মতামত
হেনা সুলতানা
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:২০ পিএম
আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:৩২ পিএম
প্রকাশ: ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০২:২০ পিএম
মতামত
হেনা সুলতানা
আপডেট: ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৪:৩২ পিএম
এ এক অদ্ভুত সময়Ñ যার নাম কভিড-১৯, যার প্রভাবে অর্থনীতি, ব্যবসা, পর্যটন, শিক্ষা এক কথায় সব কিছু থমকে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি সবার জন্যই আতঙ্কের। চাকরি হারানো থেকে জীবন হারানো,
যে
জীবন
বেঁচে
আছে
সেখান
থেকে
হারাচ্ছে
সময়,
চারদিকে
হারানোর
ভয়ে
জনজীবন
দিশেহারা। সব কিছুতেই সংকটের সম্ভাবনা প্রকট হচ্ছে। সবচেয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে শিক্ষা কার্যক্রম। সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
পাঁচ
মাসেরও
বেশি
সময়
ধরে
বন্ধ
রয়েছে। করোনা দুর্যোগে সরকারের পরবর্তী নির্দেশ না আসা পর্যন্ত দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে। এ প্রতিরোধকমূলক ব্যবস্থা করোনা ভাইরাসের
বিরুদ্ধে।
চলতি বছরের মার্চ মাসের ৮ তারিখে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হবার পর ১৬ মার্চ সরকার ঘোষণা দেয় ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্কুল, কলেজসহ সব ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠন ও কোচিং সেন্টার বন্ধ থাকবে। এরপর সে ছুটির মেয়াদ ৯ এপ্রিল পর্যন্ত বাড়ানো হয়। শ্রেণিকক্ষে পাঠদান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এরপর দফায় দফায় ছুটির মেয়াদ বাড়ানো হয়। ১লা এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। এখন জেএসসি জেডেসি পরীক্ষাও বাতিল। এই পরীক্ষায় প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী অংশগ্রহণের কথা ছিল। বাড়ালো আরো ছুটি। ৩ অক্টেবর পর্যন্ত বন্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (সূত্র, শিক্ষা মন্ত্রণালয়)। শিক্ষার্থীরা আবারও করোনা ছুটির ফাঁদে। দীর্ঘ সময় এই অস্বাভাবিক বিরতিতে শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তেমনি মানসিক ভাবে ভাল নেই তারা। অভিভাবকেরা বলছেন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে প্রথমিক পর্যায়ের শিশুরা।
এ রকম একটি অবস্থা থেকে মাধ্যমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য সংসদ টেলিভিষনের মাধমে ক্লাস শুরু হয় ২৯ মার্চ রোবিবার থেকে। এই ক্লাসের
নাম
দেয়া
হয়েছে
“আমার
ঘরে
আমার
স্কুল।” সিলেবাস অনুযায়ী পাঠদানকারি শিক্ষকেরা ক্লাস শেষে পাঠদানকৃত বিষয়ের উপর বাড়ির কাজ দেবেন। প্রতিটি
বিষয়ের জন্য শিক্ষার্থীরা আলাদা খাতায় তারিখ অনুযায়ী বাড়ির কাজ সম্পন্ন করবে। স্কুল খোলার পর সংশ্লিষ্ট
শ্রেণি
শিক্ষকদের
কাছে
জমা
দেবে। বাড়ির কাজের উপর প্রাপ্ত নম্বর ধারাবাহিক মূলায়নের অংশ হিসেবে বিবেচিত হবে। (সূত্র, মাউশি)
উদ্যোগ প্রসংশনীয়। এর ভিতরে কোন কোন স্কুলে মে মাসের শুরুতে ফেসবুক লাইভ কিংবা জুম ব্যবহার করে শিক্ষকরা তাদের ক্লাস নিয়ে আসছেন।
কিন্তু প্রথম স্তরেই বাধাগ্রস্থ
হলো
প্রান্তিক
জনের
সন্তনেরা। কেননা সবার বাড়িতে টেলিভিশন সেট নাই। দ্বিতীয়ত, সবার কাছে এনড্রয়েড টেলিফোন বা ল্যাপটপ নেই।
ক্লাসগুলি
আধা
ঘন্টা
থেকে
একঘন্টা
চলে। তবে সব বিষয়ে ক্লাস নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য কত স্কুল এই ক্লাস নিতে পারছে বা পারছে না তার কোন হিসেব নেই। হিসেব নেই কি পরিমাণ ছাত্র এর সুবিধা ভোগ করছে। এখন প্রান্তিক
জনের
সন্তানেরা
এই
ব্যবস্থায়
পড়াশুনায়
কতটুকু
অংশ
নিতে
পারছে
বা
সুফল
পাচ্ছে
সেটাই
মুখ্য
প্রশ্ন?
আবার
যাদের
টেলিভিশন
আছে
তারাও
মাঝে
মাঝে
বিদ্যুত
বিভ্রাটের
কারণে
সঠিকভাবে
ক্লাসে
যোগদান
করতে
পারে
না।
কিছু শিক্ষক নিজ উদ্যোগে জুম অ্যাপসের মাধমে ক্লাস নিয়ে তার সচিত্র বিবরণ ফেসবুকে দিয়ে অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন। সেখান থেকে জানা যায় যে ৩৫-৪০ শতাংশ শিক্ষার্থী আগে ঘোষণা দেয়া সত্বেও ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। কিন্তু কেন? সংশ্লিষ্ঠ
শিক্ষকরাই
তার
কারণ
নির্নয়
করে
বলেছেন
শিক্ষার্থীদের
অসচ্ছলতার
কারণে
এমবি/নেট কিনতে না পারা, কারো কারো কেনার সামর্থ থাকলেও নেট ভয়াবহ রকমের স্লো। করোনা ভাইরাসের এই সময়ে অনলাইন শিক্ষ কার্যক্রম সিংহভাগ শিক্ষার্থীর জন্য বোঝাস্বরূপ। প্রান্তিক
মানুষের
সন্তানরা
প্রধানত
প্রতিবছর
আর্থিক
ও
নানা
সীমাবদ্ধতার
কারণেই
শিক্ষা
প্রতিষ্ঠান
থেকে
ঝরে
পড়ে। পরে তারা অভিভাবকদের সাথে জীবন যাত্রার নূন্যতম আয় উপার্যনের অংশীদার হয়ে উঠে। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি বেকার হয়ে যাওয়ার কারণে বহু অভিভাবক
শহর
ছেড়ে
গ্রামে
চলে
গেছেন। গ্রামে ও পার্বত্য অঞ্চলের
আধুনিক
প্রযুক্তিগত
অসুবিধার
অভাবও
প্রকট। অথচ আমরা খাতা কলমে ডিজিটাল বাংলাদেশ ঘোষণা দিয়ে রেখেছি। এ ক্ষেত্রে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা যেমন একটা বড় চ্যালেঞ্জ তেমনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠির সন্তানদেরও লেখাপড়া বাস্তবিক অর্থেই ঝুঁকিপূর্ণ।
করোনা পরিস্থিতে অনলাইন শিক্ষা একটা নতুন প্লাটফর্ম। এ প্রসঙ্গে আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, শিক্ষা হচ্ছে এমন একটি ব্যপার যা প্রাণ থেকে প্রাণে পৌঁছে দেয়ার বিষয়। কাজটি করেন শিক্ষক ছাত্রকে
সামনে
রেখে। এই যান্ত্রিক উপায়ে তা সম্ভব নয়। এখন লাভ লোকশান হিসাব করার সময় নয়। পাওয়া না পাওয়ার সময় নয়। এখন কেবল বেঁচে থাকার সময়।
বাস্তবে আমরা যে কঠিন সময় পার করছি, বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদাই প্রশ্নবিদ্ধ সেখানে প্রান্তিক মানুষের সন্তানদের অনলাইন শিক্ষাÑ দিবাস্বপ্নের মতোই।
শ্রেণি কক্ষে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা একটা নিয়মের ভিতরে থাকেন, যেখানে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের কাজ মূল্যায়ন
করতে
পারেন,
অমনোযোগী
শিক্ষার্থীকে
শনাক্ত
করে
তাৎক্ষনিক
ব্যবস্থা
গ্রহণ
করতে
পারেন। স্ইে সাথে তাদেও কোন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বিষয়টিকে সহজ করে দিতে পারেন। এতো সব সীমাবদ্ধতায় শিক্ষক-শিক্ষার্থীর সরাসরি আন্তরিক যোগাযোগের অভাবে অনলাইন শিক্ষা ফলপ্রসু হওয়া সম্ভব নয়।
জীবন জীবিকার প্রয়োজনে স্বাস্থবিধি মেনে অনেক কাজের ক্ষেত্র যেমন উন্মুক্ত হয়েছে তেমনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানও খুলতে হবে। একদিন না একদিন আমাদের ক্লাস রুমে ফিরতেই হবে। কিন্তু তার আগে করোনার বহুমাত্রিক রূপ ও তার ভয়াবহতা বিবেচনা করেই নিতে হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠন খোলার আগে শ্রেণিকক্ষভিত্তিক আসন বিন্যাস, স্বাস্থ্য সুরক্ষা সরঞ্জামাদির সহজ প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের শারীরিক দূরত্বও নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে প্রন্তিক পরিবারগুলোর সন্তানদের কথাও চিন্তা করতে হবে।
ভাষাসৈনিক শিক্ষাবিদ প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, অনেক দেশই অনলাইনে তাদের শিক্ষাকর্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই আমরাও পারবো। তবে শিক্ষার্থীদের জন্য সুলভে উন্নতমানের ইন্টারনেট সুযোগ সুবিধা বাড়িয়ে দিতে হবে তবেই এর সুফল পাওয়া যাবে। শিক্ষা থেকে কাউকে বঞ্চিত করা চলবেনা। এটা সরকারকেই দেখতে হবে।
সময় এক জায়গায় থেমে নেই। বিকল্প চিন্তা হিসেবে যুগের চাহিদা অনুযায়ী শক্ষির্থীদের জন্য শিক্ষা পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। আশা আকাঙ্খার রূপায়ন ও ভবিষ্যৎ সমাজ নির্মাণের হাতিয়ার দেশের সকল শ্রেণির মানুষের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনীয় উপলদ্ধি যোগানো, নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন ও সমতার সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চার আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান লক্ষ্য হওয়া প্রয়োজন। জীবনের প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন শিক্ষায় আমাদের শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ করে তুলতে হবে। তবেই সোনার বাংলা গড়ে তোলার স্বপ্ন সফল হবে।
করোনা থেকে কবে আমরা মুক্ত হবো সে এখনও অনিশ্চিত। তবে সবার জন্য শিক্ষার দরজা উন্মুক্ত হোক ডিজিটাল বাংলাদেশের কাছে এটাই আমাদের কাম্য।
লেখক: শিক্ষক, ভারতেশ্বরী হোমস
টাঙ্গাইল
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh