ভিন্নমতের পরিধি এবং ঢাবি শিক্ষকের চাকরিচ্যুতি

বঙ্গবন্ধুকে অবমাননা এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের শিক্ষক মোর্শেদ হাসান খানকে চাকরি থেকে স্থায়ীভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের কিছু অংশ নিয়ে বিতর্ক উঠলে তিনি ক্ষমা ও দুঃখপ্রকাশ করে লেখাটি প্রত্যাহার করেছিলেন। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা রকম প্রতিক্রিয়া এসেছে। যেহেতু ওই শিক্ষক বিএনপিপন্থি এবং আওয়ামীবিরোধী শিক্ষকদের সংগঠনের নেতা, স্বভাবতই তার এই চাকরিচ্যুতির ঘটনায় বিএনপির তরফেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। তবে এটিকে বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা হিসেবে না দেখে, একটি কেস স্টাডি হিসেবে দেখা যায়- বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন, সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত ও ভিন্নমত প্রকাশের সুযোগ, ভিন্নমতের পরিধি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা ও তরিকা ইত্যাদিরও বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন।

যদিও অনেকে প্রশ্ন তুলবেন, ভিন্নমতের কোনো পরিধি থাকে কি না, অন্ততপক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই পরিধি থাকা যৌক্তিক কি না? সেই প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আমরা দেখে নিই, কেন এবং কী প্রক্রিয়ায় অধ্যাপক মোর্শেদ হাসানকে চাকরিচ্যুত করা হলো।

২০১৮ সালের ২৬ মার্চ দৈনিক নয়াদিগন্তের স্বাধীনতা দিবস সংখ্যায় অধ্যাপক মোর্শেদ ‘জ্যোতির্ময় জিয়া’ শিরোনামের একটি নিবন্ধে লেখেন, ‘আওয়ামী নেতাদের বেশিরভাগই স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের পরিবার-পরিজনসহ ভারতে চলে গেলেন এ দেশবাসীকে মৃত্যু ফাঁদে ফেলে দিয়ে নেতৃত্বহীন অবস্থায়। যাকে ঘিরে এ দেশের মানুষ স্বপ্ন দেখত, সেই শেখ মুজিবুর রহমানও। জাতির এ সংকটকালীন মুহূর্তে ত্রাতারূপে আবির্ভূত হন তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান। দেশপ্রেমের মহান মন্ত্রে উজ্জীবিত এই টগবগে যুবকের কণ্ঠে ২৬ মার্চ রাতে বজ্রের মতো গর্জে ওঠে স্বাধীনতার ঘোষণা। স্বাধীনতার ডাক এসেছিল শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার হওয়ার পর, তার আগে নয়। আমার জানা মতে, তিনি কোনো স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি।’ নিবন্ধের আরেক জায়গায় স্বাধীনতার পরের বর্ণনা দিতে গিয়ে মোর্শেদ হাসান লিখেছেন, ‘দেশবাসী দেখলো শেখ মুজিব একদলীয় বাকশালী শাসনব্যবস্থা চালু করে নিজেই যেন দাঁড়িয়ে গেলেন নিজের বিরুদ্ধে, গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে। ১৯৭২ থেকে ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের আগপর্যন্ত দেশে বাক স্বাধীনতা বলতে কিছুই ছিল না।’

এই নিবন্ধে বঙ্গবন্ধুর অবমাননা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্পর্কে ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্যের অভিযোগ আনে ছাত্রলীগ। এ ঘটনায় তাকে বরখাস্ত করার দাবিতে আন্দোলনের পাশাপাশি উপাচার্যের কাছে স্মারকলিপি দেন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও ওই লেখার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানায়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ওই বছরের ২ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ মোর্শেদ হাসান খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দিয়ে উপ-উপাচার্য মুহাম্মদ সামাদকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির প্রতিবেদনে অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ার কথা বলা হলে মোর্শেদ হাসান খানের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া যায়, তা নিয়ে আইনি সুপারিশ করতে গত বছর ৩০ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হিসেবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমকে দায়িত্ব দেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। গত বছর ২৯ মে এক লিখিত সুপারিশে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘অধ্যাপক ড. মোর্শেদ হাসান খান তার লেখায় স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে যা লিখেছেন তা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থি। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের পরিপন্থি। তিনি ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের পর যে আন্দোলনের চিত্র এঁকেছেন তা সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বর্ণিত বক্তব্যের পরিপন্থি। অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খানের বিতর্কিত লেখাটি সংবিধানের ষষ্ঠ ও সপ্তম তফসিলে বর্ণিত তথ্যের পরিপন্থি ও ইতিহাসের বিকৃতি।’ শাস্তির সুপারিশ করে ওই সময় অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমার মতে, তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়া উচিত।’ এরপর বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট সভায় তাকে চাকরিচ্যুত করার সিদ্ধান্ত হয়।

যে কোনো লেখার পক্ষে-বিপক্ষে মতামত থাকতে পারে। একজন অধ্যাপক যদি তার লেখায় একজন প্রয়াত রাষ্ট্রপতিকে জ্যোতির্ময় বা আলোকিত মানুষ হিসেবে উপস্থাপিত করতে চান, সেটি তার রাজনৈতিক বিশ্বাসের বিষয়; কিন্তু সেই জ্যোতির্ময় করতে গিয়ে তিনি যদি জাতির পিতাকে হেয় করেন- সেটি নিয়ে ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে সেই ক্ষুব্ধ হওয়ার প্রতিক্রিয়াটি কী হবে- সেটি হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে মুক্তবুদ্ধি চর্চার কেন্দ্র। সেখানে রাজনীতি-রসায়ন-ইতিহাস-সংস্কৃতি সবকিছু নিয়েই বিতর্ক হতে পারে। একটি লেখার পাল্টা হিসেবে দশটি লেখা প্রকাশিত হতে পারে। আলোচনার টেবিলে বুদ্ধিবৃত্তিক ঝড় বয়ে যেতে পারে; কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, কারও লেখা পছন্দ হলো না বলে তাকে চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করতে হবে। এখানে ড. হুমায়ুন আজাদের ঘটনা স্মরণযোগ্য। একজন শিক্ষকের লেখা পছন্দ হয়নি বলে তাকে চাকরিচ্যুত করতে হবে- এটিও কোনো যুক্তির কথা নয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুযায়ী, নিবন্ধ লেখার অপরাধে একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা যায় কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে। কেননা যে আইনের ধারায় তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে, সেটি তৈরি হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিত করতে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে। ওই আদেশের ৫৬ ধারার ২ উপধারা অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কোনো শিক্ষক বা কর্মকর্তার রাজনীতি করার তথা স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অধিকার রয়েছে। ওই আইনে একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করার বিধানও আছে। তাতে বলা হয়েছে, একজন শিক্ষককে চাকরিচ্যুত করা যাবে যদি তিনি নৈতিক স্খলনের (মোরাল টার্পিচ্যুড) কিংবা দায়িত্ব পালনে অপারগতার (ইনইফিসিয়েন্সি) অভিযোগে অভিযুক্ত হন (ধারা ৫৬, উপধারা ৩)। অধ্যাপক মোর্শেদ হাসান খান এই দুই অভিযোগের কোনোটিতেই অভিযুক্ত হননি।

অধ্যাপক মোর্শেদকে চাকরিচ্যুতির আগে-পরে তার সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যেসব তথ্য প্রকাশিত হয়েছে, তাতে জানা যায়, ছাত্রজীবনে তিনি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের সশস্ত্র ক্যাডার ছিলেন। বন্দুক উঁচিয়ে প্রতিপক্ষকে ধাওয়া করেছেন। ফলে প্রশ্ন উঠেছে, তিনি শিক্ষক হলেন কী করে? যদিও এ রকম ক্যাডার শিক্ষকের সংখ্যা নিশ্চয়ই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কম নয়, এমন আরো অনেকেই রয়েছেন। সুতরাং মত প্রকাশের স্বাধীনতা যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, তেমনি কারা কোন প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হচ্ছেন এবং কী করে তাদের চাকরি থাকছে- সেটি আরো গুরুত্বপূর্ণ। 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগে রাজনৈতিক পরিচয় কত গুরুত্বপূর্ণ, তা কারও অজানা নয়। ফলে নিবন্ধ লেখার অপরাধে যদি কারও চাকরি যায়, তাহলে এরকম একজন সাবেক অস্ত্রধারী ক্যাডারকে যারা চাকরি দিয়েছিলেন এবং তার মতো আরো যারা দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে শিক্ষকতার পরিচয় বয়ে বেড়াচ্ছেন- সেই চাকরি প্রদানকারী কর্তৃপক্ষকেও জবাবদিহির মুখোমুখি করা উচিত।

স্মরণ করা যেতে পারে, কিছুদিন আগেই সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মোহাম্মদ নাসিমের মৃত্যুর পর ফেসবুকে তাকে নিয়ে ‘অবমাননাকর পোস্ট’ দেয়ার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পরপর তিনটি মামলা হয়েছিল; যে মামলার আসামিদের দুইজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক এবং একজন শিক্ষার্থী। বিস্ময়কর বিষয় হলো- এই মামলা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কোনো স্বজন বা রাজনৈতিক নেতা করেননি, বরং দুটি মামলার বাদী খোদ সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার এবং একটি মামলার বাদী একজন আইনজীবী।

সিরাজুম মুনিরা নামে রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) বাংলা বিভাগের যে শিক্ষককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেফতার করা হয়, তিনি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম শিক্ষক, যিনি সেখানকার শিক্ষার্থী ছিলেন। শুধু গ্রেফতার নয়, পরবর্তীতে তাকে বহিষ্কারও করা হয়।

একই অভিযোগে আরেকটি মামলায় গ্রেফতার করা হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক কাজী জাহিদুর রহমানকে। তিনি নড়াইল জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক। তাকেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

পরিশেষে, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু পাঠ্যবই মুখস্ত করানোর জায়গা নয়। স্কুল-কলেজের সঙ্গে এর সুস্পষ্ট পার্থক্য রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো- এখানে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ঘটবে; সহনশীলতার চর্চা হবে। একজন শিক্ষক বা শিক্ষার্থী যদি সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন কিছু লিখেও থাকেন, যা কোনো মানুষকে অসম্মানিত করে, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব আইন ও নীতিমালার আলোকেই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যায়। সেজন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো একটি বিতর্কিত ও ভয়াবহ আইনে খোদ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার বিরুদ্ধে মামলা করাটা শোভনীয় ও গ্রহণযোগ্য নয়। একইভাবে একজন শিক্ষক জাতির পিতা সম্পর্কে কোনো একটি মন্তব্য করার পরে যদি সেটি প্রত্যাহার করে নেন এবং সেজন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন- তারপরে আর তাকে চাকরিচ্যুত করাটা যৌক্তিক হয় না। বরং এতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রতিহিংসা এবং শিক্ষক রাজনীতির নোংরা দিকটিই উন্মোচিত হয়।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //