করোনা পরিস্থিতি ও উন্নয়নের ব্যাপৃত আলাপ প্রসঙ্গে

উন্নয়ন একটি সামগ্রিক ধারণা, এটি কোন একরৈখিক পথ নয়। কিন্তু আমাদের দেশের জনগণের মাঝে উন্নয়ন সম্পর্কে সর্বদা একটি ভুল বার্তা পৌঁছানো হয়। যেখানে হাতে গোনা কিছু অবকাঠামো ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি দেখিয়ে জনগণকে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অজ্ঞতার মধ্যে রাখা হয়।    

একটি দেশের উন্নয়ন বলতে আসলেই কি বোঝায় সে সম্পর্কে সঠিক বার্তা পৌঁছে দেবার এখনি আশা করি একটি মূল্যবান ও সঠিক সময়। উত্তম সঠিক সময় এ কারণে বলছি যে সাধারণ জনগণ নিজের ব্যক্তিগত অবস্থার মধ্য দিয়ে (যেমন বর্তমান করোনা পরিস্থিতি) তার উপর রাষ্ট্রের চরিত্রকে খুব সহজে বিচার করতে পারে। 

উন্নয়ন বলতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা পূরণ, স্বাস্থ্যসেবা অর্থাৎ প্রতিটি নাগরিকের জীবনের সর্বময় নিরাপত্তা, শিক্ষায় মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ ও গবেষণার প্রসার, নিজস্ব সংস্কৃতির বিকাশ, উৎপাদনের ব্যাপক প্রসার, ন্যায়বিচার ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এমনসব প্রেক্ষিতগুলোকে বোঝায়, সেটি আসলে সামান্য অবকাঠামোর উত্থান বা অসাম্যব্যবস্থায় হু হু প্রবৃদ্ধি বৃদ্ধির কোন বিষয় নয়। রাষ্ট্রের প্রকৃত উন্নয়নের জন্য দরকার একটি ন্যায়নিষ্ঠ,  আদর্শিক, প্রজ্ঞাবান, পরিশ্রমী ও কর্মদক্ষ সরকার ব্যবস্থার, খাই খাই ব্যবস্থায় তা আদৌ সম্ভব নয়।      

ভেবেছিলাম বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সরকার জনগণের খাদ্যের জোগান দিবে, কিন্তু বাস্তবে একদিন কাজ না করলে এদেশের কোটি মানুষের পেটে আহার জুটছে না। আশা রেখেছিলাম আমরা সামান্য স্বাস্থ্যসেবাটা আজ পাবো, কিন্তু সামান্য চিকিৎসাসেবার অভাবেই আজ থরে থরে মানুষ মরছে। ভাবা যায় কোন হাসপাতাল রোগীকে গ্রহণ না করায় এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটাছুটি করতে করতে বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যাচ্ছে! গত দশদিনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় অন্তত ত্রিশজনের বেশি রোগী সর্দি-কাশি উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন। যাদের  প্রায় সব পরিবারগুলো রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাথে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারিনি, কাউকে আবার চারপাশের কোনো হাসপাতাল গ্রহণ করেনি আবার কাউকে কাউকে রোগ নির্ণয়ের ব্যবস্থা না থাকায় হাসপাতালের এক কোণে ধুঁকতে ধুঁকতে মরতে হয়েছে। এরই মাঝে নতুন কেউ করোনায় আক্রান্ত হননি বলে আইইডিসিআর থেকে কথাটার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। কীট সংকট কিংবা নিজেদের অনিচ্ছা বা অপারগতার কারণে নতুন কোন রোগীকে তারা সনাক্ত করতে পারেননি একথা তারা ভুলেও বলছেন না। শুনলাম আইইডিসিআরের কাছে ৩১ শে মার্চ পর্যন্ত ফোনকল আসছে প্রায় ৮ লাখ, যার বিপরীতে তারা  ফোনরিসিভ করেছে ৭০ হাজার, আর নমুনা সংগ্রহ করেছে মাত্র এগারোশ জনের। পরিক্ষিত নমুনাগুলোতে ৪৯  জন রোগী এখন পর্যন্ত সনাক্ত। যারা পরিক্ষিত নয় তাদের অবস্থা এখনো আমরা জানি না।    

আমাদের ১৭ কোটি মানুষের দেশে ভ্যান্টিলেটর (শ্বাস-প্রশ্বাস নেবার যন্ত্র) আছে মাত্র ৫০০, আমেরিকায় যার সংখ্যা দেড় লাখের উপরে। অথচ আমাদের মন্ত্রী মহাশয় বললেন স্বয়ং আমেরিকার ট্রাম্প প্রশাসন নাকি তার কাছে চিকিৎসা সরঞ্জাম চেয়েছেন। এ পরিস্থিতিতে আমাদের পাশের দেশ ভারতে ভ্যান্টিলেটর সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। ফ্রান্স, কানাডা ও ইতালির ৪ থেকে ৭ কোটি মানুষের জন্য সে সংখ্যাটা কারো পাঁচ-ছয় হাজারের কম নয়। 

এ মুহূর্তে দেশের চিকিৎসকদের ব্যাক্তিগত সুরক্ষা পোশাক পিপিই অন্তত জরুরি একটি বিষয়। কিন্তু সরকার তাদের সামান্য সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। যদিও আমরা দেখলাম সরকারি আমলারা পিপিই পরে ইতোমধ্যে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ডাক্তারদের প্রতি সরকারের এই অবহেলা কেনো? তারা আমলাদের মতো রাতবেরাতে সরকারের বিশেষ কোন স্বার্থ হাসিলের কাজে আসেনা সেজন্য কি? তবুও আশার কথা বিষয়টি নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আজ কথা বললেন। যেমন দেশের গরিব, মেহনতি, শ্রমজীবী মানুষদেরকে সরকারের কোন স্বকার্যে প্রয়োজন নেই। অবশ্য তাদের সরকার নির্ধারণের সে অধিকারটা অবশিষ্ট  থাকলে বিষয়টি সামান্য ভিন্ন হলেও হতে পারতো।  

সরকার জনগণের জন্য কিছু করবে সেটা ভাবলেই আতঙ্কগ্রস্থ হয়। আর হবেই না কেন? ঋণখেলাপিদের কাছে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে দেশের ব্যাংকগুলো আজ ফাঁকা। অন্যদিকে আবার সমানতালে লাখ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভের অর্থ চুরি হচ্ছে। শেয়ারবাজার যখন হাতে গোনা কিছু দরবেশের লুটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। লিফট কিনতে, আলুচাষ, নলকূপ খনন কিংবা পুকুর কাটা শিখতে ডজন ডজন আমলা বিদেশে যাচ্ছে। এক একটি বালিশ, পর্দা, কলাগাছ, নারিকেল গাছের দাম  লাখের তরী ডিঙ্গিয়ে কোটি টাকা। ইউএনও-দের খুশি রাখতে ৯৪ লাখ টাকা দামের গাড়ি দেওয়া হচ্ছে। রুট নির্মাণে  ইউরোপের ৩ গুন অর্থ বেশি ব্যয় হচ্ছে। তখন রাষ্ট্রের বেচারা সাধারণ জনগণের প্রতি সরকারের এই নির্মম ও নির্লিপ্ত আচরণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া নয়কি?    

এদেশের মানুষ দেয়াল ভাঙে। দেরিতে হলেও সে জাগে। নিজেদের পেটে যখন আহার জুটবে না তখন চুপটি  মেরে ঘরে বসে থাকবার পাত্র এরা নয়। অপ্রাপ্তির সীমাহীন বঞ্চনায় তাদের জাগতেই হবে তখন। তখন ক্ষমতার চেয়ারটাকে ভাঙতে একবারের জন্যও তার হাতটা কাঁপবে না, বরং সে অচলায়তন ভাঙ্গার মধ্যেই সে আপনগুনে নিজেকে মহিমান্বিত করবে।   

মানুষ জাগবে। তাকে জাগতেই হবে- জাগবার জন্যই তার যে জন্ম।  

লেখক: রাহুল বিশ্বাস।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //