে মণিপুরের রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে ঘোষণা দেন এবং প্রাচীন ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি ও উপাসনালয় যেমন ধ্বংস করেন, তেমনি মণিপুরী লিপিতে রচিত প্রাচীন প্রায় সমস্ত গ্রন্থাবলি জড়ো করে ভস্মীভুত করেন। 

পরবর্তীতে অষ্টাদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে মহারাজ ভাগ্যচন্দ্রের শাসনামলে বাংলা অঞ্চল থেকে আগত চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণব ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থাবলি, যা বাংলা ভাষায় রচিত, সেগুলোর সাথে অধিকতর নৈকট্য সৃষ্টির প্রয়োজনে মণিপুরী লিপির পরিবর্তে বাংলা লিপিতে মণিপুরী ভাষা লিখার পদ্ধতি প্রচলিত হয় এবং ক্রমশ তা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সেই থেকেই মণিপুরী ভাষা বাংলা লিপিতেই লিখিত হয়ে আসছে। অবশ্য বর্তমানে আবার মণিপুরে প্রাচীন মণিপুরী লিপি পুনঃপ্রবর্তন করা হয়েছে এবং মূল মণিপুরী লিপিতে লিখিত পাঠ্যবই দিয়ে স্কুল এবং কলেজে পাঠদান করা হচ্ছে। আগামী এক বা দেড় দশকের মধ্যে মণিপুরে বাংলা লিপির ব্যবহার বন্ধ করে মণিপুরী লিপি পরিপূর্ণভাবে চালু করা হবে বলে অনুমিত হচ্ছে। প্রচুর বিতর্ক সত্ত্বেও সাধারণভাবে বিশ্বাস করা হয়ে থাকে যে, মণিপুরী লিপি ব্রাহ্মী লিপি থেকে উদ্ভূত। মণিপুরী বর্ণমালার অনুপম বৈশিষ্ট্য হলো এর প্রতিটি মূল বর্ণের নামকরণ করা হয়েছে মানব দেহের এক-একটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে। যেমন, মণিপুরী বর্ণমালার প্রথম বর্ণ হলো ‘কোক’, যার অর্থ ‘মাথা’। এই বর্ণের বাংলা প্রতিবর্ণ হলো ‘ক’ এবং শব্দে যখন ব্যবহৃত হয় তখন এর উচ্চারণ হয় বাংলা ‘ক’ বর্ণের মতো। মণিপুরী বর্ণমালার দ্বিতীয় বর্ণ ‘সম’, যার অর্থ ‘চুল’; এর বাংলা প্রতিবর্ণ ‘স’ এবং শব্দে ব্যবহারের সময় এর উচ্চারণ হয় বাংলা ‘স’এর মতো। একইভাবে মণিপুরী বর্ণমালার পরবর্তী বর্ণগুলো হলো- ‘লাই’ অর্থাৎ ‘ললাট’, ‘মিৎ’ অর্থাৎ ‘চক্ষু’ ইত্যাদি। মানব দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের নামানুসারে মণিপুরী বর্ণমালার নামকরণ এক অনন্য নিদর্শন এবং সম্ভবত পৃথিবীতে নজিরবিহীন।

মণিপুরী লিপির মূল বর্ণগুলো নিম্নরুপ: 
k (কোক- ক), s (সম- স), l (লাই- ল), m (মিৎ- ম), p (পা- প), n (না- ন), c (চীল- চ), k (খৌ- খ), XZ (ঙৌ- ঙ), t (থৌ- থ), w (ওয়াই- ওয়া), y (য়াঙ- য়), h (হুক- হ), U (ঊন- উ/ঊ), I (ঈ- ই/ঈ), f (ফম - ফ), A (অতিয়া- অ)।

পরবর্তীতে সংযোজিত গুরু উচ্চারণের ৯টি বর্ণ:
g (গোক- গ), j (ঝম- ঝ), r (রাই- র), b (বা- ব),  j (জিল- জ),  d  (দিল- দ),  G (ঘৌ- ঘ),  D (ধৌ- ধ),  B (ভম- ভ)।

বাংলাদেশে মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য
বাংলাদেশে মণিপুরী বসতিস্থাপনের ব্যাপ্তিকাল প্রায় চারশত বৎসরের। কিন্তু অভিবাসনের পর দীর্ঘদিন তাদেরকে নতুন পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নেয়ার সংগ্রামে ব্যাপৃত থাকতে হয়েছে। তাছাড়া যে সময়ে মণিপুরী জনগোষ্ঠীর এদেশে অভিবাসনপ্রক্রিয়া শুরু হয় তখন মণিপুরের রাজনৈতিক আবহে ছিলো এক অস্থিরতার করাল ছায়া আর মণিপুরী সাহিত্যে এক স্থবিরতার কাল। ফলে নতুন অভিবাসিত জনগোষ্ঠী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হিসেবে সংস্কৃতি বিশেষত সংগীত ও নৃত্যের নানা উপচার সাথে করে নিয়ে এলেও সেখানে সাহিত্যের তেমন কোনো উপকরণ ছিলো না। সংগীত ও নৃত্য ধর্মীয় অনুষঙ্গ হিসেবে জীবনের সাথে গভীর সম্পৃক্তির কারণে এগুলোর চর্চা অব্যাহত থাকলেও সাহিত্য সৃষ্টির মতো ঘটনা তেমন ঘটেনি; কারণ, সাহিত্যের সৃজন-স্বপ্নের জন্য যে শান্তি ও সুস্থিতির আবহ থাকা প্রয়োজন তা এদেশে অভিবাসিত মণিপুরীদের জীবনে দীর্ঘদিন ছিল না। ঊনিশ শ’ একাত্তর সালের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ মণিপুরী সমাজমানসে এক প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করে। ফলে স্থবির-বন্ধ্যার সময় কেটে গিয়ে মণিপুরী জীবনে আসে সৃজন-স্বপ্নের কাল।

মণিপুরী ভাষায় শিক্ষালাভের সুযোগ না থাকা এবং নিয়মিত চর্চার অভাবে এই ভাষা ক্রমশ হারিয়ে যাওয়ার এক শঙ্কার মুখে ১৯৭৫ সালে গঠিত হয় ‘বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ’ এবং প্রকাশিত হয় সংসদের মুখপত্র ‘দীপান্বিতা’। ‘দীপান্বিতা’ পরে ‘মৈরা’ নাম গ্রহণ করে এখনও তার প্রকাশনার ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখেছে এবং এযাবৎ প্রকাশিত হয়েছে মৈরার ৫৫টি সংখ্যা। মৈরা ছাড়াও এখন পর্যন্ত শজিবু, শায়োন, ইথিল, ইপোম, ইঙ্খোল, খোল্লাও, ইচেলসহ ৬৫টিরও অধিক সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া প্রকাশিত হয়েছে মণিপুরী ভাষার কাব্যগ্রন্থ, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, ভ্রমণকাহিনিসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রায় ৫০টি গ্রন্থ। এছাড়া বাংলাদেশের মণিপুরী লেখকেরা দ্বিতীয় মাতৃভাষা বাংলায়ও সাহিত্য চর্চা করে থাকেন। ইতোমধ্যে বাংলা ভাষায় লিখা তাদের কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও ভ্রমণকাহিনি মিলিয়ে মোট ৩৯টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। 

বাংলাদেশে মণিপুরী ভাষা চর্চা ও শিক্ষা কার্যক্রম
পারিবারিক ও নির্ধারিত সামাজিক পরিমণ্ডলের ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হওয়া ছাড়া বাংলাদেশে মণিপুরী ভাষার প্রায়োগিক ক্ষেত্র যেমন নেই, তেমনি নেই এর প্রাতিষ্ঠানিক চর্চা ও শিক্ষালাভের কোনো সুযোগ। ‘বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ’ গঠন এবং সংসদের উদ্যোগে সাহিত্য সংকলন ও গ্রন্থ প্রকাশ এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে মণিপুরী ভাষা ও সাহিত্য চর্চার একটি ক্ষেত্র সৃষ্টি হলেও নতুন প্রজন্মের মধ্যে মাতৃভাষা মণিপুরীর প্রতি যথাযথ অনুরাগ সৃষ্টি করা যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি তাদেরকে এর পঠন ও লিখনচর্চায় আগ্রহী করে তোলা সম্ভব হয়নি। সেই প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ মণিপুরী সাহিত্য সংসদ ২০০৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ‘মণিপুরী ভাষা উৎসব’ শিরোনামে একটি কর্মসূচি চালু করে, যার আওতায় ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের মধ্যে মণিপুরী ভাষায় রচিত একটি পুস্তিকা সরবরাহ করে নির্ধারিত দিনে সেই পুস্তিকার ওপর ভিত্তি করে লিখিত পরীক্ষা নেয়া হয়। পুস্তিকায় মণিপুরী লিপিও সংযোজিত হয়। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রণোদনা সৃষ্টির লক্ষ্যে পরীক্ষায় কৃতকার্যদের মধ্য থেকে বেশ ক’জনকে বই এবং নগদ অর্থ পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। এই কার্যক্রম এখনও চালু আছে এবং এর ফলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মণিপুরী লিপিসহ মণিপুরী ভাষা লিখা ও পড়ার সক্ষমতা গড়ে উঠছে। 

এছাড়া মণিপুর রাজ্যে মণিপুরী বর্ণমালা চালুর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশেও এর চর্চা ও শিক্ষা শুরুর লক্ষ্যে ‘মণিপুরী ভাষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’ ২০১২ সাল থেকে মণিপুরের সাথে সাযুজ্য রেখে মণিপুরী লিপি শিক্ষার গ্রন্থ প্রণয়নপূর্বক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে অনিয়মিত স্কুল পরিচালনার মাধ্যমে প্রাথমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে মণিপুরী লিপি ও ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। মণিপুরী অধ্যুষিত বিভিন্ন অঞ্চলে সংস্থাটি এরকম সাতটি স্কুল পরিচালনা করছে। তাছাড়া ‘এথনিক কমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট ওর্গেনাইজেশন (একডো)’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাও এরকম তিনটি স্কুল পরিচালনা করছে। এর ফলে ইতোমধ্যে আমাদের শিশু-শিক্ষার্থীদের অধিকাংশকেই মণিপুরী লিপি ও ভাষা শিক্ষার এই কার্যক্রমের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। মণিপুরী ভাষাভাষী প্রাথমিক শিক্ষক আছেন প্রায় ১৮০ জন। এদের মধ্যে অধিকাংশকেও মণিপুরী লিপি ও ভাষার ওপর সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

২০১০ সালের জাতীয় শিক্ষানীতির আলোকে সরকার দেশের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষায় প্রাথমিক পর্যায়ে সংশ্লিষ্ট শিশুদের শিক্ষাদানের কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন। প্রথম ধাপের ভাষা নির্বাচন এবং তা কার্যকর হওয়ার পর সম্প্রতি দ্বিতীয় ধাপে দেশের আরো ছয়টি ভাষাকে এই কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ‘এমএলই’ গ্রুপ সুপারিশ করেছেন বলে জানা গেছে। দ্বিতীয় ধাপে আরও কয়েকটি ভাষার সাথে মণিপুরীদের মধ্যে প্রচলিত দুইটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে ‘মৈতৈ মণিপুরী ভাষা’ ও ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা’য় পাঠ্যবই প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়েছে। আমরা এই উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তবে এখানে মণিপুরী ভাষার নাম ভুলভাবে উপস্থাপিত হয়েছে ‘মৈতৈ মণিপুরী ভাষা’ নামে। 

আমি আগেই উল্লেখ করেছি যে, মণিপুরীদের ভাষার নাম হবে ‘মণিপুরী ভাষা’। আসলে, ‘মৈতৈ মণিপুরী ভাষা’ বলে কোনো ভাষা নেই। ‘মণিপুরী ভাষা’ই মৈতৈ বা মণিপুরীরা নিজেদের মধ্যে ‘মৈতৈলোন’ বা মৈতৈ ভাষা বলেও উল্লেখ করে থাকেন। এখানে ‘মৈতৈ’ ও ‘মণিপুরী’ শব্দ দুটি সমার্থক। আমরা জানি, ভাষা আন্তর্জাতিক; স্থান বা দেশেভেদে ভাষার নাম পরিবর্তিত হয়ে যায় না। আরেকটি বিষয় হলো, মণিপুরী ভাষার নিজস্ব লিপি আছে এবং এই লিপিতে লিখিত বই দিয়ে মণিপুর রাজ্যে স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আমরা চাই, বাংলাদেশেও যখন নতুনভাবে এই ভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম শুরুর প্রক্রিয়া চলছে, সেখানেও নিজস্ব লিপিতেই মণিপুরী ভাষা লিখা হোক এবং শিশুদের মধ্যে সঠিকভাবে পাঠদান শুরু হোক। উল্লেখ্য, এই কার্যক্রম শুরু করা এবং পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতা করতে আমরা প্রস্তুত।

মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়ে অনন্য ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রিয় এই বাংলাদেশে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীসমূহের মাতৃভাষায় শিক্ষা কার্যক্রম গ্রহণের যে মহতী উদ্যোগ সরকার শুরু করেছেন তা সঠিক এবং শুদ্ধরূপে পরিচালনার মাধ্যমে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের অনন্য ভাবমূর্তি আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠুক, ভাষার এই গৌরবমণ্ডিত মাসে সেটাই আমাদের একান্ত কামনা।

ঢাকা, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২০

তথ্যপঞ্জি:
1. The Manipur Official Language Bill-1979 (Bill No. 10 of 1979); Imphal, 12th April 1979.
2. Parishad. Manipuri Sahitya; Glimpses of Manipuri Language, Literature and Culture; Imphal, 1970.
3. Chatterjee, Dr. S.K; Souvenir of Cultural Conference of Eastern India; 1973-74.
4. The Constitution 78th Amendment Bill 1992 (Bill No 142 of 1992); Delhi, 20th August 1992.
5. Census of India - 1971; Monograph 10, R. C. Nigam; New Delhi 1972.
6. Grierson, Dr. G. A.; The Linguistic Survey of India; Vol-1, Part-1, 1903.
7. Sinha, Dr. K.P.; The Bishnupriya Manipuri Language; Calcutta, 1981.
8. Sanajaoba, Naorem; Manipur : Past and Present; Vol-2; Delhi, 1991.
9. Nilkanta Singh, Padmashree; Aspects of Indian Culture; Imphal 1982. 
10. Khelchandra Singh, N; `Early Manipuri Poetry' published in `MANIPUR PAST AND PRESENT'; Vol-2, Edited by
Prof. Naorem Sanajaoba; New Delhi 1991.
11. Dr. S. K. Chatterjee; Kirata-Jana-Kirti; Calcutta 1951.
12. Jyotirmoy Roy, Prof.; History of Manipur; Imphal 1973 (2nd Ed), P-1.
13. Census of India 2011; Paper 1 of 2018; LANGUAGE, India, States and Union Territories (Table C-16); Office of the Registrar General, India, New Delhi.


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //