ক্রান্তিকালের নেতৃত্ব তাজউদ্দীন আহমদ

২৩ জুলাই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের ৯৫তম জন্মবার্ষিকী। গাজীপুর জেলার কাপাসিয়ার দরদরিয়া গ্রামে ১৯২৫ সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বাংলাদেশের ক্রান্তিকালে নেতৃত্ব দেয়া এই নেতা। শিশু তাজউদ্দীন খেলাধুলা পছন্দ করতেন, পড়াশোনা শুরু করেছিলেন গ্রামের মক্তবে। সেখান থেকে তিনি কোরআনে হাফেজ হন। পরবর্তীতে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করেন। জেলে থাকাকালীন আইন শাস্ত্রেও ডিগ্রি অর্জন করেন। ছাত্রাবস্থায় মাত্র ২৮ বছর বয়সে তিনি ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হয়ে মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদককে পরাজিত করে এমএলএ (মেম্বার অব লেজিস্লেটিভ অ্যাসেম্বলি) নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি অমর হয়ে থাকবেন, শুধুমাত্র তার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্বে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশকে নির্ভুল নেতৃত্ব প্রদানের জন্য।

তাজউদ্দীন আহমদ কেন রোল মডেল

ভালো সিএসপি অফিসার হওয়ার সুযোগ থাকলেও, তা না করে রাজনীতিকেই ব্রত হিসেবে নেন তিনি। তরুণ তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর দূরদর্শিতা থেকে বুঝতে পেরেছিলেন, দেশের জন্য সবচেয়ে ভালো ভূমিকা রাখার মাধ্যম হতে পারে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ। ঠিক এই জায়গাটিতে তার গভীর মিল রয়েছে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রাণভোমরা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বোসের সাথে। নেতাজিও সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জন করেও সরকারি চাকরিকে প্রত্যাখ্যান করে রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ত্বরান্বিত করেছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের জীবনে ছোটবেলায় পরিচিত হওয়া তিন বিপ্লবীর প্রভাব অনেক। তাই জ্ঞানপিপাসু তাজউদ্দীন যুক্তিবাদী মানুষে পরিণত হয়েছিলেন। মা মেহেরুন্নেসা খানমের প্রেরণা, উৎসাহ ও সাহস তাঁকে দুঃসাহসী স্বপ্ন বাস্তবায়নের মানস গঠনে সাহায্য করেছিল। শিক্ষকদের কাছে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন স্নেহধন্য, আর্শীবাদপুষ্ট এক শিষ্য। একে একে গ্রামের মাদ্রাসা থেকে কাপাসিয়া মাইনর স্কুল, পরে কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস স্কুল, তারপর ঢাকার মুসলিম বয়েস স্কুল এবং সবশেষে সেন্ট গ্রেগরি বিদ্যালয়ে পড়ার দুর্লভ সৌভাগ্য অর্জন করেন। আর এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তিনি সে সময়ে নিজেকে প্রস্তুত করার পর্যাপ্ত সুযোগ পান।

প্রখর মেধাবী তাজউদ্দীন বরাবরই শ্রেণিতে শীর্ষস্থান লাভ করতেন। মেট্রিকুলেশন এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় তিনি মেধা তালিকায় স্থান করে নেন। প্রচলিত পাঠ্যক্রম ও সহায়ক বই পড়ার মাধ্যমে তিনি নিজের জানার জগৎকে বিস্তৃত করেছিলেন। ফলে আত্মঅহংকারী হওয়ার পরিবর্তে তিনি বিনয়ী ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছিলেন। যা আজকের শিক্ষার্থীদের জন্য অণুকরণীয়। তিনি নিয়মিত লাইব্রেরিতে গমন করতেন, সিনেমা দেখতেন এবং শহরে সাইকেল নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন আর রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি শুধু নিজেকে নিজের ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করছিলেন না, বরং নিজেকে প্রস্তুত করছিলেন দেশ-জাতির কল্যাণের জন্য।

মানবিক তাজউদ্দীন আহমদ

তরুণ তাজউদ্দিন আহমদ সহযোগীদের সহায়তায় এলাকায় ধর্মগোলা  প্রতিষ্ঠা করেন। ধর্মগোলায় সমর্থ্যরা ধান জমা করতেন। যার মূল উদ্দেশ্য ছিল দুর্যোগকালে ধর্মগোলার জমাকৃত ধান যাতে গরিবদের সহায়তায় কাজে লাগানো যায়। কারো চিকিৎসা, কারো রক্তের প্রয়োজন, কারো জমি-জমা সংক্রান্ত আইনি সহায়তায় উনি স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার এক সহকর্মী অসুস্থ হয়ে পড়লে তিনি তার সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন।

স্কাউট তাজউদ্দীন আহমদ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে তিনি সিভিল সার্ভিস প্রশিক্ষণ নেন। এ সময় তিনি ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কে রাতে পাহারা দিতেন। এই দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে তাজউদ্দিন আহমদ দেশমাতৃকার প্রতি তাঁর গভীর দায়িত্ববোধের পরিচয় দেন। তিনি আজীবন বয়স্কাউট আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ স্কাউটসের প্রতিষ্ঠালগ্নে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। খেলাধুলার প্রতিও ছিল তাঁর দারুণ ঝোঁক। 

নিয়মিত ডায়েরি লিখতেন

তরুণ বয়স থেকে তাজউদ্দীন আহমদ নিয়মিত ইংরেজি ভাষায় ডায়েরি লিখতেন। উনার ছিল সুন্দর হস্তাক্ষর। তিনি নিয়মিত খবরের কাগজ পড়তেন। প্রতিদিনের ঘটনাবলী সূচারুরূপে তিনি লিখে রাখতেন। ডায়েরি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় উনি নিয়ম করেই সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া প্রায় একই সময় সকালবেলা ঘুম থেকে জাগতেন। উনার বেশিরভাগ ডায়েরি যুদ্ধের সময় শত্রুপক্ষ বিনষ্ট করে। বিশিষ্ট প্রবন্ধকার ও বুদ্ধিজীবি বদরউদ্দিন উমরের কাছে সংরক্ষিত চার বছরের ডায়েরি উনার আনুকূল্যে ফেরত পাওয়া যায়। যা এখন ইতিহাসের এক অমূল্য দলিল। পচাত্তরের পট পরিবর্তনের পর জেলে আটক থাকা অবস্থায় তিনি ডায়েরি লিখতেন। ডায়েরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে একথা তিনি তাঁর সহধর্মিণী সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনকে জানিয়েছিলেন। কিন্তু ৩ নভেম্বরের বিপর্যয়কর পরিসমাপ্তির পর সেই ডায়েরির আর খোঁজ মেলেনি। সেই ডায়েরি পাওয়া গেলে তা হতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে দেয়া এক প্রত্যক্ষ সাক্ষীর অমূল্য দলিল।

দেশেপ্রেমিক তাজউদ্দীন আহমদ

দেশসেবার ব্রত নিয়েই তিনি সচেতনভাবে রাজনীতিতে যুক্ত হন। তার অনেক বন্ধুই কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি রয়ে যান মুসলিম লীগের প্রগতিশীল ধারায়। তিনি ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা ও একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক দল গঠনের লক্ষ্যে প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও পরে আওয়ামী লীগ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে সরাসরি যুক্ত হন। তরুণ বয়সে এমএলএ নির্বাচিত হন। বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনে সক্রিয় থাকার কারণে বারবার তাঁকে রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে জেল খাটতে হয়। তিনি ৬ দফা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর সহকর্মী হিসেবে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ৭১ এর রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠলে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে তার জন্য প্রস্তুত করতে থাকেন। ৬ দফা প্রশ্নে জুলফিকার আলী ভুট্টো বিতর্কের প্রস্তাব দিলে তিনি তা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে অবস্থা বেগতিক দেখে ভুট্টো পিছপা হন। জানা যায় তাজউদ্দীন সম্পর্কে ভুট্টোর অভিমত ছিল- সে (তাজউদ্দীন আহমদ) অনেক সার্প, তাই ভুট্টো তাকে সমীহ করে চলতেন। ভুট্টো বলেছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদকে বাগে আনা অনেক কঠিন। ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তানী বাহিনী বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার ও বাঙালি জাতির উপর নৃশংসভাবে ঝাপিয়ে পড়লে তিনি ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম ভারতের উদ্দেশে বন্ধুর পথ পাড়ি দেন। প্রিয় মুজিব ভাইয়ের অনুপস্থিতিতে সৈয়দ নজরুল ইসলামের অকুণ্ঠ সমর্থন, অন্যান্য সহকর্মীর সহযোগিতায় দেশের মুক্তির লক্ষ্যে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। অসাধারণ দৃঢ়তা, প্রজ্ঞা, মেধা ও নীতি-কৌশলের মাধ্যমে নানান প্রতিকূলতা অতিক্রম করে দেশকে স্বাধীনতার লক্ষ্যে পৌঁছে দেন। যুদ্ধের সময় তিনি পণ করেছিলেন যতদিন যুদ্ধ চলবে ততদিন তিনি পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না। এই শপথ তিনি শেষদিন পর্যন্ত পালন করেছিলেন। 

সৎ ও কর্মনিষ্ঠ

বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাজউদ্দীন আহমদ নিখুঁত ব্যতিক্রম। তাঁর সততা নিয়ে তার শত্রু পক্ষও কোনো প্রশ্ন তোলেনা। তিনি আরেক অর্থে অনেক প্রকাশিতও বটে। কথা ও কাজের মধ্যে ফারাক একদমই নেই। দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম তার এক বয়াণে বলেন ”তাজউদ্দীন কেম বিফোর হিজ টাইম এন্ড হি ইজ টু বি আন্ডারস্টুড” অর্থাৎ, ”তাজউদ্দীন সময়ের অনেক আগে আবির্ভূত হয়েছেন, তাই তাঁকে বুঝতে আমাদের এখনো অনেক বাকি”।

আনুগত্য

বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দীন আহমদকে বিশ্বাস করতেন। বয়সেও ছিলেন বড় ভাই-ছোট ভাইয়ের মতো। তাজউদ্দীনের কাছে বঙ্গবন্ধু ছিলেন প্রিয় মুজিব ভাই, আর মুজিবের কাছে তাজউদ্দীন বিশ্বস্ত ছোট ভাই। তাই সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সাথে দেখা হলে মুজিব ভাই বলতেন, তুমি তাজউদ্দীনকে দেখে রেখ। তার যেন কোনো অসুবিধা না হয়। আর তাজউদ্দীন মুজিব ভাইয়ের জন্য সবসময় উদ্বিগ্ন থাকতেন।  এই মানিক জোরের দীর্ঘ সংগ্রাম ও নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়। একজন ক্যারিশম্যাটিক, আরেকজন ধীর-স্থির লক্ষ্যে অবিচল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্রে দুইজনের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এত লাভবান হয় শত্রুপক্ষ। তাজউদ্দিন অপেক্ষায় থাকেন, একদিন বঙ্গবন্ধুর ভুল ভাঙবে আবার তারা আগের মত একসাথে কাজ করবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। তার আগেই শত্রুরা সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করে। ব্যথিত তাজউদ্দীন তার প্রিয় মুজিব ভাইয়ের মৃত্যু সংবাদে অস্ফুষ্টস্বরে বলে উঠেন- মুজিব ভাই জানলেনও না, কে তার শত্রু, কে তার বন্ধু? একই ধারাবাহিকতায় তাজউদ্দীন আহমদ ও তার অপর তিন সহকর্মী গ্রেফতার হন। পরিণতি তিনি অনুমানই করে রেখেছিলেন- তাইতো যাওয়ার সময় প্রিয়তমা লিলিকে বলেন- মনে করো চিরদিনের জন্য যাচ্ছি।  তারপরের ঘটনা আমরা সবাই জানি, জাতীয় চারনেতাকে বঙ্গবন্ধুর মত্তো একই ভাগ্যবরণ করতে হয়েছিল। দেশের প্রতি, নেতার প্রতি বিশ্বস্ততার প্রমাণ দিয়েছিলেন তারা নিজেদের জীবন দিয়ে।

তাজউদ্দীন আহমদের আদর্শ, চর্চা, নীতি মানবিক গুণাবলী সবই কিশোর-কিশোরী ও তরুণ প্রজন্মের কাছে আদর্শ হওয়া উচিত। একজন কিশোর-কিশোরী আগামী দিনে দেশকে নেতৃত্ব দিবে। তাজউদ্দীন আহমদের দর্শন তার জীবন গঠনে সহায়ক হতে পারে। মাত্র ৫০ বছর বয়সে তিনি যা করেছেন- তার জন্যই তিনি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ”আমি এমনভাবে কাজ করতে চাই যাতে ভবিষ্যতে যারা ইতিহাস লিখবেন তারা যেন সহজে আমাকে খুঁজে না পায়। বেঁচে থাকুক বাংলাদেশ, মুছে যাক আমার নাম”। ইতিহাসে এমন নির্মোহ ব্যক্তিত্ব যুগে যুগে খুব কম জন্মায়।


তথ্যসূত্র: তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি (১৯৫১, তৃতীয় খণ্ড)


লেখক: এম হাফিজুল ইসলাম

পরিবেশ ও উন্নয়ন কর্মী


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //