দলীয় প্রভাবমুক্ত ইউনিয়ন পরিষদ চাই

বাংলাদেশের ক্ষমতা কাঠামোয় ইউনিয়ন পরিষদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। অন্যভাবে বললে, ইউনিয়ন পরিষদ এখন পর্যন্ত তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের আস্থার ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে সাধারণ মানুষের সঙ্গে সরাসরি প্রাতিষ্ঠানিক মিথস্ক্রিয়ার একমাত্র কেন্দ্র হিসেবে টিকে আছে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে স্থানীয় সরকার কাঠামোয় ইউনিয়ন পরিষদের ভীত তৈরি হয়েছে। ইউনিয়ন পরিষদ নিয়ে সরকারের সাম্প্রতিক নীতি, পরিবর্তিত নির্বাচন ব্যবস্থা বিশেষত উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদে, রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির চর্চা এই প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্যকে প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। সম্প্রতি করোনাভাইরাস মহামারির প্রকোপে সৃষ্ট দেশব্যাপী অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসহায় ও দরিদ্র্য মানুষকে ত্রাণ সহায়তা প্রদানকে কেন্দ্র করে এ প্রতিষ্ঠানটি বিতর্কিত হচ্ছে।

ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন আবহমানকাল থেকেই এদেশের মানুষের কাছে একটি উৎসব হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছিল। এমনকি জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মানুষের মাঝে বহুগুণ স্বতঃস্ফূর্ততা দেখা যেত। ইউনিয়ন পরিষদে একসঙ্গে তিনটি পদে নির্বাচন হয় : চেয়ারম্যান, সদস্য ও সংরক্ষিত মহিলা আসনের সদস্য। প্রার্থীরা একই ইউনিয়নের বাসিন্দা হওয়ার কারণে অধিকাংশ ভোটারদের সঙ্গে পূর্বপরিচিত থাকেন। বিশেষ করে চেয়ারম্যান পদের প্রার্থীদের রাজনৈতিক পরিচয়কে ভোটারদের কাছে প্রকাশ না করার চেষ্টা করতে দেখা যেত। এর পরিবর্তে তারা মানুষের সেবক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করতে অধিক মনোযোগী থাকত। অর্থাৎ নিজেকে এমনভাবে উপস্থাপন করত, যেন বিশেষ কোনো ব্যক্তি, দল বা রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে সবার কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ না হয়। ইউনিয়ন পরিষদের সার্বিক কর্মকাণ্ডে সবসময় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এমনভাবে দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করত, যেন পরবর্তী নির্বাচনে সাধারণ মানুষের আস্থা তাদের ওপরে থাকে। এ কথা নির্দিধায় বলা যায়, সামগ্রিকভাবে ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচন ও তাদের কর্মকাণ্ড গত দশকেও অনেক বেশি অংশগ্রহণমূলক ছিল। 

২০১৬ সালের মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার শুরু হয়। সংশ্লিষ্ট দলসমূহ বিশেষ করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, জাতীয় পার্টির মতো দলগুলো তাদের স্থানীয় সাংসদ পদপ্রার্থীদের মাধ্যমে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী ঠিক করা শুরু করে। পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট দলসমূহের উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী নির্ধারণে যুক্ত হয়। এসব নেতার কাছে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত ও জনগণের কাছের মানুষের চেয়ে দলীয় ও ব্যক্তি আনুগত্য গুরুত্ব পেতে থাকে। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত দলীয় নেতার ‘পছন্দ-অপছন্দ’। বিভিন্ন ইউনিয়নে দলীয় ক্ষমতা কাঠামোর বাইরে যারা সর্বমহলে জনপ্রিয় ছিল, তারা ক্রমান্বয়ে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়তে থাকে। ইউনিয়ন পর্যায়ের নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের আধিপত্য ও প্রভাব-প্রতিপত্তি নিয়ামক হয়ে ওঠে। প্রার্থীরা জনগণের প্রার্থীর পরিবর্তে হয়ে ওঠেন দলীয় প্রার্থী। মানুষের প্রয়োজন, সেবা ও উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি সংক্রান্ত কথার চেয়ে দলীয় আনুগত্য, দলের গুণগান, দলীয় নেতাদের প্রশংসার স্তুতি হয়ে পড়ে নির্বাচনের কৌশল। জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিস্থাপিত হয়ে পড়ে দলের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রকাশের ‘অদৃশ্য’ প্রতিযোগিতায়। বাংলাদেশের মতো ‘দ্বিদলীয়’ রাজনৈতিক মেরুকরণের দেশে দলীয় প্রভাব বলয়ের বাইরে ভোটারদের আস্থা ও ভালোবাসা দিয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া প্রায় অসম্ভব। কিছু স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জয়ী হতে দেখলেও তাদের মধ্যকার একটি বড় অংশ থাকেন আবার দলীয় ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী। অন্যদিকে যেসব প্রার্থী দলীয় পরিচয়ের বাইরে নিজের পরিচয়, কর্ম ও জনগণের গ্রহণযোগ্যতা বিবেচনায় নির্বাচনে প্রতিযোগিতা করেছেন, তাদের প্রায় কাউকেই জয়ী হতে দেয়া হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে তারা নির্বাচনী প্রচারণাও স্বাভাবিকভাবে চালাতে পারেননি।

২০১৬ সালে দলীয় প্রতীকে ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত ‘জনপ্রতিনিধি’ বা ‘দলীয় প্রতিনিধি’রা এখন ইউনিয়নসমূহের দায়িত্বে। পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, এসব স্থানীয় জনপ্রতিনিধি যতটুকু না জনগণের, তার চেয়ে বেশি দলের। মনোনয়ন পাওয়া থেকে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া পর্যন্ত তাদের নির্ভরতা ছিল দলের প্রতি। অনেক ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয় বর্তমানে কার্যত দলীয় কার্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। আমরা আমাদের একটি গবেষণায় সুনামগঞ্জ, রাজশাহী, খুলনা ও টাঙ্গাইল জেলার কয়েকটি ইউনিয়নে মাঠ থেকে প্রাপ্ত সরেজমিন তথ্য পর্যবেক্ষণে দেখেছি, ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে নির্বাচিত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যদের চেয়ে দলীয় নেতাকর্মীদের দাপট অনেক বেশি। অনেক ইউপি সদস্য পরিষদে বসার মতো একটা চেয়ারও পান না, যেখানে প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে কিংবা ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় পরিষদ চেয়ারম্যান দলীয় লোকদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকেন। সেখানে নির্বাচিত একজন পরিষদ সদস্যের চেয়ে ওয়ার্ড পর্যায়ের একজন নেতার মূল্য ও গুরুত্ব চেয়ারম্যানের কাছে অনেক বেশি থাকে।

করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট দুর্যোগ মোকাবেলায় ত্রাণ বণ্টন নিয়ে অনিয়মের ও চুরির অভিযোগ উঠেছে কিছু ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে। অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে অনেককে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি বা সাময়িক বহিষ্কার করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে অনেক ইউপি চেয়ারম্যানকে অপদস্তও হতে হয়েছে। জেলে যেতে হয়েছে। এতে ব্যক্তি হিসেবে একজন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের চেয়ে প্রতিষ্ঠান হিসেবে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রহণযোগ্যতা মানুষের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছে। অথচ এ ইউনিয়ন পরিষদই বাংলাদেশের শাসন কাঠামোয় স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের আশা-ভরসার স্থল ছিল (এখনো আছে বলে মনে করি)। বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি বারবার বাধাগ্রস্ত হলেও ইউনিয়ন পর্যায়ে গণতন্ত্রের চর্চা ও সৌন্দর্য বিরাজমান ছিল। ‘চাল চুরি’র অপবাদ মাথায় নিয়ে সেই ইউনিয়ন পরিষদ আজকে গ্রহণযোগ্যতার সংকটে। আমরা মনে করি, এ দায় ইউনিয়ন পরিষদের নয় বরং রাজনৈতিক সংস্কৃতি বিশেষ করে বর্তমান আধিপত্যশীল রাজনীতিতে সামগ্রিক চর্চার একটি দিক ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ বণ্টনের মাধ্যমে ফুটে উঠেছে। আজকের ইউপিকে বিচার করতে হবে ‘দলীয় পরিষদের’ মানদণ্ডে।

একটা সময় পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা, মূল্যায়ন ও পর্যবেক্ষণে বিভিন্ন এনজিওর যুক্ততা ছিল। এর মধ্য দিয়ে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা তুলনামূলক অধিক পরিমাণে নিশ্চিত করা সম্ভব হতো। গত এক দশকে এনজিওদের ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বিযুক্ত করা হয়েছে। যেসব ইউনিয়নে এখনো বিভিন্ন দেশি-বিদেশি এনজিও সরাসরি যুক্ত থেকে কাজ করছে, সেখানকার সক্ষমতা ও স্বচ্ছতা বেশি। সেখানে জনগণের মতামত এখনো গুরুত্বপূর্ণ। ইউনিয়ন পরিষদকে জনগণের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। দলীয় কাঠামোর বাইরে ইউনিয়ন পরিষদকে রাখতে হবে। নির্বাচন পদ্ধতিতে দলীয় প্রতীকের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। ইউনিয়ন পরিষদের কার্যক্রমের সঙ্গে এনজিওদের যুক্ততা বাড়াতে হবে। তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ প্রতিষ্ঠান হিসেবে আবারও শক্তিশালী ও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। 


লেখক : গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের শিক্ষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //