করোনাভাইরাস, পুঁজিবাদ এবং বিশ্ব রাজনীতি

বহুকাল পূর্বেই প্রখ্যাত জার্মান সমাজতন্ত্রী কার্ল লিবক্লেখট (১৮৭১-১৯১৯) বলেছিলেন যে, ‘পুঁজিবাদের কাছে যুদ্ধ ও শান্তি শুধুই বাণিজ্য এবং বাণিজ্য ভিন্ন অন্য কিছু নয়।’ এই আপ্তবাক্যটি সামনে রেখে করোনার প্রাদুর্ভাব, তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে তার ফলাফল কি, তা বুঝতে আমাদের জন্য সহজ হবে। আমরা দেখছি যে, করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) প্রাদুর্ভাবে বিশ্ব প্রবলভাবে জর্জরিত। এর সংক্রমণের হার ক্রমাগতভাবে বেড়েই চলেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই মহামারির কারণে বিশ্বে সর্বোচ্চ সতর্কতা-সংকেত অনেক আগেই জারি করেছে। আমরা আরো জেনেছি যে, করোনাভাইরাসকে প্রথম শনাক্ত করা হয় চীনের হুবাই প্রদেশের রাজধানী উহানে। গত বছর অর্থাৎ ২০১৯ এর ডিসেম্বরে উহানে কিছু কিছু জায়গায় আকস্মিক নিউমোনিয়ার প্রাদুর্ভাব ঘটে, যা আদতে ছিল করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের লক্ষণ; যেটি পরবর্তীতে উহানের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৫ মার্চ নাগাদ চীনে এর প্রভাব কমলেও তার প্রাদুর্ভাব ইতালি, ইরান এবং স্পেনে এখনো বাড়ছে। এ হচ্ছে করোনাভাইরাস সম্পর্কিত জ্ঞাত বয়ান; কিন্তু করোনাভাইরাসের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সংযোগ রয়েছে- বিশ্বপুঁজিবাদের। তার সুরতহাল কিছুটা হলেও শুরু হয়েছে বিশ্বের প্রজ্ঞাবান ও নীতিনিষ্ঠ দার্শনিক, চিন্তাবিদ ও ঐতিহাসিকদের দ্বারা। যদিও এর আরো ব্যাপক বিশ্লেষণের আমরা দাবি করছি।

করোনাভাইরাসবিষয়ক মূল বিতর্ক এখনো আটকে আছে ‘চীন এই মহামারির জন্য কতটা দায়ী এবং করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চীনের সাফল্য কতটুকু’- এই বিতর্কের মধ্যে। যারা চীনের সমর্থক ও চৈনিক ধারার সমাজতন্ত্রের সমঝদার, তারা চীন কতটা দক্ষতার সঙ্গে এ ভাইরাস মোকাবেলা করছে বা তার বিস্তার মোকাবেলায় সঙ্গরোধ ও অপরাপর কি কি এপিডেমিওলজিকাল পদক্ষেপ নিয়েছে এবং এতে চীন কী রকম সাফল্য লাভ করেছে- তার বয়ান দিতেই ব্যস্ত। কিন্তু কেউ বলছে না যে, এই রোগের বরাতে চীন তার দেশের মানুষের ওপর আরো বেশি করে গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি প্রতিষ্ঠার সুযোগ লাভ করেছে এবং সেই সুযোগের সর্বাত্মক সদ্ব্যবহার সে করছেও। চীনের ভিন্নমতাবলম্বী রাজনীতিবিদ ও চিন্তাবিদদের এবং উইঘুর মুসলমানদের ওপর চীন গোয়েন্দাগিরি ফলাতে যে এই সুযোগ নিতে পারে তা বলাই বাহুল্য। অন্যদিকে করোনাভাইরাস সম্পর্কে মার্কিনিদের কোনো কোনো ঘরানা আবার চীনের বিরুদ্ধে বহুমুখী বক্তব্য দিচ্ছে। যেমন- করোনাভাইরাস সম্পর্কে সবচেয়ে কৌতূহল উদ্রেককারী এবং চাঞ্চল্যকারী তথ্য দিয়েছে ‘নিউইয়র্ক পোস্ট’। গত ২২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ এর এক রিপোর্টে স্টেভেন মোশার লিখেছেন যে, করোনাভাইরাস আদতে চীনের একটি বায়োরিসার্চ ল্যাবরেটরি থেকে নিঃসারিত হয়েছে। চীনের ‘ন্যাশনাল বায়োসেফটি ল্যাবরেটরি’ হচ্ছে- ‘উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির অংশ।’ মনে করা হচ্ছে, এই ল্যাবরেটরিতে শুধু করোনাভাইরাস নয়, ইবোলা এবং এনথ্রাক্সের মতো অন্যান্য সার্স জাতীয় ভাইরাসের মজুদ রাখা হতো। এর আগের আতঙ্ক ইবোলা ভাইরাসও এখান থেকেই নিঃসারিত হয়েছিল বলে রিপোর্টটি দাবি করেছে। রিপোর্টটি আরো বলছে যে, এবার বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ার বিশেষজ্ঞ মেজর জেনারেল চেন ওয়েইকে জানুয়ারি মাসে উহানে পাঠানো হয়েছিল বোতল থেকে বেরিয়ে যাওয়া জীনকে আবার বোতলে পুড়তে; কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অন্যদিকে এর মোকাবেলায় চীনের পররাষ্ট্রবিষয়ক মুখপাত্র চাউ লিচিয়ান এক ষড়যন্ত্র তত্ত্বের অবতারণা করেছেন এবং দোষারোপ করছেন মার্কিন সামরিক বাহিনীকে। তার মতে গত বছরের অক্টোবরে উহানে যে সামরিক বিশ্ব ক্রিড়া অনুষ্ঠিত হয়েছিল, সেখানে মার্কিন সামরিক বাহিনী তখনই এই কোভিড-১৯ ভাইরাস সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল। এই বক্তব্যের সাথে কণ্ঠ মিলিয়েছেন চীনের প্রখ্যাত ছোঁয়াচে রোগ বিশেষজ্ঞ চুং ন্যানশ্যাং। একটি প্রেস কনফারেন্সে তিনি তার মতো ব্যক্ত করেন এই বলে যে, ‘এই ভাইরাস প্রথম চীনে শনাক্ত করা হলেও, এর উৎপত্তি চীনে নয়।’ কিন্তু এখানেও কেউ বলছে না যে, করোনাভাইরাসের সঙ্গে সম্পর্কিত বিশ্ব-পুঁজিবাদ ।

লক্ষ্য করবার মতো যে, করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের এবং এর ফলে মৃতদের সিংহভাগই বয়স্ক লোক। চীনসহ অনেক পুঁজিবাদী দেশসমূহে (চীনের রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ আর যাই হোক হয়তো কমিউনিজম নয়) বয়স্ক ব্যক্তিদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে, যা তাদের শ্রমশক্তির জন্য আতঙ্কের কারণ। ২০৫০ সাল নাগাদ চীনে ষাট- ঊর্ধ্ব জনসংখ্যা হবে ৩৫ শতাংশ, যা তাদের শ্রমবাজার ও পুঁজিবাজারের জন্য এক হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। ইতালিতেও বয়স্ক জনসংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। ২০১৯ সালে ইতালিতে ৬৫ ঊর্ধ্ব জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছিল প্রায় ২৩ শতাংশে। ২০৫০ সাল নাগাদ স্পেনে ৬৫ ঊর্ধ্ব জনসংখ্যা দাঁড়াবে ৩০ শতাংশে। ফলে প্রশ্ন উঠতে পারে, উন্নত কিংবা দ্রুত জিডিপি বর্ধনকারী রাষ্ট্রগুলো কি তাদের ডেমোগ্রাফিক কম্পোজিশন পরিবর্তন করতে এই ভাইরাস ব্যবহার করতে চাচ্ছে? টাইমের বরাতে জানা যায়, ২০৫০ সাল নাগাদ চীনে পয়ষট্টি ঊর্ধ্ব জনসংখ্যা হবে ৩৩০ মিলিয়ন। এ ছাড়া চীনে যেহারে জনসংখ্যা বাড়ছে, তা চলতে থাকলে ২০২৯ সাল নাগাদ চীনের জনসংখ্যা দাঁড়াবে ১.৪৪ বিলিয়নে। অন্যদিকে চীনে নতুন প্রজন্ম জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে অনাগ্রহী। ফলে চীন স্বভাবতই তার উন্নতির পথে অন্তরায় হিসেবে এই ক্রমবর্ধিষ্ণু বৃদ্ধ জনগণকে দেখে, যাদের ভাতা হিসাবে চীন সরকারকে বিশাল অঙ্ক গুনতে হয়, আর যার পুরোটাই অলাভজনক খাত। অন্যদিকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে সন্তান জন্ম দানের আগ্রহ কম, তাদের সংখ্যাবৃদ্ধি নেগেটিভের দিকে যাচ্ছে, যা ভবিষ্যৎ চীনের উৎপাদন কাঠামোতে বিরূপ প্রভাব ফেলবে। ফলে চীন তার বৃদ্ধ জনগণের এই বোঝা ঘাড় থেকে কমানোর চেষ্টা কি করবে না? তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতেও চীনের বাজার সবচেয়ে বড়। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ চীনে। ফলে চীনের শ্রমশক্তির ওপর মার্কিন অর্থনীতি নির্ভরশীল।

করোনাভাইরাসের কারণে স্বভাবতই সবচেয়ে বড় আতঙ্কের মুখে পড়েছে বিশ্ব-অর্থনীতি। ইতোমধ্যে চীনের অর্থনীতি গত ত্রিশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থানে পৌঁছেছে। শুধু ২০১৯ সালের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে চীনে চার মিলিয়ন চাকরি কর্তন করা হয়েছে। স্ট্যান্ডার্ট চার্টার্ড ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী চীনের অর্থনীতির ৪২ শতাংশে এর প্রভাব পড়বে। রয়টার জানিয়েছে, এই সংকটের কারণে তিন মাসের মধ্যে চীনের প্রবৃদ্ধি ৬ থেকে কমে ৪.৫ এ নেমে আসবে (১ মার্চ, ২০২০ আলজাজিরার রিপোর্ট এটি)। বিবিসির বরাতে জানা যায়, চীন বিমানখাতে গত মাসে অর্থাৎ ফেব্রুয়ারিতে ৮৪.৫ শতাংশ যাত্রী হারিয়েছে। যার আর্থিক মূল্য ২.৩৫ বিলিয়ন পাউন্ড। চীনের রেল-মন্ত্রণালয় জানিয়েছে যে, ইতোমধ্যে চীনের ট্রেন ব্যবহার ৭৩ শতাংশ কমে গেছে। ‘ওয়ার্ল্ড ওয়াইডএয়ারলাইন্স রেভেন্যুজে’র বরাতে জানা যায়, বিশ্ব বিমানখাতে এ বছর সর্বোচ্চ ১১৩ বিলিয়ন ডলার হারাতে যাচ্ছে। ভ্রমণ ও পর্যটনকেন্দ্রিক সমস্ত ব্যবসাতে এর প্রভাব পড়েছে এবং ডোমিনো অ্যাফেক্ট আকারে তা সামনে আরো বড় পরিসরে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাপানে একই পরিস্থিতির ভবিষ্যদ্বাণী ইতোমধ্যে করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে। জার্মানিতে ডয়েচে ব্যাংক বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দার আগাম আলামত ব্যক্ত করেছে। ফলে বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ-বাণিজ্যের আর আকাঙ্ক্ষিত ফলাফল না আনতে পারা, কতিপয় দেশের ডেমোগ্রাফিক কম্পোজিশন পরিবর্তনের চেষ্টা এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যতে টিকা আবিষ্কারের মাধ্যমে বৃহৎ বাণিজ্যের সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন- এগুলোর সঙ্গে করোনা মেলোড্রামার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা তলিয়ে দেখবার মতো। যদি তাই হয়, তবে বলতে হবে তার ফলাফল অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ‘হরিষে বিষাদ হয়েছে’। ইতোমধ্যে উপরে বর্ণিত নিউ ইয়র্ক পোস্টের চীনবিরোধী রিপোর্টটি আর ইন্টারনেটে পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি ভাববার মতো।

মুহাম্মদ তানিম নওশাদ

লেখক ও অনুবাদক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //