করোনা বিপদ থেকে উত্তরণ কঠিন

জটিল ও দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমে বাড়ছে। একই সঙ্গে বেশি বেশি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ার লক্ষণও পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এখানেই থামবে নাকি মহামারি আকারে দেখা দেবে, এর সবটাই অনিশ্চিত। ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজজীবনে চরমতম অনিশ্চয়তা, শঙ্কা ও ভয়-ভীতির পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন, প্রতিক্ষণ কেবল চিন্তা আর চিন্তা! করোনাভাইরাসে কে কখন, কোথায় ও কীভাবে আক্রান্ত হবেন এবং নিজে আক্রান্ত হয়ে পরিবার ও সমাজের কাউকে সংক্রমণ ঘটানোর কারণ হবেন কি না, এসব আশঙ্কা এখন সবার মনে মনে ঘুরছে। আক্রান্ত হলে যথাযথ চিকিৎসা ও পরিচর্যা পাওয়া যাবে কি না, প্রভৃতি বিষয় নিয়ে অজ্ঞানতা ও অন্ধত্বের মধ্যে রয়েছেন, এমন ব্যক্তি-গোষ্ঠী ভিন্ন সবাই যার পরনাই উদ্বিগ্ন।

যদি মহামারি শুরু হয়, তবে আমাদের চিকিৎসাসহ অন্যান্য ব্যবস্থা তা সামাল দিতে সক্ষম হবে কি না, এ নিয়ে ব্যাপক সন্দেহ বিরাজমান রয়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে এবং প্রশাসনিক তৎপরতার ফলে মূল্যও বাড়েনি। তা সত্ত্বেও ভবিষ্যতে প্রাপ্তি ও মূল্যস্থিতির নিশ্চয়তা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। করোনা ভিন্ন অন্য কোনো রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসা পাওয়া যাবে না বলে মানুষ বিশেষত বয়স্করা আতঙ্কিত রয়েছেন। চিকিৎসা না পেয়ে বিভিন্ন রোগে মৃত্যুর খবর শোনা যাচ্ছে। ক্লিনিক, চেম্বার বন্ধ কিংবা রোগী ফিরিয়ে দেয়ার উদ্বেগজনক খবর জানা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য মহাপরিচালক ডা. আবুল কালাম আজাদ ইতোমধ্যে সত্য ও যথার্থ একটি কথা বলেছেন, ‘সংক্রমণ বেশি হলে মোকাবেলা অসম্ভব।’

ইতোমধ্যে দেশব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ হওয়ার কারণে দিন আনা দিন খাওয়া গরির মানুষ, ক্ষুদে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীরা, বিভিন্ন পেশার নিম্ন আয়ের মানুষ চরমভাবে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে। অভাবী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘চেষ্টা করব ঘরে ঘরে খাদ্য পৌঁছে দেয়ার।’ তবু মানুষ আস্বস্ত হতে পারছেন না। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে খাদ্য বিতরণ কোথাও কোথাও হচ্ছে; কিন্তু ক্রমেই প্রতিভাত হতে থাকছে ও থাকবে প্রয়োজনের তুলনায় এটা কম। চাকরির অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে বিরাটসংখ্যক মানুষ। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের গ্রাম-গঞ্জ থেকে পায়ে হেঁটে মিছিলের মতো ঢাকা আসার ঘটনা এর প্রমাণ। 

দেশে-বিদেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি এভাবে বন্ধ থাকে, তবে সারাবিশ্বে এবং আমাদের দেশে অর্থনৈতিক মহামন্দা অবশ্যম্ভাবী। বলাই বাহুল্য, করোনা মহামারি যত প্রলম্বিত হবে, ততই মন্দা ভয়াবহ ব্যাপক ও দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এবারের বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা হতে পারে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে ভয়ংকর ও দীর্ঘস্থায়ী। সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক মন্দার করাল গ্রাসে পড়লেও সৌভাগ্যবশত আমাদের পড়তে হয়নি। অর্থনৈতিক মহামন্দা দেখা দিলে অগণিত মানুষের জীবনে ভয়াবহ বিপর্যয় ও দুর্ভাগ্য নেমে আসবে। সার্বিক বিবেচনায় সরকারকে তাই মূলগতভাবে বিভিন্ন দিক বিবেচনায় নিয়ে কাজে অগ্রসর করা ভিন্ন বিকল্প আর কিছু নেই। 

প্রথমত, রোগী বাঁচানো। করোনা রোগীদের যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা ও টেস্ট ক্রমাগত বাড়িয়ে রোগী চিহ্নিত করা। হাসপাতাল, চিকিৎসক, চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রভৃতির যথাযথ ব্যবস্থা করা। দ্বিতীয়ত, রোগ যাতে ছড়াতে না পারে, এর জন্য কঠিন থেকে কঠিনতর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, খেটে খাওয়া গরিব মানুষ, স্বউদ্যোগে কাজে নিয়োজিত নিম্নবিত্ত-মধ্যবিত্তদের দুরবস্থার দিকে লক্ষ্য রেখে দৈনন্দিন সাহায্যের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারিত করতে হবে। ত্রাণ নিয়ে যাতে দুর্নীতি ও লুটপাট না হয়, সেই দিকে খেয়াল রেখে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চতুর্থত, যত ঝুঁকিই থাকুক না কেন, যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে জরুরি ও অত্যাবশ্যকীয় সেবা ও শিল্প কারখানা, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের বাজার চালু রেখে প্রাপ্তি সুনিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চমত, চাকরিতে বেতন বন্ধ, ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধ যাতে না হয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। ষষ্ঠত, আইন-শৃঙ্খলার যাতে অবনতি না হয়, অর্থনৈতিক-সামাজিক বিশৃঙ্খলা যেন সৃষ্টি না হয়; গুজব ও আতঙ্ক ছড়ানো বন্ধ করতে হবে। সপ্তমত, আমরা সুবিধায় রয়েছি কেননা কৃষি আমাদের অর্থনীতির প্রধান অবলম্বন ও মেরুদণ্ড। কৃষিখাত আমাদের বাঁচিয়ে দিতে পারে, তাই ওই খাত যাতে কোনোভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় বরং সাহায্যের পরিধি বাড়ে, সেদিকে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অষ্টমত, কালো মেঘ কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যাতে দ্রুত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে ফিরে আসতে পারে, সেই ব্যবস্থা সম্পন্ন করে রাখতে হবে। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে, এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অগ্রসর হচ্ছেন।

বলাই বাহুল্য, এই কাজগুলো একটার সঙ্গে অপরটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত, পরস্পর নির্ভরশীল ও সমন্বিত। এখানে এমনটি বলা খুবই সঙ্গত যে, উল্লিখিত কাজগুলো বলা যত সহজ, কাজটা ততই বহুমুখী কঠিন ও জটিল। আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থার বিস্তৃতি ও গুণগত মান; অর্থনৈতিক-সামাজিক বাস্তবতায় সরকার ও সমাজের সক্ষমতা; জনগণের চেতনার মান বিশেষত আইনকানুন না মানার প্রবণতা, অন্ধত্ব ও গোঁড়ামি; এক শ্রেণির ক্ষমতাবান মানুষের লোভ-লালসা প্রভৃতির কারণে কাজগুলো নিয়ে অগ্রসর হওয়া খুবই জটিল ও কঠিন। আর ওপরের কাজগুলোর দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, একটা কাজ অপরটির সঙ্গে সাংঘর্ষিকও বটে। যেমন- জরুরি সেবা ও শিল্প কারখানা চালু রাখা কিংবা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজার চালু রাখার সঙ্গে সামাজিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন রাখার বিষয়টি পরস্পর বিরোধী। সর্বোপরি কাজগুলোর মধ্যে যেমন তাৎক্ষণিক বিষয় রয়েছে; তেমনি আশু, মধ্যমেয়াদি, দীর্ঘমেয়াদি দিকও রয়েছে। পরিকল্পনার অভাব, দ্রব্য ও অর্থের টানাপড়েন, পদক্ষেপে অদক্ষতা ও বিলম্ব, দুর্নীতি ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হঠাৎ কোনো আকস্মিক ঘটনার উদ্ভব, সংযোগ কিংবা সমন্বয়ের অভাব প্রভৃতি যে কোনো একটা সব কিছুকে এলোমেলো করে দিতে সক্ষম।

পরিস্থিতির যদি এভাবে চলতে থাকে কিংবা মহামারি সৃষ্টি হয়, তবে তা মোকাবেলায় সরকারের সীমাবদ্ধতা-অপ্রতুলতা আর সেই সঙ্গে সামঞ্জস্যহীনতা-সমন্বয়হীনতা আরো সুস্পষ্ট হয়ে উঠবে। যত ব্যবস্থায়ই নেয়া হোক, গুজব আর সেই সঙ্গে সরকারের সমালোচনা বাড়বে। বিশেষ কোনো ইস্যুতে বিক্ষোভও দেখা দিতে পারে। ইতোমধ্যে পোশাক শিল্প কারখানা ছুটি না দেয়ায় অগ্নি সংযোগের ঘটনা ঘটেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, সংক্রমণ ঠেকাতে জাতীয় কমিটির সভাপতি হয়েও তিনি জানেন না কমিটি কি সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। মৃতের সংখ্যা নিয়েও ইতোমধ্যে তিনি ভুল তথ্য দিয়েছেন বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর চাইতে সরকারি কাজে বড় সমন্বয়হীনতার উদাহরণ আর কি হতে পারে! পোশাক শিল্প কারখানা খোলা নিয়ে সমন্বয়হীনতা এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সমন্বয়হীনতা কতটা দুর্ভোগের কারণ হতে পারে, এটা এর প্রমাণ। দায় নিবে কে!

সর্বোপরি যে বিষয়টা উদ্বেগের তা হলো, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হুঁশিয়ারি উচ্চারণ সত্ত্বেও বিভিন্ন জায়গায় সাহায্যসামগ্রী নিয়ে লুটপাটের ঘটনা ঘটে চলেছে।  যশোরের মণিরামপুর, বরগুনার পাথরঘাটা, সিলেট ও কুষ্টিয়া শহর, বাগেরহাট, মৌলভীবাজেরের বড়লেখা, নওগাঁর রাণীনগরসহ বিভিন্ন স্থানে চাউলের বস্তা সরানো কিংবা মাপে কারচুপি করার ঘটনা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। দোষীদের আটক যেমন করা হচ্ছে, তেমনি কী করা হলো তা জানা যাচ্ছে না। অভিজ্ঞতা বলে, ত্রাণের পরিমাণ যত বাড়ে লুটপাটের পরিমাণও ততই বাড়ে। সরকার যেভাবে কঠিন পদক্ষেপ নিয়ে দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রেখেছে, ঠিক লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ জনগণ প্রত্যাশা করে। জেলা কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভিডিও কনফারেন্স এ ক্ষেত্রে প্রশাসনকে কাজে লাগাতে সাহায্য করবে। এবারে দেখা যাচ্ছে, লুটপাটের বিরুদ্ধে জনগণ সোচ্চার; কিন্তু প্রতিবাদ কর্মসূচি আবার সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিরোধী। তাই গোড়াতেই দুর্নীতি ঠেকানো জরুরি কর্তব্য। 

প্রকৃত বিচারে সরকার কতটা সঠিক যথাযথ ও সমন্বিত পদক্ষেপ দ্রুত নিতে পারে, পরিকল্পনা কতটুকু বাস্তবায়িত করতে পারে, প্রশাসন কতটা কর্মক্ষমতা ও দক্ষতা দেখাতে পারে, দল-মত নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশা মানুষের উদ্যোগ কাজে লাগাতে পারে, জনগণকে পক্ষে সমবেত ও উৎসাহিত করতে পারে, তা দিয়েই নির্ধারিত হবে আমরা জাতি হিসাবে দুর্যোগ মোকাবেলায় কতটা সফল হবো। বিপদ থেকে উত্তরণ একটি জটিল কঠিন ও দীর্ঘমেয়াদি পরীক্ষা। বিপদে বন্ধুর পরিচয়। আমরাও পারি, আমরা পারব- এ কথা প্রমাণ করার সময় এখনই।

শেখর দত্ত

কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //