ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষা ও বর্ণমালার বর্তমান অবস্থা

বাংলাদেশে সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজস্ব মাতৃভাষা থাকলেও অনেকেরই লেখ্য লিপি নেই। চাকমা, মারমা, রাখাইন, ত্রিপুরা, মৈতৈ মণিপুরী, সাঁওতাল, ম্রো, বর্মণ-ক্ষত্রিয় ক্ষুদ্র জাতিসত্তার নিজস্ব বর্ণমালা রয়েছে। এ ছাড়া মান্দি, লেঙাম, কোচ ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের ভেতর বেশকিছু বর্ণমালা দীর্ঘদিন ধরে প্রস্তাবিত হয়ে আছে। খাসি, মান্দি, মাহালী, বম, খুমী এবং সাঁওতালদের খ্রিষ্টীয় মিশন প্রভাবিত পক্ষ রোমান হরফকে নিজেদের মত পরিবর্তন করে ব্যবহার করছেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী, কোল, হাজং, সাঁওতাল, মুন্ডা, ওঁরাও ক্ষুদ্র জাতিসত্তারা বাংলা হরফেই মাতৃভাষার চর্চা করছেন। রাষ্ট্রে সব ভাষা ও বর্ণমালারই সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি পাওয়ার ন্যায্যহিস্যা আছে। 

জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ ক্ষুদ্র জাতিসত্তা শিশুদের মাতৃভাষা শিক্ষার অধিকারের বিষয়টি প্রথম রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান আইন ২০১০- এ সব ক্ষুদ্র জাতিসত্তা জাতির ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণের কথা স্বীকার করেছে। উক্ত আইনের ৯নং অনুচ্ছেদে ‘সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে বসবাসরত প্রত্যেক ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা ভাষা, সাহিত্য, সংগীত, নৃত্য, কারুশিল্প, ধর্ম, আচার-অনুষ্ঠান, রীতিনীতি, সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ, সংরক্ষণ এবং গবেষণা কর্মসূচি পরিচালনা করা’ উল্লেখ রয়েছে। ২০১২ সনে চাকমা, মারমা, সাঁওতাল, মান্দি, ত্রিপুরা ও ওঁরাও ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের একটি রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ তৈরি হয়। চাকমাদের জন্য চাঙমা বর্ণমালা, মারমাদের জন্য মারমা, ত্রিপুরা ও মান্দিদের জন্য পরিবর্তিত রোমান এবং মুন্ডা-ওঁরাওসহ সাদ্রীভাষী ক্ষুদ্র জাতিসত্তাদের জন্য বাংলা হরফ ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। দুঃখজনকভাবে বাংলা না রোমান এ বিতর্কে সাঁওতালি ভাষা বিষয়ে সিদ্ধান্তটি থমকে যায়। ২০১৭ সনের জানুয়ারি মাসে পূর্বউল্লিখিত ক্ষুদ্র জাতিসত্তাগুলোর মাতৃভাষায় প্রকাশিত প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ের বইগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের শিশুদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। যদিও পার্বত্য চট্টগ্রাম ব্যতীত সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিশুরা এখনও এই পাঠ্যপুস্তকের সন্ধান পায়নি। কেবল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মাতৃভাষা ও বর্ণমালায় প্রাক-প্রাথমিক বই প্রকাশ হলেই হবে না, বই প্রতিটি শিশুর নাগালে পৌঁছাতে হবে। বই পড়বার জন্য উপযুক্ত শিক্ষক ও নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন থাকতে হবে। মাতৃভাষা ও বর্ণমালা টিকে থাকবার আরও হাজারো তর্ক ও বাহাসে না গিয়ে চলতি লেখায় খুব সংক্ষেপে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার ভাষাসমূহের বর্ণমালা চর্চার পরিস্থিতিটি বোঝার চেষ্টা করা হবে। 

চাকমা : চাকমা জাতির চাঙমা বর্ণমালা নিজেদের মধ্যে কিছুটা প্রচলিত আছে। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। ঐতিহ্যবাহী চাকমা চিকিৎসাশাস্ত্র ‘চাকমা তালিক’ সম্পূর্ণই চাঙমা ভাষা ও বর্ণমালায় লিখিত।

মারমা (ম্রাইনমা) : এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে মারমা ভাষা কিছুটা প্রচলিত আছে। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। মারমা বৈদ্যরা মারমা বর্ণমালায় রচিত পুস্তক ব্যবহার করেন। খ্যাং বা বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে অনেকেই এ ভাষার ব্যবহার করেন। এ ছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মারমা সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

রাখাইন : রাখাইন ভাষার বর্ণমালার নাম রাখাইন অ্যাক্ষারা। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছুটা এ ভাষার প্রচলন আছে। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় রাখাইন সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

ত্রিপুরা : ত্রিপুরাদের ককবরক ভাষার বর্ণমালা ককবরকনি বাথাই জনগোষ্ঠীর মধ্যে খুব বেশি প্রচলিত নয়। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় ত্রিপুরা সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

মান্দি (গারো) : মান্দিদের আ.চিক ভাষার বর্ণমালা ‘আ.চিক থোকবিরিম’ এই পর্যন্ত মোট চারটি বর্ণমালা প্রস্তাবিত আকারে প্রকাশিত হয়েছে। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এখন পর্যন্ত এ ভাষা প্রচলিত নয়। তবে কেউ কেউ বর্ণমালা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করছেন। কিন্তু মান্দিদের মধ্যে রোমান হরফ নিজেদের মতো কিছু পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খ্রিষ্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোর। বাইবেল, উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মান্দি সাহিত্য চর্চা ও রচিত হয়ে আসছে। 

মৈতৈ মণিপুরী : মৈতৈ মণিপুরীদের মৈতৈ লোনের (মৈতৈ মণিপুরীদের ভাষা) বর্ণমালা মৈতৈ মেয়েক জনগোষ্ঠীর মধ্যে অল্প বিস্তর প্রচলিত রয়েছে। বেশকিছু বইপুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাছাড়া বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালায় মৈতৈ সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে। 

ম্রো : ক্রামা ধর্মের প্রবর্তক মেনলে ম্রো ম্রোচেট নামের ম্রো ভাষার বর্ণমালা উদ্ভাবন করেছেন। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে বর্ণমালা প্রচলিত হচ্ছে। ক্রামা ধর্মের বইপুস্তক এ ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। বর্ণমালা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে।

বর্মণ-ক্ষত্রিয় : বর্মণদের ঠার ভাষার নাগরী বর্ণমালা এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে পূর্বে প্রচলিত থাকলেও এখন আর তেমন দেখা যায় না। পুরনো বেশকিছু হাতে লেখা নথিপত্র রয়েছে এই বর্ণমালায় লেখা। এ পর্যন্ত বাংলা বর্ণমালাতেই বর্মণ সাহিত্য রচিত হয়ে আসছে।

অলচিকি : ১৯২৫ সনে পণ্ডিত রঘুনাথ মুরমু কর্তৃক উদ্ভাবিত সাঁওতালি ভাষার বর্ণমালা অলচিকি ভারতে রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেলেও বাংলাদেশে এখনো প্রচলিত হয়নি। অলচিকি বর্ণমালায় বেশকিছু পুস্তক ও বর্ণমালার বই প্রকাশিত হয়েছে। 

বম : রোমান হরফ নিজেদের মতো পরিবর্তন করে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোতে। উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই ও পরিবর্তিত বর্ণমালার বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত হয়েছে।

খাসি : রোমান হরফ নিজেদের মত পরিবর্তন করে ‘আ-বি-কে’ নামের বর্ণমালাটি নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করতে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মীয় মিশনারিগুলোর। বাইবেল, উপাসনাগ্রন্থ, প্রার্থনা সংগীতের বই ও পরিবর্তিত বর্ণমালার বই সেই পরিবর্তিত রোমান হরফে প্রকাশিত। ভারতের মেঘালয়ে পরিবর্তিত রোমান বর্ণমালায় ‘মাওফর’ নামে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়।

কোচ : বাংলা হরফ ব্যবহার করে মাতৃভাষা শিক্ষার বই প্রকাশিত হয়েছে। সাহিত্য ও সংগীতচর্চা চলছে বাংলা হরফেই। উচ্চারণের সুবিধার্থে ভারতে বাংলা হরফে আরও কিছু সংযোজন ঘটেছে।

হাজং : আসাম ও বাংলাদেশ উভয়প্রান্তে বাংলা হরফকে ব্যবহার করেই বেশ কিছু হাজং প্রকাশনা রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সাহিত্য চর্চা ও লেখালেখি চলছে বাংলা বর্ণমালায়।

বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী : বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করেই দীর্ঘ সময়ের সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন চলছে। ভারতের আসাম রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য শহীদ হয়েছেন সুদেষ্ণা সিংহ। 

কোল : বাংলা হরফ ব্যবহার করে রাজশাহী অঞ্চলে ছোট পরিসরে কোলদের ভেতর প্রাক-প্রাথমিক পর্যায়ে কোল ভাষা শিক্ষা কার্যক্রম বেসরকারি উদ্যোগে কিছুটা চলছে।

স্মরণে রাখা জরুরি বাংলা ভাষার জন্যে কেবল বাঙালি নয়, দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তা জনগণেরও রক্ত-ঘাম ঝরেছে। ভিন্ন ভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ভাষাগুলোর অজস্র শব্দ ও ব্যঞ্জনা নিয়ে হাজার বছর ধরে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বাংলা ভাষা। সাঁওতালি ভাষা ও অলচিকি বর্ণমালার সাংবিধানিক স্বীকৃতির জন্য ভারতে সংগঠিত হয়েছে দীর্ঘ গণসংগ্রাম। ক্ষুদ্র জাতিসত্তা জনগণের বর্ণমালার স্বীকৃতির প্রশ্নে আজ জেগে ওঠুক বাংলাদেশের সব গ্রাম। এখানে নিশ্চুপতা মানে মাতৃভাষা দ্রোহের সঙ্গে অবিচার।

পাভেল পার্থ

গবেষক ও লেখক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //