মহামারি করোনাভাইরাস প্রতিরোধে প্রধানমন্ত্রীর কাছে খোলা চিঠি

পরিস্থিতি সম্পর্কে শ্বেতপত্র এবং মহামারি মোকাবেলায় সমন্বিত কার্যকর ব্যবস্থা চাই

কোভিড-১৯ ভাইরাস অতি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ার মধ্য দিয়ে তা বৈশ্বিক মহামারিতে রূপ নিয়েছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মাপকাঠিতে করোনা সংক্রমণের যে চারটি স্তরের কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ এর তৃতীয় স্তরে প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ দেশের ভেতরেই এই রোগ কমিউনিটি সংক্রমণের পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চতুর্থ স্তরটি হলো, ব্যাপক সংক্রমণ এবং ব্যাপক মৃত্যু। চীন, ইরান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি থেকে আমরা পরিষ্কার ধারণা করতে পারি যে, কীভাবে অতি দ্রুত জ্যামিতিক গতিতে এই মহামারি দাবানলের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে। 

এই বৈশ্বিক ভয়ংকর মহামারির সময়ে দেশের হাসপাতাল, চিকিৎসালয় এবং জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার বিরাজমান দুর্বলতা ও প্রস্তুতিহীনতা অনুধাবন করে দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

উদ্বিগ্ন নাগরিক হিসেবে সরকারের প্রতি আমাদের আরো আশু দাবি হচ্ছে- 

১. অবিলম্বে শ্বেতপত্রের মাধ্যমে করোনা মহামারি রোধের পরিকল্পনা ও তা কার্যকর প্রণালি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে হবে। ঢাকাসহ প্রতিটি জেলা- উপজেলায় কতজন স্বাস্থ্যকর্মী আছেন এবং তাদের সুরক্ষার পর্যাপ্ত সরঞ্জাম কবে পর্যন্ত নিশ্চিত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে সর্বোচ্চ কতটি বেড প্রস্তুত করা যাবে, প্রতিটি হাসপাতালে কতটি ভেন্টিলেটর প্রস্তুত আছে, করোনা পরীক্ষার কতগুলো কিট আছে, প্রতিদিনের ব্যবহারের মানসম্মত গ্লাভস, মাস্ক ইত্যাদির মজুদ কতদিনের মধ্যে নিশ্চিত করা যাবে- এ সব তথ্য প্রকাশ করতে হবে। এবং সেই অনুযায়ী উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এই কাজে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে যথাযথ বরাদ্দ দিতে হবে এবং নিয়মিত তা স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণকে জানাতে হবে। 

২. অবিলম্বে দেশের সর্বত্র বিনামূল্যে টেস্ট করার জন্য প্রয়োজনীয় কিটসহ বিভিন্ন সামগ্রী সরবরাহ এবং তার ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে। মাস্ক, সাবান, স্যানিটাইজার জোগান নিশ্চিত রাখতে হবে। কীট তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে দ্রুত খালাস ও ট্যাক্স-মওকুফের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

৩. দেশের সব প্রবেশ পথ- বিমান, নৌ, স্থলবন্দর, রেল স্টেশন, নৌঘাট সতর্ক নজরদারির আওতায় নিতে হবে। অবিলম্বে করোনা সংক্রমণের সময় আক্রান্ত দেশগুলো থেকে ফিরে আসা প্রবাসীদের অবস্থানের ওপর ভিত্তি করে সম্ভাব্য বা ইতোমধ্যে আক্রান্ত অঞ্চলের মানচিত্র তৈরি করতে হবে (ম্যাপিং)। গুরুত্ব অনুযায়ী অঞ্চলভিত্তিক জরুরি ব্যবস্থা নিতে হবে। দেশের ভেতর কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রামসহ পর্যটন স্থানগুলো বন্ধ করে দিতে হবে। 

৪. কোয়ারেন্টিনের জন্য ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা থেকে দূরে বড় হোটেল-মোটেল-রিসোর্টসহ উপযোগী ভবনগুলো অস্থায়ীভাবে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্টেডিয়াম, জিমনেশিয়াম, খালি ভবনে অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনায় সেনাবাহিনীকে যুক্ত করা সম্ভব। সিএমএইচ, বেসরকারি হাসপাতালগুলোকে সমন্বিত পরিকল্পনায় যুক্ত করতে হবে। 

৫. অতি দ্রুত ডাক্তার-নার্স চিকিৎসা কর্মীসহ সব স্বাস্থ্যকর্মীর নিরাপদ পোশাক ও প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করতে হবে। স্বাস্থ্যকর্মীদের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের আয়োজন করতে হবে। দেশের গার্মেন্টস কারখানা ব্যবহার করে স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে পিপিই (পারসোনাল প্রটেক্টিভ ইক্যুইপমেন্ট) সরবরাহ করতে হবে। 

৬. গণপরিবহন ও গণপরিসরগুলো এবং সংক্রমণের হটস্পট নিয়মিত জীবাণুমুক্ত করার ব্যবস্থা নিতে হবে। জেলখানার ঝুঁকিপূর্ণ জনচাপ দূর করে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে, জনচাপ কমাতে বিনা বিচারে আটক, মেয়াদ উত্তীর্ণদের মুক্তি দিতে হবে। ছিন্নমূল ভাসমান মানুষদের জন্য নিরাপদ স্থানে আশ্রয় শিবির খুলে তাদেরকে সরিয়ে নিতে হবে। গাদাগাদি বাস করা বস্তিবাসীদের নিরাপত্তায় প্রতিটি বস্তিতে পরিচ্ছন্নতার উপকরণ সরবরাহ এবং করোনা মনিটর সেল/ ক্যাম্প স্থাপন করতে হবে। রোহিঙ্গা আশ্রয়কেন্দ্রেও অনুরূপ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী করবার জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। 

৭. করোনা সংক্রান্ত জরুরি কাজ ছাড়া পোশাক কারখানাসহ বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের আপদকালীন সময়ে সবেতন ছুটি দিতে হবে। ছুটিকালীন শ্রমিকদের মজুরি যাতে ঠিকমতো পরিশোধ হয়, সরকারকে তা নিশ্চিত করতে হবে। 

৮. নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুদদারি বন্ধ করে ন্যায্যমূল্যে বিক্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। নিম্ন আয়ের এবং রোজগার হারানো মানুষদের জন্য রেশনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। অতি বিপন্ন মানুষ, যেমন, উদ্বাস্তু, দিনমজুর, রিকশাওয়ালা, বস্তিবাসী, কারখানার শ্রমিক, অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত ব্যক্তি, ছোট ব্যবসায়ী, যাদের জীবিকা হুমকির মুখে, তাদের জন্য বিশেষভাবে অর্থনৈতিক সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। এই সুযোগে ঋণখেলাপি, চোরাই টাকার মালিকদের কোনো বাড়তি সুবিধা দেয়া যাবে না। 

৯. বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী, ধর্মীয় নেতাদের সাহায্যে পাড়ায় পাড়ায় স্থানীয় ক্লাব, সংগঠন ও কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও পর্যাপ্ত সুরক্ষা সরঞ্জাম প্রদান করে তাদের প্রচার ও রোগ প্রতিরোধে কাজের সুযোগ দিতে হবে। 

১০. এর পাশাপাশি ডেঙ্গু এবং চিকনগুনিয়া মোকাবেলায় সরকারের কী পরিকল্পনা তা প্রকাশ করতে হবে। বর্ষা আসার আগেই আমাদের ডেঙ্গু মৃত্যু রোধ করবার প্রস্তুতিও শেষ করতে হবে, যেটি একই কমিটি থেকে পরিচালিত হতে পারে। 

বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারীদের মধ্যে রয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আনু মুহাম্মদ, সায়েমা খাতুন, সাঈদ ফেরদৌস, মীর্জা তাসলিমা সুলতানা, আইনুন নাহার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তানজীমউদ্দিন খান, মোশাহিদা সুলতানা, সামিনা লুৎফা, রোবায়েত ফেরদৌস, জোবাইদা নাসরীন, গীতি আরা নাসরীন, ফাহমিদুল হক, গবেষক রেহনুমা আহমেদ, মানবাধিকার কর্মী খুশী কবির ও সুলতানা কামাল, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সৌভিক রেজা, শিক্ষক ও লেখক আলী রীয়াজ, আলোকচিত্রী ও লেখক শহিদুল আলম, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ইফতেখারুজ্জামান, সুজন- এর বদিউল আলম মজুমদার, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //