নিয়ম হোক ‘শপথ’ রক্ষার সংস্কৃতি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দেশের মানুষ গভীর আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করে কখন নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যরা শপথ গ্রহণ করবেন। শুধু মন্ত্রী বা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি নয়, রাষ্ট্রের বা সমাজের অনেক দায়িত্ব বা পদ আছে, যা গ্রহণ করতে গেলে শপথ নিতে হয়। দায়িত্ব গ্রহণের ক্ষেত্রে শপথ তাই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসবের বাইরেও সামাজিক মানুষ মাঝে মধ্যে ক্ষেত্রবিশেষে দলবদ্ধভাবে শপথ নিয়ে দেশ ও জাতির উন্নয়নে নিজেদের সংকল্প-অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে থাকেন। একজন মানুষ হিসেবে সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের এ শপথ পাঠ করতে হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনসহ আরো অনেক সামাজিক-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে ঘিরে এ ধরনের সামাজিক শপথের প্রকাশ্য রূপ দিনে দিনে বাড়ছে; কিন্তু সব ক্ষেত্রেই শপথ পরিচালনাকারী আর গ্রহণকারী কতটা আন্তরিকতার সঙ্গে গৃহীত শপথের আপ্তবাক্য ব্যক্তিজীবনে গ্রহণ করছেন তা বলা কঠিন। 

শপথ- সে রাষ্ট্র সম্পর্কিত হোক বা জাতি সম্পর্কিত, দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে পার্থক্য দেখি না। বিবেচ্য বিষয় এই যে, একক বা দলবদ্ধ যেভাবেই নেয়া হোক না কেন নিজের শপথ নিজেকে রক্ষা করতে হয়। অন্যরা শপথ রক্ষা করছে না বলে আমিও তাদের অণুসরণ করব এটা ঠিক নয়। বরং নিজে দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং অন্যদের অনুপ্রাণিত করতে হবে। প্রয়োজনে বারবার মনে করিয়ে দিতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন, ন্যায়-নীতিবোধ সম্পন্ন মানুষ একবার শপথ গ্রহণ করলে তা ভাঙার সুযোগ থাকে না। একজন শপথ গ্রহণ না করলে কিছু যায় আসে না; কিন্তু একবার তা গ্রহণ করলে পালন করতেই হয়। মানবিক বোধসম্পন্ন প্রতিটি মানুষের কাছে শপথ এমনই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই শপথ গ্রহণের আগেই পরিবেশ-পরিস্থিতি ও প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে নিজের ওপর বিশ্বাস রেখে শপথ গ্রহণ বাঞ্ছনীয়। অন্যের অনুপ্রেরণায়, পারিপার্শ্বিকতার প্রভাবে শপথ গ্রহণ যুক্তিযুক্ত নয়। যে কোনো শপথই হোক না কেন, গ্রহণ না করলে ব্যক্তির কোনো দায় নেই; কিন্তু গ্রহণ করলে ষোলআনা দায় বইতে হবে। 

কারণ এ শপথ রক্ষা করা হলে দেশের সাধারণ মানুষ লাভবান হবে। দেশের উন্নয়নের যত অর্থ ব্যয় হয়ে থাকে, তার সিংহভাগেই বিভিন্ন শ্রেণির পেশাজীবীদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। 

গ্রাম বাংলায় একটা প্রবাদ আছে ‘আশায় মরে চাষা’। দেশের বর্তমান পরিবেশ পরিস্থিতিতে আশা করা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো পথ নেই। সারাদেশে শপথ গ্রহণের প্রতিযোগিতা যে হারে বাড়ছে, ঠিক তার বিপরীত হারে কমছে রক্ষা করার দায়। বাধ্যতামূলক শপথ গ্রহণকারীরা শপথ রক্ষায় খুব একটা আন্তরিক এমন কোনো নমুনা যেখানে সাধারণ মানুষ দেখে না, সেখানে পেশাগতসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যেসব শপথ গ্রহণ প্রকাশ্যে আসে তার প্রতি আন্তরিকতার অভাব লক্ষ্যণীয় হবে এটাই স্বাভাবিক। তার পরেও শপথ নেয়ার প্রতিযোগিতা চলছে। তবে দায় না নেয়ার কারণে শপথ গ্রহণের স্থানগুলোর পবিত্রতা রক্ষিত না হওয়ার বিষয়টি সাধারণ মানুষকে ব্যথিত করে দারুণভাবে। শহীদ মিনার, স্বাধীনতা স্তম্ভ, জাতীয় নেতাদের স্মৃতি স্মারক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এসব স্থান শপথ গ্রহণকারীদের কাছে কি তা বলতে পারব না, তবে সাধারণ জনগণের কাছে স্থানগুলো খুবই পবিত্র, জনগণের সঙ্গে তার আত্মার সম্পর্ক। সাধারণভাবে জনগণ এসব স্থানের পবিত্রতা রক্ষা করতে চায় এবং সবসময় তা দেখতে চায়। তাই এসব জায়গায় শপথ নিলে তা রক্ষা করার সর্বাত্মক প্রয়াসও সাধারণ মানুষের একান্ত কাম্য। 

দেশে জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার প্রতিযোগিতার লাইনটা বিশাল। যে কোনো পর্যায়ের নির্বাচন এলেই দায়িত্ব গ্রহণের আগ্রহে ও উৎসাহে নেতা-কর্মীদের উদ্দীপনা জনগণকে আশান্বিত করে; কিন্তু নির্বাচনী বৈতরণী পার করে শপথ গ্রহণ করে বোধ করি দায়িত্ব পালনের আগ্রহ সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে যায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায় জানুয়ারি ’১৪ থেকে অক্টোবর ’১৮ পর্যন্ত চলা দশম জাতীয় সংসদে কোরাম সংকটের ফলে সে সময়ে যে অপব্যয় হয়েছে তার অর্থমূল্য ১৬৩ কোটি টাকা এবং এ সংসদ আইন প্রণয়নে মাত্র ১২ শতাংশ সময় ব্যয় করেছে। যেখানে জাতীয় সংসদে কোরামের জন্য মাত্র ৬০ জন সদস্যের উপস্থিতি প্রয়োজন এবং সংসদ সদস্যদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব আইন প্রণয়ন করা। টিআইবির এই প্রতিবেদন জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব পালনের নৈতিক আগ্রহ ও উৎসাহকেই প্রকাশ করে। এ কথা বলাই যায়, শপথ রক্ষা করার দায় উপেক্ষিত হওয়ার প্রভাব সর্বত্র দেখা যাচ্ছে।

দেশে বাধ্যতামূলক শপথ গ্রহণকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচিত হয়ে থাকেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় জীবনপাত করে চলেছে, সেখানে নির্বাচনে এমন পরিবেশ গড়ে তোলা হয়েছে, যার ফলে জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতেই আসতে চায় না। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যেমন ভালো ফলাফল করার সচেতন প্রতিযোগিতা থাকে, তেমন দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে প্রাপ্ত দায়িত্ব সুচারুভাবে পালনের জন্য দক্ষতা, যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতাকে সমন্বয়ের সচেতন প্রতিযোগিতা থাকবে সেটাই বাঞ্ছনীয়; কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্তরা আজ পদ প্রাপ্তির আনন্দে, জয় করার কপট প্রতিদ্বন্দ্বিতায়, সাধারণ চাহিদা পূরণে প্রবোধদানের মধ্যেই নিজের দক্ষতা প্রকাশে নিবেদিত। স্বার্থের টানে আত্মমর্যাদাবোধ হারিয়ে বিবেক বিবেচনা বিসর্জন দিয়ে নিজের অতীত বিক্রিতে ব্যস্ত। দেশ, দেশের সম্পদ, দেশের মানুষের কল্যাণের যে দায়িত্ব পেয়ে তিনি শপথ গ্রহণ করেছিলেন সময়ের ব্যবধানে তার সবটাই যেন ভোজবাজির মতো উবে গিয়েছে। সাধারণ জনগণ শুধু দেখছে ক্ষমতার টনিকের পরিবর্তন। কী শপথ গ্রহণ করা হয়েছিল আর কী হচ্ছে। আর এতেই রোগা লোক মোটা হচ্ছে, অভিজাত এলাকায় অট্টালিকা উঠছে, সন্তানদের বিদেশযাত্রা নিশ্চিত হচ্ছে, ইউরোপে পরিবারের মার্কেটিং চলছে, সিঙ্গাপুরে চিকিৎসার সুযোগ হচ্ছে, উন্নত বিশ্বে সেকেন্ড হোম হচ্ছে। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনকে দিয়ে শুরু করেছি বলে অন্যরা ধোয়া তুলসিপাতা এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। প্রেক্ষাপট বিবেচনায় এ দৌড়ে কে, কোথায়, কবে, কার থেকে এগিয়ে তা খুঁজতে রীতিমতো গবেষণার প্রয়োজন পড়বে। জনসম্পৃক্ত হলে একটু বেশি নজর কাড়ে আর সেই দৌড়েই প্রধান নির্বাচন কমিশন এসে গিয়েছে। যদিও কমবেশি সবাই জনসম্পৃক্ত। সবাই দৃশ্যমান একটা স্বার্থের পরামর্শে চলে। ফলে চার হাজার কোটি টাকার জালিয়াতির চাইতে চার কোটি টাকার দুর্নীতি গুরুত্ব পায় বেশি। শত-সহস্র কোটি টাকার ঋণ খেলাপিরা বুক চিতিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর পাঁচ হাজার টাকার কৃষি ঋণগ্রহীতা কৃষক পালিয়ে বেড়ায়। নাম বিভ্রাটে দশকের পর দশক কারাগারে পড়ে থাকে নিরপরাধ মানুষ আর খুনের আসামি মুক্তি নিয়ে বিদেশে রাজনৈতিক দলের নেতার দায়িত্ব পায়। নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ধমক চলে আর রমরমা হয় সিন্ডিকেট ব্যবসা। জীবনধারণের জন্য ভাত-কাপড়ের জোগাড়ে দিশেহারা মানুষ আর সামগ্রিক কল্যাণের চেতনার বিনাশ ঘটে প্রতিক্ষণে; কিন্তু এসবে শপথ গ্রহণকারীদের কোনো অঙ্গীকার দেখা যায় না। 

দেশকে দুর্নীতিমুক্ত রাখার শপথে কাজ করে দুর্নীতি দমন কমিশন; কিন্তু এই কমিশনের ক্ষমতা, দায়িত্ব সম্পর্কে দায়িত্বপ্রাপ্তরা কতটা জ্ঞাত সেটা সাধারণ মানুষ জানতেই পারে না। দায়িত্ব গ্রহণ করে কমিশন চেয়ারম্যান জনগণকে বলেছেন, ‘এক কমিশনের পক্ষে দেশের দুর্নীতি দমন সম্ভব নয়। জনগণের সহযোগিতা ছাড়া মুক্তি আসবে না।’ আবার অন্যদিকে তিনি সরকারি কর্মচারীদের বলছেন- ‘সরল বিশ্বাসে কোনো দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লে সেটি অপরাধ হবে না।’ কমিশন চেয়ারম্যানের বক্তব্যের মধ্যেই জনগণের ইচ্ছার অনুগত থাকার চাইতে ক্ষমতার অনুগত প্রতিনিধি হওয়ার প্রয়াস লক্ষণীয়। দুর্নীতির ক্ষেত্র চিহ্নিত করার শক্তি সঞ্চয় করে আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে শপথ রক্ষায় সমদৃষ্টি রাখতে ব্যর্থতার প্রকাশ ঘটেছে বক্তব্যে। মানবকল্যাণ চেতনা থেকে দায়িত্ব গ্রহণ এবং পালন করার মানসিকতায় তিনি যদি শপথ গ্রহণ করতেন তাহলে শপথ স্বার্থকতা পেতো এবং দুর্নীতিমুক্ত সমাজ পাওয়ার পথে সহায়ক হতো। নিশ্চয়ই তিনি লেজের কাছে ঘুরঘুর না করে মাথা ধরে টানার সাহস পেতেন।

দেশে বাধ্যতামূলক শপথগুলো রক্ষা করার দায় কেউই নিজের ওপর রাখতে চায় বলে মনে হয় না। জবাবদিহিহীন, দায়বদ্ধহীন সমাজ ব্যবস্থার কারণে দেখার কেউ না থাকায় এমনটাই স্বাভাবিক। রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ২০১৭ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে ক্যাম্পাসে দিনের পর দিন অনুপস্থিত। পত্রিকান্তে প্রকাশ চাকরির ৯৭৭ দিনের মধ্যে তিনি ক্যাম্পাসে ৭৫০ দিন অনুপস্থিত ছিলেন। এ ছাড়াও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে শিক্ষক মহলের। শিক্ষার্থীদের নয় খোদ সহ-শিক্ষকদের অভিযোগ দেখারই কেউ নেই। শুধু উপাচার্য নয়, সারাদেশে এমন অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আছেন যারা এভাবেই দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। দেশটা এখন পুরোটাই রাজধানীনির্ভর তাই দেশেই যদি থাকতে হয় তাহলে রাজধানীতেই থাকতে চাওয়াটা স্বাভাবিক। নাগরিক সুবিধাহীন স্থানে থাকাটা শোভন পর্যায়ে পড়ে না। তাই সকালে কর্মস্থলে গিয়ে বিকালে রাজধানীতে ফেরত আসতে বাধ্য হন অনেক দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। অবস্থাদৃষ্টে বোধ হয় পদ প্রাপ্তির সুবিধাবঞ্চিত থাকা সম্ভব নয় কোনোভাবেই। শপথ গ্রহণের দায় যতদিন ব্যক্তিজীবনে গ্রহণ না করা হবে, ততদিন এ অবস্থার পরিবর্তন আশা করা যায় না। 

বাধ্যতামূলক শপথ নিয়ম রক্ষার হওয়ায় তা পালনে শিথিলতা সর্বত্রই দেখা যায়।  শপথ রক্ষার সংস্কৃতি গড়ে না ওঠার কারণে শপথ গ্রহণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে মানুষ। এ প্রতিযোগিতার পাকে পড়ে সাধারণ মানুষের কাছে একশ্রেণির দেশপ্রেম ও মানবপ্রেমের শপথ যদি মুক্তির পথ না হয়, তাহলে সামগ্রিক বিষয়টি নতুন করে ভেবে দেখার আবেদন জানাই।


এম আর খায়রুল উমাম

সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //