কৃষকের দীর্ঘশ্বাস

কদিন আগে টিভিতে একটি প্রতিবেদন দেখছিলাম। বগুড়ার একটি পাইকারি সবজির বাজারে বিক্রেতাদের মুখে বিভিন্ন পণ্যের দাম শুনে অবাক হতে হলো। বেশিরভাগ সবজির দাম কেজিপ্রতি ২-৩ টাকার বেশি নয়। 

অথচ পরদিন সেই সবজি যখন ৫০ থেকে ৯০ টাকায় ঢাকায় কিনতে হয় তখন মনে পড়ে যায় সেই কৃষকের মুখ, যার শ্রম-ঘাম লেগে আছে এই খাদ্যপণ্যের পেছনে। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় ফসল ফলিয়ে উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না কৃষক। অথচ সেই পণ্য একজন ভোক্তাকে ঠিকই কয়েকগুণ বেশি মূল্যে কিনতে হচ্ছে। 

ভোক্তার জন্য চাপের হলেও হয়তো তা সহ্য করার একটি যথাযথ কারণ থাকে, যদি এই বর্ধিত দামের অংশ ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছে পৌঁছে; কিন্তু ভোক্তার কেনা দামের তুলনায় কৃষকের প্রাপ্য এত কম, যা রীতিমতো অবিশ্বাস্য। আর এই গণবিরোধী বিষয়গুলো আমাদের অব্যবস্থাপনাপূর্ণ, খামখেয়ালী প্রশাসনকেই দ্রষ্টব্য করে তুলছে। 

সমস্যাটি যে কেবল করোনাকালীন নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে বর্তমান ভঙ্গুর সরবরাহ ব্যবস্থায় এই সমস্যা আরো বহুগুণ বেড়ে গেছে। সরকার পক্ষ থেকে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মজুদে কোনো সমস্যা নেই বারবার বলার পরও,পবিত্র রমজান মাস সামনে রেখে সব পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। 

করোনাভাইরাস সংক্রমণের আশঙ্কায় গণপরিবহন বন্ধ আছে। জরুরি পণ্য পরিবহন ছুটির আওতামুক্ত থাকবে, এরকম একটি ঘোষণা আছে কর্তৃপক্ষের; কিন্তু আদৌ কতটা তা পালন হচ্ছে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ ইতোমধ্যেই পরিবহন সংকটের কারণে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্যসহ নিত্যপণ্য সরবরাহে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে। 

একদিকে পরিবহন সংকট, অন্যদিকে শ্রমিক সংকট। এই দুই সংকটে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদন ও মজুদ থাকার পরও রাজধানীতে চাল আসছে না। ফলে চালের দাম বেড়েছে। সবকিছুর সাথে বন্ধ হয়ে গেছে রাজধানীতে সবজি আসাও। অথচ বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, যশোরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রির অভাবে কৃষকের শাক-সবজি ও নানা ধরনের ফলমুল জমিতেই নষ্ট হচ্ছে। 

একই অবস্থা পোলট্রি পণ্যের। ডিম ও মাংস উভয়ের দাম কমেছে ক্রেতার অভাবে। খামারিরা ক্রেতার অভাবে গরুর দুধ বিক্রি করতে পারছে না।

এমনিতেই কৃষি খাতের নানা সমস্যার কারণে দেশের অনেক অঞ্চলের বহু কৃষকই এই পেশার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। এর সাথে মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাসজনিত নানা প্রতিকূলতা। পণ্য উৎপাদন করতে যে খরচ, তা যদি তুলতে না পারে, তবে কৃষক বাঁচবে কী করে? 

কৃষক ও ভোক্তাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে কৃষিপণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা কীভাবে সচল ও কার্যকর করা যায়, সেই উদ্যোগ নেয়া দরকার ছিল; কিন্তু সব কিছু কেবল ঘোষণাতেই যেন আটকে আছে। 

ন্যায্যমূল্যে ফসল বিক্রি করতে না পারায় প্রতি মৌসুমেই কৃষককে লোকসান গুনতে হচ্ছে। আর যুগ যুগ ধরে এই অবস্থা চলে আসায় কৃষকের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। পাইকারি ক্রেতারা স্থানীয় দালালদের সাথে হাট বসার আগেই আলোচনা করে একটা দাম ঠিক করে নেন। আর সিন্ডিকেটের কারণে শেষ পর্যন্ত লোকসান দিয়ে সেই দামেই কৃষককে তার ফসল বিক্রি করতে হয়। এমনকি মাঠের ফসল পাকার আগেই মধ্যস্বত্বভোগীরা জমিতেই সে ফসল কিনে ফেলেন। এভাবে কৃষকরা প্রতিনিয়ত পাইকারি বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। কৃষকের ক্ষেত থেকে পাইকারি বাজার হয়ে খুচরা বাজারে আসতে আসতে ওই খাদ্য পণ্যের দামের ব্যবধান হয় আকাশ-পাতাল। 

অন্যদিকে আবার এমন অনেক অসাধু ব্যবসায়ী আছেন যারা অধিক মুনাফার জন্য সরকারি ভিজিডি, ভিজিএফ, ফেয়ার প্রাইস এমনকি ওএমএস এর চালও কিনে থাকেন। খাদ্য গুদাম, খাদ্য অধিদপ্তর ও অসৎ জনপ্রতিনিধিদের সাথে এদের আছে গোপন যোগাযোগ। কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার জন্য প্রকাশ্যে ও গোপনে এদের রয়েছে একাধিক গুদাম, যার মাধ্যমে সিন্ডিকেট করে বাজারে নিত্যপণ্যের সরবরাহ কমিয়ে সংকট সৃষ্টি করা হয়। এদের কারণে কৃষক মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্ট করে উৎপাদন করে ঠিকই; কিন্তু বাজারে সঠিক দাম পায় না।

মাঝে মাঝে বিভিন্ন আড়তে যে উদ্ধার অভিযান পরিচালিত হয়, তা কখনো কখনো আমাদের ক্ষণিকের স্বস্তি হয়তো দেয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। আসলে এই পুরো সরবরাহ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন না হলে এইসব বিচ্ছিন্ন অভিযান হতেই থাকবে; কিন্তু কোনো সমাধান আসবে না। কৃষক কিংবা ভোক্তার তুলনায় মধ্যস্বত্বভোগীদের সংখ্যা কিন্তু বেশি না। অথচ এদের হাতেই জিম্মি ভোক্তা এবং কৃষক শ্রেণি। 

পণ্যের প্রকৃত মূল্য, কৃষকের প্রাপ্য মূল্য ও ভোক্তার মূল্য এই তিনটি জায়গায় ব্যবধান কমিয়ে আনা দরকার। কৃষকের ফসলের মাঠ থেকে ভোক্তার হাতে ভোগ্য পণ্য পৌঁছানোর ক্ষেত্রে যে স্তরে স্তরে বাধা সেগুলো অপসারণ জরুরি। কৃষিপণ্যের সাথে ভোক্তার সম্পর্ক হওয়া উচিত, কৃষকের সাথে ভোক্তার সরাসরি সম্পর্ক। মাঝখানে যে স্তর তা যদি ভোক্তার গলা আর কৃষকের পেটের ওপর দিয়ে যায়, তাহলে কৃষি খাতের উন্নয়ন অসম্ভব। 

কৃষিকে কেন্দ্র করে দেশে নানা শিল্প দাঁড়াতে পারত; কিন্তু এই মধ্যস্বত্বভোগীদের কারণেই মূলত এগুলো ঠিকমতো চলতে পারেনি। একের পর এক বাংলাদেশে চিনি, পাট এই শিল্প কলকারাখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার পেছনে এদের দৌরাত্ম্য কারও অজানা নয়।

আমাদের জীবন ও অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। আমাদের আস্থা ও নির্ভরতার মূল জায়গাও কৃষি। সেখানে যদি আমরা কৃষককে শোষণ ও বঞ্চিত করি আমাদের অর্থনীতির বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবেই। আর লাভবান হবে একটা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ও টাউট শ্রেণি। 

এই মধ্যস্বত্বভোগী যারা ভোক্তা ও কৃষক দুটি শ্রেণিকেই দিনের পর দিন ঠকাচ্ছে, শোষণ করে নিজেদের পকেট ভরাচ্ছে- এর সাথে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কোনো সম্পর্ক নেই। বরং কৃষককে যদি তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা যায়, তাহলে খাদ্য উৎপাদনে তারা দ্বিগুণ উৎসাহিত হবে যা রাষ্ট্রের উন্নয়নকেই গতিশীল করবে। 

পৃথিবীতে সামনে ধেয়ে আসছে একটা খারাপ সময়। বেশিরভাগ দেশ খাদ্যসংকটের মুখোমুখি। সেদিক থেকে বাংলাদেশ অনেকটাই সুবিধাজনক অবস্থায়। আমাদের আছে এক বিশাল কৃষক সমাজ। সারাবছর তারা আমাদের এখানে খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখেন। কৃষক নানাভাবে বঞ্চিত, শোষিত হওয়ার পরও কিন্তু উৎপাদন বন্ধ করেনি, খাদ্য উৎপাদনে কোনো দিন পিছপা হননি। আমাদের অনেক প্রতিকূলতা, অরাজকতা, অব্যবস্থাপনা আছে; কিন্তু এই যে আমাদের খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত, এটা আশার কথা। অথচ মধ্যস্বত্বভোগী ক্ষুদ্র একটি শ্রেণির কারণে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে কৃষি শিল্পকে যেভাবে প্রয়োজন, সেভাবে উৎসাহিত করা যাচ্ছে না। 

এই খাতের ভর্তুকি অনেক জায়গায় দিন দিন কমেছে। সারের দাম বেড়েছে। সেচের সুবিধা নেই। যদিও সাম্প্রতিক করোনাকালীন দুর্যোগমুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নিয়েছেন ও কৃষকদের কম সুদে ঋণ দেয়ার মতো কিছু ইতিবাচক ঘোষণা এসেছে; কিন্তু এগুলোর সুফল তখনই পাওয়া সম্ভব যখন প্রকৃত কৃষকের হাতে সেই ঋণ পৌঁছাবে এবং সেই ঋণের যথাযথ ব্যবহার তারা করত পারবেন। 

তবে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত বিক্রয়মূল্য না পেলে এই প্রণোদনায় কৃষির উন্নতি হবে না, মধ্যস্বত্বভোগীর পকেট ভরা ছাড়া। সরকারের যে খাদ্য ও কৃষি বিভাগ আছে, এদের মাধ্যমে সরকারি অংশটুকু সরাসরি কৃষকের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হবে। এর মাঝখানে আর কাউকে রাখা যাবে না। কৃষক তথা কৃষির উন্নতি করতে হলে সরকারকে মাঠপর্যায়ে কৃষকের কাছে থেকে সরাসরি খাদ্যপণ্য সংগ্রহ করতে হবে। ব্যক্তিগত পর্যায়ের কেনাবেচার বাইরে কেবল সরকারি অংশটুকুতে কৃষকের পণ্যের উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিত হলেই এই খাতের বিশৃঙ্খলা অনেকখানি কমে আসবে। 

এরপর সরকারি উদ্যোগেই কৃষকদের কাছে থেকে সংগৃহীত কৃষিপণ্য বাজারগুলোতে সরবরাহ করা যায়। সরকারি পরিবহন সংস্থা ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অনেক ট্রাক জরুরি পণ্য পরিবহনের কাজে ব্যবহার করা যায়। মালবাহী ট্রেনও এই কাজে লাগানো যায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রয়োজনে এই কাজে সশস্ত্র বাহিনীরও সহায়তা নেয়া যায়। এভাবে পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে কৃষককে যেমন তার উৎপাদিত পণ্য ও তার দাম নিয়ে হাহাকার করতে হবে না, তেমনি ভোক্তাও ন্যায্য দামে চাহিদামতো পণ্য কিনতে পারবেন। নইলে আমাদের এ দুর্যোগপূর্ণ সময় থেকে উত্তরণ সম্ভব হবে না।

আমাদের দেশে যুগ যুগে কৃষকই সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থেকে গেছে। নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে কৃষকের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যথাযথ ব্যবস্থা এ রাষ্ট্র রাখেনি। একটি মন্ত্রণালয় আছে বটে; কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের সুফল কৃষকের কাছে কার্যকরভাবে পৌঁছায় না। অথচ দেশের সমস্ত দুর্যোগে কৃষক আমাদের রক্ষা করে, বাঁচিয়ে রাখে। শহরে বসে আমরা টেরও পাই না আমাদের এক একটি প্যাকেট করা খাবারের পেছনে রয়েছে কৃষকের কত শ্রম, ঘাম, দীর্ঘশ্বাস আর ভালোবাসা। মাঠে ফলস ফলাতে গিয়ে এই কৃষকই বজ্রপাতে মারা যাচ্ছে, কে যায় তাদের খোঁজ নিতে?

লেখক: সহকারী সম্পাদক, সাম্প্রতিক দেশকাল

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //