পাকিস্তান-চীন ও ভারত-আমেরিকা মৈত্রী: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ

করোনা দুর্যোগের অবসরে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে নাড়াচাড়া করছি। একাত্তর সালের আগস্টের শেষ ও সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকে এসে স্বাভাবিকভাবেই চোখটা আটকে গেল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধ পর্ব এবং দ্বিতীয় পর্যায় সরকার ও মুক্তিবাহিনী গঠন পর্বের পর পাক হানাদারদের মানবতাবিরোধী গণহত্যা চলার সঙ্গে সঙ্গে দেশের সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়মিত বাহিনী আর দেশের ভেতরে গেরিলা যুদ্ধের মাত্রা তখন ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক ৪ বছর আগের ১৫ আগস্ট ’৭১ দিবাগত রাতে ঘটল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য সাধারণ বীরত্বপূর্ণ ঘটনা। নৌ-কমান্ডোরা ‘অপারেশন জ্যাকপট’-এর মাধ্যমে উড়িয়ে দিল চট্টগ্রাম বন্দরের যুদ্ধ সরঞ্জাম ভর্তি তিন জাহাজ। এ দিকে সুদূর পাকিস্তানে ফাঁসির দড়ি সামনে রেখে বঙ্গবন্ধুর বিচার শুরু হয়েছে। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়ে ব্রিটিশ সূর্য অস্তমিত হয়। চীন তার এলাকায় বড় ভাইগিরি দেখাতে গিয়ে কমবেশি ২১টি পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করছে। ভারতের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সম্পর্কের উঠতি-পড়তির ক্ষেত্রেও এই সত্যটি বিবেচ্য।


বীরত্ব ও মৃত্যু তাই ঘিরে রেখেছে আজ থেকে ঊনপঞ্চাশ বছর আগের আগস্টের শেষ আর সেপ্টেম্বরের শুরুর দিনগুলো। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। উল্টোদিকে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে পিংপং রাজনীতি আর ইয়াহিয়া-ভুট্টোর দূতালীতে তখন সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকা আর ‘সমাজতান্ত্রিক’ চীনের দহরম-মহরম তুঙ্গে। ঘটনাপ্রবাহে চীন কেবল জাতিসংঘেরই সদস্য হলো না, পেয়ে গেল নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য পদও। যদি মুক্তিযুদ্ধের ইস্যু সামনে না থাকত তবে চীনের পক্ষে এত সহজে এই সুবিধা জোটা সম্ভব ছিল না। উপমহাদেশের রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান-মার্কিন-চীন অক্ষ এবং বিপরীতে বাংলাদেশ-ভারত-সোভিয়েত অক্ষ। এরই পরিণতিতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের জন্ম হয়।

ওই দিনগুলো আর আজকের দিনগুলোতে কতই না পার্থক্য! ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ’ সোভিয়েত রাশিয়াকে ঘায়েল করতে শত্রুর শত্রু মিত্র- এই নীতি নিয়ে পুঁজি আর ব্যবসার লোভে গণচীন জন্মলগ্নের ঘোষিত নীতি বিসর্জন দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সঙ্গে মৈত্রী গড়ে তুলেছিল। সেই চীন আজ বিশ্বব্যাপী সামরিক-অর্থনৈতিক-কূটনৈতিক প্রভৃতি সব দিক থেকে আমেরিকাকে চ্যালেঞ্জ করছে। সেই সময়ের সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। পারমাণবিক শক্তিতে রাশিয়া বলীয়ান হলেও এখন বিশ্বরাজনীতির রঙ্গমঞ্চে তেমনভাবে নেই; আশপাশের দেশগুলোতে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে ব্যস্ত। আমেরিকার বাণিজ্য যুদ্ধ আর বিশ্বব্যাপী করোনা যুদ্ধের মধ্যে উপমহাদেশের রাজনীতিতে পাকিস্তান-চীন অক্ষ আর ভারত-আমেরিকা অক্ষ ক্রমেই জমাট বেঁধে উঠছে। অতীতে চীন ও পাকিস্তান- এই দুই দেশের সঙ্গেই ভারতের যুদ্ধ হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত বিরোধের জের ধরে বর্তমানে এককালে ভারতের মিত্র নেপাল, চীন-পাকিস্তান অক্ষে যোগ দিলে উত্তেজনা পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে।  

এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে উপমহাদেশে প্রতিষ্ঠিত উপরোল্লিখিত দুই অক্ষ যে বাংলাদেশকে নিজ নিজ অক্ষে নিতে টানাটানি করবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিধর চীন উন্নয়ন সহযোগী হিসাবে যেমন বাংলাদেশের পাশে অর্থনৈতিক সাহায্য নিয়ে আসছে, তেমনি এক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত কম শক্তিধর ভারতও পাল্লা দিতে চাইছে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি যখন বেশ কয়েক বছর ধরে অভ্যন্তরীণ কারণে ভারত ঝুলিয়ে রাখছে, তখন চীন তিস্তা রিভার কমপ্রিহেনসিভ ম্যানেজম্যান্ট অ্যান্ড রেস্টোরেশন প্রকল্পে অর্থ দিতে এগিয়ে আসছে। এ দিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে টেলিফোন করার পর ভারতের বিদেশ সচিব শ্রিংলার ঝটিকা সফরে আসা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে।

আগ্রহোদ্দীপক বিষয় হলো, মুক্তিযুদ্ধে চরম বিরোধিতার কারণে সম্পর্কের ঐতিহ্যের জায়গাটি বিপরীতমুখী অবস্থান থাকার বিষয়টি সামাল দিতে চীন তৎপর হয়ে উঠেছে। সিআরআই অয়োজিত জাতীয় শোক দিবসের আলোচনায় চীনা রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘...চীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল।’ যদি তাই হয়, তবে স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু যখন সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে, সবার সঙ্গে শত্রুতা নয়- এ নীতি নিয়ে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার জন্য দুয়ার উন্মোচন করল, তখন চীন উল্টো লাইন নিল কেন? যে চীন আমেরিকার ভেটোর জন্য ২৫ বছর জাতিসংঘে প্রবেশ করতে পারেনি, সেই গণচীন নবোজাত বাংলাদেশকে জাতিসংঘে প্রবেশে ভেটো দিল কেন? কেন সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর খুনি মোশতাক ক্ষমতায় বসার ১৬ দিনের মাথায় চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল? দেশবাসী কিন্তু এখনো ভোলেনি একাত্তরে বঙ্গবন্ধু যখন পাকিস্তানি কারাগারে বিচারে ফাঁসির দড়ির সামনে, তখন চীন পাকিস্তানকে মদদ দিয়ে চলছিল। পাকিস্তানকে তখন অস্ত্র সাহায্য করেছিল কে? মুক্তিযুদ্ধের সময় লাইট অস্ত্র কোন দেশ থেকে এসেছিল? এসব কি বঙ্গবন্ধুর প্রতি সর্বদা শ্রদ্ধাশীল থাকার নমুনা!

আরও মজার ব্যাপার হলো, চীনের রাষ্ট্রদূত যখন এই কথাটি বললেন, তখন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও উপস্থিত ছিলেন, যিনি কিছুদিন আগেও দেশবাসীকে লজ্জায় ফেলে দিয়ে বলেছিলেন, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক স্বামী ও স্ত্রীর মতো। এখনো মনে পড়ে ২০১৬ সালের প্রথম দিকে ভারত-পাকিস্তান উত্তেজনা যখন চলছে, তখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ যখন বাঁধবে, ভারত যখন আক্রান্ত হবে, তখন নিশ্চয়ই আমরা ভারতের সঙ্গে থাকব।’ প্রবাদে আছে- যখন যেমন, তখন তেমন চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ; কিন্তু বুদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই রূপান্তরিত হয় চালাকিতে, যা সবসময় ক্ষতিকর। বেশি কথায় না গিয়ে আবার ন্যায্য পাওনার কথাও বলব না কেন? পারস্পরিক মর্যাদাবোধ ও স্বার্থ সুরক্ষাই বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মর্মবাণী। বঙ্গবন্ধু কূটনীতির ক্ষেত্রে যে ভিত্তি নির্মাণ করে গেছেন এবং পরিবর্তিত বিশ্বে পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে যে অঙ্গীকার নির্বাচনের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করেছেন, সেই নীতি নিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।

এ ক্ষেত্রে দুটি বিষয়কে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রথমত পারস্পরিক সম্পর্ক ব্যক্তিগত, পরিবারিক বা রাষ্ট্রীয় যাই হোক না কেন, তা কখনো এক সরলরেখায় থাকে না। পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত এই বিশ্বগ্রামে রাষ্ট্রীয় কোনো সম্পর্কই সরলরৈখিক বা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। উঠতি-পড়তি, আগু-পিছু, আঁকা-বাঁকা, চড়াই-উৎরাই পথেই সম্পর্ক অগ্রসর হয়। বরফ যেমন গলে, তেমনি আবার শক্তও হয়। এটাই চরাচরের নিয়ম। তাই ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনও হয়, তবে যেমন গেল গেল রব তুলে পরিস্থিতিকে জটিল করা ক্ষতিকর, তেমনি ভারতের বিপরীতে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের দহরম-মহরম হচ্ছে বিবেচনায় অতি উৎসাহী হওয়ারও প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, বর্তমানে যে বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-চীনের কূটনীতি নিয়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে, তাতে কিন্তু ভারত-বিরোধী জোট বিএনপি-জামায়াত মোটামুটি নিশ্চুপ। একইভাবে নিশ্চুপ বাম-কমিউনিস্ট দলগুলোও। কেন তা বুঝে উঠতে পারা কঠিন নয়।

বলাই বাহুল্য, ভারত ও বাংলাদেশ আর চীন ও বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান ও ঐতিহ্যগত পার্থক্য বর্তমানে যেমন আছে, তেমন সবসময়েই থাকবে। এ ক্ষেত্রেই চলে আসে দ্বিতীয় বিষয় ঐতিহ্যগত প্রশ্নটি। ঐতিহ্য কখনো ভাঙে, কখনো আবার গড়ে ওঠে, জোয়ার-ভাটার মতো। চীন সমাজতান্ত্রিক চীন হতে পেরেছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অবস্থানের কারণে। দু’দেশের ঐক্যকে মনে করা হতো ইস্পাত দৃঢ়; ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ প্রশ্নে যেমন বিভেদ নেই, তেমনি কখনো বিভেদ হবে না; কিন্তু দুই দশক যেতে না যেতেই তত্ত্বগত বিভেদের জের ধরে ঐতিহ্যে ফাটল ধরলো। এমনকি ১৯৬৯ সালে উসুরি নদীর দমনস্কি দ্বীপের সন্নিকটে যুদ্ধ পর্যন্ত হলো। চীন-ভিয়েতনাম সম্পর্ক এখন শত্রুতার পর্যায়ে। চীন-হিন্দ ভাই ভাই স্লোগানে রূপান্তরিত হলো; কিন্তু ১৯৬২ সালের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তা পুরো ভাটায় চলে গেল। রাশিয়া-ভারত সম্পর্কের ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে; কিন্তু ভারত, আমেরিকা মৈত্রী সম্পর্ক তো হাল আমলের।

ঐতিহ্যগত সম্পর্ক যে পরবর্তিত বিশ্বে কত দিক দিয়ে পরিবর্তন হচ্ছে, তা অচিন্ত্যনীয়। পাকিস্তান আর সৌদি আরবের কথাই ধরা যাক। মনে করা হতো এই দুই ইসলামী দেশের সম্পর্কে কোনো দিন ফাটল ধরবে না। ইমরান খান পাকিস্তানে নির্বাচনের আগে মজা করে বলেছিলেন, সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান নির্বাচনে দাঁড়ালে নির্ঘাত জিতবেন। যুবরাজ তাকে তার দেশে ‘পাকিস্তানের দূত’ হিসাবে পরিচিতি দিতে ভালবাসতেন; কিন্তু বিবিসি নিউজ থেকে জানা যায়, সম্প্রতি এতেও ফাটল ধরেছে। 

কূটনীতির ক্ষেত্রে পারস্পরিক মর্যাদার দিক এবং বাংলাদেশের জনমনস্তত্ত্ব পর্যবেক্ষণে এটা সুস্পষ্ট যে, ভারতের সঙ্গে আমাদের চলমান নানা সমস্যা থাকলেও মূলে সমস্যা হচ্ছে মনস্তাত্ত্বিক। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের কথা উঠলেই ভারতের ‘বড়ভাই’ দৃষ্টিভঙ্গির কথাটি সামনে চলে আসে এবং বড় ভাই কেবল নেয়, কিছু দেয় না বলে কথাটি ওঠে। বলাই বাহুল্য কথাটির মধ্যে বড়-ছোট দেশের সম্পর্কের একটি চিরায়ত সত্য লুক্কায়িত রয়েছে। বড় সবসময় রাজনীতি-অর্থনীতি-সামরিক-সাংস্কৃতিক দিক থেকে ছোটকে করায়ত্ত করতে চায়। আমেরিকা বড়র কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়েই মনস্তত্ত্বের দিক থেকে দেশে দেশে মানুষের কাছে নিন্দিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে কর্তৃত্ব ফলাতে গিয়ে ব্রিটিশ সূর্য অস্তমিত হয়। চীন তার এলাকায় বড় ভাইগিরি দেখাতে গিয়ে কমবেশি ২১টি পার্শ্ববর্তী দেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করছে। ভারতের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সম্পর্কের উঠতি-পড়তির ক্ষেত্রেও এই সত্যটি বিবেচ্য।

করোনা-দুর্যোগে মুজিববর্ষের মধ্যে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী সামনে রেখে ভারসাম্যমূলক অবস্থান নিয়ে বাংলাদেশ বঙ্গবন্ধু তথা জন্মলগ্নের সুইজারল্যান্ড হওয়ার আকাঙ্ক্ষা যথাসম্ভব বাস্তবায়নের পথে অগ্রসরমান থাকুক, এটাই আজ একান্তভাবে কাম্য।


কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //