রাজাবাজারের পর ওয়ারী কী অর্জন হবে?

কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে ২১ দিনের লকডাউন শেষ হওয়ার তিন দিন পর গত ৪ জুলাই লকডাউন শুরু হয় পুরান ঢাকার ওয়ারীতে। ঢাকা উত্তর সিটির পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন শুরু হয়েছিল ৯ জুন মধ্য রাতে। শেষ হয় ৩০ জুন। এটি ছিল লকডাউনের পাইলট প্রকল্প।

এর ওপর ভিত্তি করে একই পদ্ধতিতে দক্ষিণ সিটির ওয়ারীতে শুরু হয় লকডাউন। যদিও পুরো ঢাকা শহর এবং পুরো দেশ আনলকড বা উন্মুক্ত রেখে বিচ্ছিন্নভাবে দু-একটি এলাকা লকডাউন করে যে সামগ্রিকভাবে কোনো সফলতা মিলবে না, সে কথা বিশেষজ্ঞরা বারবারই মনে করিয়ে দিয়েছেন। 

ওয়ারীর প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে পূর্ব রাজাবাজারে ২১ দিন লকডাউনের কিছু অভিজ্ঞতা বলে নেওয়া যাক- 

১. লকডাউন চলাকালে পূর্ব রাজাবাজারে প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়। কোথাও লোহার গেটে তালা, কোথাও বাঁশ ও টিনের বেড়া। গ্রিন সুপার মার্কেট এবং আইবিএ হোস্টেলের পাশে একটিমাত্র প্রবেশপথ রাখা হয়। সেখানেও বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়। তবে ডাক্তার-নার্স-আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং সাংবাদিকরা তাদের পরিচয়পত্র দেখিয়ে এখান দিয়ে যাতায়াতের সুযোগ পেয়েছেন। প্রথম কয়েক দিন এন্ট্রি বা নিবন্ধন ছাড়া যাওয়া-আসার সুযোগ থাকলেও পরে প্রবেশমুখে স্বেচ্ছাসেবকরা খাতায় সবার নাম, বাসার নম্বর এবং মোবাইল নম্বর লিখে রাখতেন। অনেক সময় সাংবাদিকের প্রেস কার্ড দেখলে তারা এন্ট্রি না করেই যাওয়া-আসার অনুমতি দিতেন। কয়েকদিন প্রবেশ ও বহির্গমনের সময় শরীরের তাপমাত্রা মাপার দৃশ্যও চোখে পড়েছে। প্রশ্ন হলোÑ যেসব পেশার মানুষ প্রতিদিন কর্মস্থলে গিয়েছেন এবং এসেছেন, তাদের এই যাওয়া-আসার পথে এবং কর্মস্থলে গিয়ে যে তারা আক্রান্ত হননি এবং এলাকায় এসে তারা যে অন্য কাউকে আক্রান্ত করেননি, তার নিশ্চয়তা কী?

২. এই চার পেশার মানুষের বাইরে অন্য আরও অনেকেই নানা অজুহাতে এলাকার বাইরে গিয়েছেন আবার ফিরে এসেছেন। ফলে তাদের মধ্যে কে কে আক্রান্ত হয়েছেন এবং অন্যকে সংক্রমিত করেছেন, তা জানার উপায় নেই।

৩. লকডাউন চলাকালীন ওষুধের দোকান ছাড়া অন্য সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ ছিল। তবে প্রতিদিন সকালে কয়েকটি সুপার শপ এবং দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য নিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মিল্কভিটার ট্রাক রাজাবাজারে এসেছে। সব পণ্য গায়ের দামে বিক্রি করা হলেও সবজি ও ফলের দাম বাজারমূল্যের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশি ছিল। আবার প্রয়োজনীয় সব পণ্য সব সময় পাওয়াও যায়নি।

৪. লকডাউন শুরুর আগের দিনেই রাজাবাজার থেকে প্রচুর মানুষ অন্য এলাকায়, অনেকে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। কারণ তারা জানতেন, ১৪ থেকে ২১ দিন বাইরে বের হতে পারবেন না। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যারা এলাকা ছেড়েছেন তাদের মধ্যে একটা বড় অংশই বেসরকারি চাকরিজীবী বা রাজাবাজারের বাইরে তাদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সরকারি ঘোষণা অনুযায়ী, লকডাউন এলাকায় সাধারণ ছুটি থাকলেও অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানই তাদের কর্মীদের এই সুযোগ দিতে চায় না। ফলে যারা অফিসে না গেলে অসুবিধায় পড়বেন বা ব্যবসার ক্ষতি হবে বলে শঙ্কা ছিল, তাদের অনেকেই এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় আত্মীয়-স্বজনের বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। ফলে লকডাউনের শেষ দিন বিকেল থেকেই দেখা গেছে, অনেক মানুষ পিঠে ব্যাগ নিয়ে এলাকায় ঢুকছেন।

ওয়ারীর চিত্র

সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, পূর্ব রাজাবাজারের চেয়ে ওয়ারীতে লকডাউন বাস্তবায়নে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকদের বেশি বেগ পেতে হচ্ছে। কারণ, নানা অজুহাতে এলাকা ছাড়ার চেষ্টা করছেন স্থানীয়রা। ভেতরের অলিগলিতে আড্ডা দিচ্ছেন কেউ কেউ। বারবার মাইকে অনুরোধ করা হলেও অনেকেই তা মানছেন না। ওয়ারীর সুমি’স হট কেকের সামনের গেটে একটি জীবাণুনাশক যন্ত্র স্থাপন করা হলেও সেটি ব্যবহার করা হচ্ছে না। এই এলাকা থেকে কাউকে বের হওয়ার অনুমতি দেওয়া হলেও তাকে ওই মেশিন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে না। মেশিনটির বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্তরা বলেছেন, সেটি কাজ করছে না। লকডাউনভুক্ত এলাকায় ফার্মেসি ছাড়া যেহেতু সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ, তাই ওয়ারীতেও রাজাবাজারের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করছে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান। সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, তাদের অন্তত ২০টি দল সেখানে গাড়িতে করে পণ্য বিক্রি করছে।

যা জানতে হবে

১. লকডাউন বাস্তবায়নের কাজটি বেশ কঠিন। টানা ২১ দিন একটি এলাকায় চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং সবকিছু বন্ধ করে রেখে জীবনযাপন স্বাভাবিক রাখা সহজ কথা নয়। আর এরকম একটি কঠিন কাজ করতে সরকারের নিশ্চয়ই অনেক টাকাও খরচ হয়। এখন জানতে হবে, রাজাবাজারের লকডাউন বাস্তবায়নে সরকারের কত টাকা খরচ হয়েছে। কোন কোন খাতে ব্যয় হয়েছে এবং ওয়ারীতে লকডাউন বাস্তবায়নের বাজেট কত? 

২. স্বেচ্ছাসেবকরা কি বিনা পারিশ্রমিকে দায়িত্ব পালন করেন, নাকি তাদের সম্মানি দেওয়া হয়? যদি সম্মানি দেওয়া হয়, তাহলে সেই টাকার পরিমাণ কত?

৩. পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউনের তিন সপ্তাহে স্থানীয় দোকানগুলো বন্ধ থাকায় তাদের কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে এবং সেই ক্ষতি কীভাবে পোষানো হয়েছে বা হবে? সরকার কি এই ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের কোনো আর্থিক সহায়তা দিয়েছে? যদি দিয়ে থাকে, তাহলে তার পরিমাণ কত? ওয়ারীতেও কী পরিমাণ দোকান বন্ধ এবং ২১ দিনে এখানকার ব্যবসায়ীদের আনুমানিক কত টাকার ক্ষতি হবে?

৪. সব দোকানপাট বন্ধ থাকলেও রাজাবাজারে প্রতিদিন সকালে সুপার শপের যে ট্রাকগুলো পণ্য নিয়ে আসতো, তারা তিন সপ্তাহে কত টাকার পণ্য বিক্রি করেছে এবং ওয়ারীতেও যারা এ রকম ব্যবসা করছে, তাদের ব্যবসার অঙ্কটা কত?

৫. রাজাবাজারের লকডাউনভুক্ত এলাকার কর্মহীন ও দিনমজুরদের তালিকা করা হয়েছিল। লকডাউনের ২১ দিনে সেই মানুষদের কতজন খাদ্য সহায়তা পেয়েছেন এবং তাদের কী পরিমাণ সহায়তা দেওয়া হয়েছে? খাদ্য সহায়তার ভেতরে কী কী ছিল?

কী অর্জন হবে?

সারাদেশ পুরো ঢাকা শহর উন্মুক্ত রেখে বিচ্ছিন্নভাবে একটি-দুটি এলাকা লকডাউন করা হলে ওই এলাকায় হয়তো কিছুদিনের জন্য সংক্রমণের মাত্রা কম হবে; কিন্তু অন্যান্য উন্মুক্ত এলাকায় তো করোনাভাইরাস ঠিকই ছড়াবে এবং ছড়িয়েছে। আবার যে এলাকা লকডাউন করা হবে, লকডাউন শেষ হলে ওই এলাকার মানুষ অন্য এলাকায় যাবেন এবং অন্য এলাকার লোকজনও ওই এলাকায় আসবেন, তখন কি তারা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবেন না?

সুতরাং একসঙ্গে সব এলাকায় কঠোর লকডাউন যেহেতু বাস্তবায়ন করা যায়নি এবং সেটি করার সময়ও অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। অতএব, বিচ্ছিন্নভাবে রাজধানীর ছোট্ট একটি-দুটি এমনকি, পাঁচটি এলাকায় লকডাউন করেও আখেরে করোনো মোকাবেলায় কী লাভ হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //