করোনার সেকেন্ড ওয়েভ: সরকার ও সরকারি দলের ভূমিকা

করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দ্বিতীয় পর্ব বা সেকেন্ড ওয়েভ কি আসবে? কখন? অক্টোবর-নভেম্বরে? শীতে? কমবেশি এক সপ্তাহ পর করোনা নিয়ে চিন্তা-উদ্বেগ ভাটার টানের সময় আবার এই প্রশ্নগুলো নিয়ে সর্বত্র আলোচনা চলছে। এর কারণ ২১ সেপ্টেম্বর অনলাইনে মন্ত্রিসভার সাপ্তাহিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকের পর এক সংবাদ ব্রিফিং-এ মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন দেশে করোনার পুনরাবৃত্তির উল্লেখ করে আমাদের দেশেও আসন্ন শীতকালে তা হতে পারার আশঙ্কা উল্লেখ করেছেন। আর তা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মাঠ পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ এবং জনগণের প্রতি ব্যাপকভাবে মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছেন। এর আগে ২৮ আগস্ট জনস্বাস্থ্যবিষয়ক জাতীয় কমিটির সঙ্গে অনলাইন আলোচনা সভায় শীত মৌসুমে করোনা আক্রমণের ও সেকেন্ড ওয়েভ আসার কথাও পূনর্ব্যক্ত হয়। সেখানেও করোনা প্রতিরোধের জন্য সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ এবং জনগণকে মাস্ক পরা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার প্রয়োজনীয়তার কথা গুরুত্বের সঙ্গে আলোচিত হয়। 

করোনাকে যদি পরাজিত বা কাবু করতে হয় তবে কেবল সরকারের প্রচেষ্টা বা ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। এ জন্য ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের প্রচেষ্টাও একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি এসব প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনার সামঞ্জস্য বিধান বা সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এটা অনেকটা সাংস্কৃতিক দল বা বাদ্য দলের মতো।

এসব আলোচনা, নির্দেশনা ও পরামর্শ থেকে সুস্পষ্ট যে, আগামীতে করোনা সংক্রমণ ও মৃত্যুর দ্বিতীয় দফা আক্রমণ আসতে পারে। বলাই বাহুল্য এ আলোচনা, নির্দেশনা ও পরামর্শ খুবই সময়োপযোগী। কারণ করোনার টিকা বা প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই; কিন্তু এখনো যে প্রশ্নটা আলোচনা হচ্ছে না তা হলো, প্রথম দফা কি আমরা অতিক্রম করতে পেরেছি? এটা ঠিক ৮ মার্চ সংক্রমণ ধরা পড়ার ১০ দিন পর ১৮ মার্চ যখন প্রথম রোগীর মৃত্যু হয়, তখন সংক্রমণ ও মহামারি নিয়ে যে আশঙ্কা ও ভয়ের সৃষ্টি হয়েছিল, তা ৬ মাস অতিক্রান্তের পরেও রয়ে গেছে; কিন্তু এখন মৃত্যু সংখ্যা ৫ হাজার ছুঁই ছুঁই করছে এবং নিঃসন্দেহে তা অতিক্রম করবে। এর সঙ্গে করোনা উপসর্গ নিয়ে যাদের মৃত্যু হয়েছে সেই সংখ্যা যোগ করলে তা আরও বাড়বে। এ দিকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে এসেছিল; কিন্তু ২১ সেপ্টেম্বর জানা গেল যে, বিগত ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু সংখ্যা আবারও বেড়ে ৪০ হয়েছে। বিগত ১২ দিন করোনা পরীক্ষায় সংক্রমণের হার শতকরা ১৩ ভাগ ছিল; কিন্তু ২০ ও ২১ সেপ্টেম্বর আবার তা শতকরা ১৪ এর ওপরে এসেছে।

এটা তো অভিজ্ঞতার আলোকে কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই যে, করোনাকে যদি পরাজিত বা কাবু করতে হয় তবে কেবল সরকারের প্রচেষ্টা বা ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটিয়ে আদৌ সম্ভব নয়। এ জন্য ব্যক্তি-পরিবার-সমাজের প্রচেষ্টাও একান্ত প্রয়োজন। সর্বোপরি এসব প্রচেষ্টা ও ব্যবস্থাপনার সামঞ্জস্য বিধান বা সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এটা অনেকটা সাংস্কৃতিক দল বা বাদ্য দলের মতো। কোথাও সম্মিলিত তাল-লয়-সুর কাটা যেতে পারবে না; কিন্তু কেবল আমাদের দেশে নয়, করোনা আক্রমণ মোকাবেলা করতে গিয়ে দেখা গেল উন্নত, সমৃদ্ধ ও শিক্ষিত দেশগুলোতেও এ নিয়ে সমস্যা রয়েছে। ব্যক্তি-পরিবার-সমাজ-রাষ্ট্রকে যে অন্তত এই ব্যাপারে এক তাল-লয়-সুরে বাঁধতে হবে, এটা অনুধাবনের সমস্যা হচ্ছে বিভিন্ন দেশে। যেসব দেশ পারছে তারা বেঁচে যাচ্ছে; কিন্তু যারা পারছে না, তারাই নাস্তানাবুদ হচ্ছে। সংক্রমণ বাড়ছে, মৃত্যুর মিছিল শেষ হচ্ছে না।

আমাকে প্রবাসী এক তরুণ বলল, আমেরিকাতে করোনাকে পরাস্ত করতে আর্মি নামানো সম্ভব নয়। ওখানকার মানুষ-সমাজ-রাষ্ট্র ব্যক্তি স্বাধীনতার ভেতর দিয়ে গড়ে উঠেছে। কমবেশি প্রায় সব নাগরিকদের কাছে আগ্নেয় অস্ত্র রয়েছে। দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিহীন কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। যে কোনো পদক্ষেপের সঙ্গেই রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজ-সংস্কৃতি জড়িয়ে রয়েছে। ওটা বিবেচনায় নিতে হবে সরকারি কর্তৃপক্ষের। নিঃসন্দেহে তরুণটির কথায় গুরুত্ব রয়েছে। বাস্তবে করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে রাষ্ট্র-সমাজ-ব্যক্তি-পরিবার সবকিছু নিয়েই সমন্বিত ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। করোনার টিকা বা প্রতিষেধক নিশ্চয় অচিরেই আবিষ্কৃত হবে; কিন্তু সার্স বা করোনার মতো আরও কিছুও তো ভবিষ্যতে মানব জাতিকে আক্রমণ করতে পারে। তাই সবকিছু নিয়ে সামগ্রিক ভাবনা-চিন্তার প্রয়োজন রয়েছে। ওই তরুণটি বলেছে এবং কথাটা বহুল আলোচিত যে, একজন খেলোয়াড় বা চিত্তবিনোদনের ব্যক্তিত্ব রাষ্ট্র ও সমাজ থেকে যতটা পারিশ্রমিক-মর্যাদা-জনপ্রিয়তা পায় এবং যা পাওয়াটা প্রয়োজন, ততটা কি পান একজন বিজ্ঞানী, গবেষক, স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা! বাস্তবেই বর্তমানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ মিলিয়ে সামগ্রিকভাবে চিন্তা-ভাবনা করার বিষয়টি রাষ্ট্র ও সমাজে জরুরি হয়ে পড়েছে।

তবে বর্তমানকে মোকাবেলা করেই যেহেতু ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে হয়, সেজন্য বর্তমানটা মোকাবেলা করাই এখন আমাদের জন্য মুখ্য বিষয়। মন্ত্রিপরিষদের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঠিকই বলেছেন যে, আমাদের দেশে অক্টোবর-নভেম্বরে ঋতু পরিবর্তনের সময় নিউমেনিয়া, জ্বর বা অ্যাজমার একটা প্রবণতা আসে। এর মধ্যে যদি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসে, তবে তা সমূহ বিপদের কারণ হতে পারে। তাই তা ঠেকাতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে মাঠ পর্যায়ে সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আসাটা ঠিকই আছে। প্রসঙ্গত, বিগত কয়েক মাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, নির্দেশ-আদেশ সত্ত্বেও সরকারি কাজে দুর্বলতা ও সমন্বয়হীনতার লক্ষণ প্রকাশ পেয়েছে। 

করোনার প্রথম পর্যায় চলার পর যদি দ্বিতীয় ধাপ সত্যিই আসে, তবে এই অবস্থার বিরুদ্ধে ক্ষমতাসীন দলের হাইকমান্ডের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি এবং তা জবাবদিহি ও স্বচ্ছতার মধ্যে আনা প্রয়োজন। এই কথাটা সত্য যে, দুর্যোগের সময় অসততা-দুর্নীতির বাড়বাড়ন্ত হয়। তাই গাফিলতি-অসততা-দুর্নীতি হলে ওইসব সমাজবিরোধীরা আইনের আওতায় আসছে কি না, আসলে ওরা দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা পাচ্ছে কি না, তা ধারাবাহিকভাবে সরকারি কর্তৃপক্ষ বা ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে জনসমক্ষে আনা প্রয়োজন। সরকার দোষীদের ধরছে, বিচার করছে, শাস্তি হচ্ছে, এসব বললে বিরল ব্যতিক্রম বাদে এখন সবাই বলেন, এসব ভুয়া।

এসব কথায় আমার পক্ষে যেমন তথ্য উত্থাপন করা সম্ভব হয় না, তেমনি যিনি অভিযোগ করছেন তার পক্ষেও সম্ভব হয় না। এভাবেই রঙ ছড়ায়, গুজব বাড়ে। মানুষ হয় বিভ্রান্ত। বাস্তবে উপরোল্লিখিত চেইন বা আমলা-রাজনীতিকরা কখনো চাইবে না, দোষীদের বিচার ও শাস্তি হোক। তাই গ্রেফতার বিচার ও শাস্তির বিষয়টা এখন ধারাবাহিকভাবে জনসমক্ষে আনা একান্ত জরুরি। প্রকৃত বিচারে মানুষ চায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশ যথাসময়ে যথাযথভাবে কার্যকর হোক। তিনি আরও কঠোর হোন। বলাই বাহুল্য, এক ধাক্কায় কঠিন হওয়া অনেক সময়েই হিতে বিপরীত হয়। বঙ্গবন্ধুর আমলের অভিজ্ঞতা বলে, ছাড় দিতে থাকলে কঠিন হওয়া কষ্টকর। আবার এক ধাক্কায় কঠিন হতে গেলেও বিপদ। তাই মানুষের এই চাওয়াটাকেই ক্ষমতা ও সমাজের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে অগ্রসর হওয়া ভিন্ন সরকারের পক্ষে অন্য কোনো বিকল্প আছে বলে মনে হয় না।

এটা তো স্বতঃসিদ্ধ যে, মানুষ লক্ষ-কোটি চোখ দিয়ে সরকারের কর্মকাণ্ড সব দেখছে, কান দিয়ে শুনছে। এটা চলমান প্রক্রিয়া। মানুষ দেখাশোনা-পড়ার অভিজ্ঞতা দিয়ে সরকারের ভালোটাকে সামনে আনবে, খারাপ দেখলে আলোচনা-সমালোচনা করবে এটাই স্বাভাবিক। এর মধ্যে হীন উদ্দেশ্য সাধনের লোকও থাকবে। আইন তার স্বাভাবিক গতিতে চলবে। এভাবেই অগ্রসর হবে দেশ-সমাজ-গণতন্ত্র। এদিক বিচারে ভালো-মন্দ সামনে এনে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাটাও একটা রাষ্ট্র, সমাজজীবনে অত্যাবশকীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ। এমনি এমনি তো আর সমালোচনাকে গাছের কাঁটা সহ্য করে গোলাপ ফুল ছিঁড়ে আনার সঙ্গে তুলনা করা হয়নি। গণতান্ত্রিক সমাজ মানেই আইনের আওতায় বাক-ব্যক্তি স্বাধীনতার সমাজ। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এ ধরনের রাষ্ট্র-সমাজ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে, বিকশিত হয়েছে, স্বাধীনতা দেশবাসীকে উপহার দিয়েছে এবং বর্তমানে ক্ষমতায় রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সেই অমর উক্তি এক্ষেত্রে স্মরণীয় : ‘যদি কেউ ন্যায্য কথা বলেন, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও যদি একজন ন্যায্য কথা বলেন, তাহলে আমরা তা মেনে নেব।’

সরকারের দিক থেকে করোনার দ্বিতীয় ধাপ মোকাবেলায় অবশ্যই অনেক কিছু করার আছে। ইতোমধ্যে বলা হয়েছে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার জন্য মোবাইল কোর্ট চলছে, চলবে। এ নিয়ে আরও কড়াকড়ি করা হবে। মসজিদের মাইক থেকে দিনে দু’বার ঘোষণা করার নির্দেশও এসেছে: ‘মাস্ক পরাটা রাষ্ট্রীয় নির্দেশ এবং কল্যাণকর। এটি মেনে চলা আমাদের কর্তব্য। না হলে সরকার বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’ সরকারি উদ্যোগের সঙ্গে ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজে লাগানোটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য এমপিসহ জনপ্রতিনিধি আর সেই সঙ্গে দেশব্যাপী স্তরে স্তরে সজানো এলাকাভিত্তিক ক্ষমতাসীন দলের শক্তির সব দিক কি জনগণকে স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে? শক্তির সবটা কি কাজে লাগছে? এমন উদ্যোগ তো লক্ষণীয় নয়। এই প্রশ্নের মুখোমুখি আজ আওয়ামী লীগকে হতে হবে। প্রকৃত বিচারে মানুষকে সচেতন করা ভিন্ন করোনা বিপদ কাটানো বর্তমানে যেমন সম্ভব নয়, তেমনি সম্ভব নয় গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়া, দেশের উন্নয়নকে ধারাবাহিকতার সঙ্গে অগ্রসর করা।


লেখক: কলামিস্ট, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //