সেক্যুলার রাষ্ট্রের পারিবারিক আইন এবং সংখ্যালঘু নারী

সাধারণত অনেকেই ধরে নেন, মুসলমান সমাজে নারীদের যাবতীয় বঞ্চনা এবং বৈষম্যের অন্যতম মৌলিক কারণ ধর্মভিত্তিক পারিবারিক আইন। এর পাশপাশি এটাও মনে করেন যে, এসব সমাজে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং বিশেষত সংখ্যালঘু নারীদের প্রতি বৈষম্যের বড় কারণ ‘অসম্পূর্ণ সেক্যুলারিজম’। 

এমনকি বিদ্যাজগতেরও অনেকে মনে করেন, বাংলাদেশের পারিবারিক আইন আসলে ধর্মীয় আইনের একটা সিলসিলা এবং উপনিবেশকালে ব্রিটিশরা পুরনো শরীয়া এবং ধর্মীয় আইনকে একটা কাঠামোর মধ্যে বিধিবদ্ধ করে ফেলেছিল। এই বিধিবদ্ধ করতে গিয়ে তারা কিছু আইন ধর্ম থেকে নিয়েছে, আবার কিছু আইন ধর্মের বাইরে সেক্যুলার চিন্তা থেকে নিয়েছে। ফলে সেক্যুলার আর ধর্মীয় দুই ধারা মিলে বাংলাদেশের যে হাইব্রিড ধারার আইন উপনিবেশকালে তৈরি হয়েছে, এটা পুরোপুরি সেক্যুলার আইন হতে পারেনি। আর এই সেক্যুলার আইন না হওয়াটাই সমস্যা এখন।

বাংলাদেশের পারিবারিক আইনের এই সমস্যাগুলোর মতোই মিসরের সংখ্যালঘু কপ্টিক খ্রিষ্টানদের পারিবারিক আইনের সমস্যা নিয়ে কাজ করেছেন বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ সাবা মাহমুদ। তিনি লক্ষ্য করেন আমরা যেভাবে দেখি সেক্যুলার আইন না থাকার কারণে সংখ্যালঘু নারীরা বঞ্চিত, বাস্তবতা তা-না। বরং সংখ্যালঘু মেয়েদের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করার অন্যতম কারণই হচ্ছে সেক্যুলার রাষ্ট্রকাঠামো। সাবার মতে, সেক্যুলারিজম সমাজে নিজে হাজির থাকার প্রয়োজনেই রাষ্ট্রে জনপরিসর এবং ব্যক্তিগত পরিসর এমন আলাদা দুইটা পরিসর তৈরি করে। এটা করতে গিয়ে সে একদিকে ধর্ম এবং পরিবারকে আলাদা বর্গ করে ব্যক্তিগত পরিসরে পাঠিয়ে দেয়। অন্যদিকে সমাজে ধর্মীয় নৈতিকতা এবং পরিচয় বহনের ঠিকাদারি পরিবারকে দিয়ে দেয়। আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্রের অপারেশনের ছায়াতলে এভাবে ধর্ম, পরিবার, যৌনতা এক ‘সর্বনাশা’ আবদ্ধ সম্পর্কের জালে জড়িয়ে পড়ে। 

এটাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে সাবা কিছুটা পেছনে ফিরে যান। সাবার মতে, আমরা এখন যেমন পারিবারিক আইন বনাম পাবলিক আইন এই ধরনের বিভাজন দেখি, ব্রিটিশ উপনিবেশ আসার আগে সমাজে এমন বিভাজন ছিল না। ইসলাম ধর্মে পারিবারিক আইন বলে আলাদা কোন আইন ছিল না সে সময়। মুসলমান সমাজে মূলত চর্চা হতো শরীয়া (মুসলমান সমাজের নিয়ম-নীতি)। সে সময় শরীয়া নানান সমাজে নানাভাবে চর্চা হতো। শরীয়া কখনোই এককেন্দ্রিক কোনো ব্যবস্থা ছিল না। হাত, পা-কাটা নামে আমরা এখন শরীয়ার যে বিকট চেহারা পশ্চিমা চিন্তার মধ্য দিয়ে দেখি, জনসাধারণের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে এই শরীয়া সেসময় খুবই নমনীয় এবং সহজ ব্যবস্থা ছিল। শরীয়ার নানান সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও সে সময় নারীরা সহজেই এসব আদালতে নিজেদের ন্যায়বিচার এবং অধিকার দাবি করতে পারত, বিয়ে বিচ্ছেদের অধিকারও ছিল সহজে। শরীয়া আদালত নারী প্রশ্নে এত নমনীয় ছিল যে, ত্রয়োদশ শতকে মিসরের খ্রিস্টান আইনে মেয়েরা নিজেদের বিয়ে বিচ্ছেদ করতে পারতো না বিধায় অনেক কপ্টিক নারী নিজেদের আইনকে ডিঙিয়ে শরীয়া কোর্টের দ্বারস্থ হতো।

সে সময় স্রেফ মুসলিমদের আইন এমন ছিল না, বরং কপ্টিক সম্প্রদায়ের আইনও মোটাদাগে সহজবোধ্য ছিল। কপ্টিক নারী শরিয়া আদালতে যাওয়ার ঘটনায় যাজকদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্ক হওয়ার মধ্য দিয়ে তারা এই আইনের অসংখ্য সংস্কার নিয়ে আসে। এই আইন এত সহজ হয়ে যায় যে, সে সময় থেকেই একজন কপ্টিক নারীও বিয়ে-বিচ্ছেদের অধিকার পেয়ে যায়।

কিন্তু দেখা গেল সেক্যুলার আধুনিক রাষ্ট্র গঠন করতে গিয়ে, রাষ্ট্র সব স্থানীয় আইনি চর্চাকে একটা কেন্দ্রীয় জায়গায় নিয়ে এসে বিধিবদ্ধ করে ফেলল। আগে ধর্মের মধ্যে এইভাবে আলাদা পারিবারিক আইন বলে কিছু না থাকলেও, জনপরিসর আর ব্যক্তিগত পরিসর তৈরি করতে গিয়ে সেক্যুলারিজম আলাদা পারিবারিক আইন তৈরি করল। 

সাবা দেখাচ্ছেন, মিসর আধুনিক রাষ্ট্র হওয়ার পর সেখানেও নিরাপত্তা আর সাম্প্রদায়িক-ঐক্য বিনির্মাণের নামে কপ্টিকদের জন্য আলাদা কেন্দ্রীয়ভাবে পারিবারিক আইন তৈরি করা হয়। এই আইনকে ব্যাখ্যার যাবতীয় কর্তৃত্ব কপ্টিক ধর্মীয় নেতাদের দেয়া হয়। দেখা গেল, যাজকরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখতে রাষ্ট্রকে চাপ দিয়ে পারিবারিক আইনকে ১৯৭১ সালে কঠিন করে বিধিবদ্ধ করল। স্রেফ ব্যভিচার এবং ধর্মান্তরিত হওয়া ছাড়া কপ্টিকদের কেউ বিয়ে-বিচ্ছেদের অধিকার হারাল। যেখানে মেয়েরা আগে চাইলে নিজেরাই বিয়ে বিচ্ছেদ করতে পারত, আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর নতুন আইনে এই অধিকার হারিয়ে ফেলল।

স্রেফ নারীরাই না, অসংখ্য সাধারণ কপ্টিকও নিজেদের পারিবারিক জীবনের জটিলতায় পড়ে যায় এই আইনের কারণে। তাদের অনেকেই পরে ‘নাগরিকের সমঅধিকার’ ধারণার ভিত্তিতে কোর্টের কাছে এসব জটিলতার প্রতিকার চাইতে গিয়ে নিজের পক্ষে রায় পায়; কিন্তু দেখা যায় সরকারের উচ্চমহলে কপ্টিক ধর্মীয় নেতাদের ক্রমাগত লবিংয়ের মধ্য দিয়ে প্রতিটা রায়কেই শেষমেশ তামাদি করে দেয়া হয়। ফলে নিজের তৈরি করা পারিবারিক আইনের ওপর হস্তক্ষেপ করা রাষ্ট্রের জন্যই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। যখনই রাষ্ট্র খ্রিস্টান আইন সংস্কার করতে গিয়েছে, এর বিরুদ্ধে এই ভাষায় প্রতিবাদ হয়েছে যে, খ্রিস্টানদের আইনে হস্তক্ষেপ সংখ্যালঘুদের ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের শামিল। খ্রিস্টান আইন যেহেতু ঐশ্বরিক, ফলে এতে রাষ্ট্র হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। 

দেখা যাচ্ছে, মুসলিম পারিবারিক আইন নিয়ে অনেক তর্ক-বিতর্ক থাকলেও, গত একশ বছরে নানান জায়গায় মুসলিম পারিবারিক আইন বারবার পরিবর্তন করা হয়েছে, মেয়েদের বৈষম্যের দিকগুলোও কমিয়ে আনা হয়েছে; কিন্তু ভিন্ন দিকে সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষার নামে তাদের পারিবারিক আইন আরও কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ল। কোনো ধরনের আলাপ-আলোচনার সুযোগতো রাখা-ই হয়নি, উল্টো কোর্টের রায়ে সংখ্যালঘুত্বের নামে বারবার নারীদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও প্রায় একই, ১৯৪৭ সালের পর মুসলিমদের পারিবারিক আইনে মেয়েদের অধিকারের ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন এলেও, হিন্দু নারীদের অধিকার নিয়ে কোনো সংস্কারই চোখে পড়ে না। এমনকি পাশের ভারতে হিন্দু নারীদের অধিকারের প্রশ্নে অনেকবার আইন পরিবর্তন করা হলেও, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অধিকারে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপের ভয়ে কেউই আইনের পরিবর্তন করতে যায়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে, রাষ্ট্রের সেক্যুলারিজম কায়েমের লক্ষ্যকে ঠিক রাখতে গিয়ে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে সংখ্যালঘু নারীদের। 

সাবা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, আমরা যাতে ভুলে না যাই নারীদের যাবতীয় বঞ্চনা সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থা ঠিক করে দেয় না, বরং উল্টো সেক্যুলার রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছ থেকেও নারীর সমতার বিষয়টা রাজনৈতিকভাবে অর্জন করে নিতে হয়। ফ্রান্সে ফরাসি বিপ্লবের পরপর তথাকথিত সেক্যুলারিজম সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেও, নারীর সম-অধিকারের বিষয়টা প্রতিষ্ঠা হয়েছে আরও প্রায় দুই শত বছর পরে। আর এই সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে রাজনৈতিক লড়াই করতে হয়েছে, কেননা সমাজে নারীর সমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই একটা রাজনৈতিক লড়াই। 

মিসরে পারিবারিক আইনের এই জটিলতা স্রেফ নিজেদের মধ্যকার জটিলতা হিসেবেই থাকেনি, দেখা গেছে অনেক কপ্টিক ছেলে-মেয়ে নিজেদের ‘অসুখী’ বিয়ে বিচ্ছেদ করতে ব্যর্থ হয়ে ধর্মান্তরের আশ্রয় নিয়েছে, যেটা মিসরের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ধর্মীয় সংঘাতকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। সাবা এ পরিপ্রেক্ষিতে মিসরের জনপরিসরে খুব আলোচিত কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেন। 

প্রথম ঘটনা, ২০১১ সালে মিসরের ইম্বাবায় একজন মুসলমান দাবি করে তার ধর্মান্তরিত স্ত্রীকে চার্চ এবং কপ্টিক সম্প্রদায়ের লোকেরা অপহরণ করে নিয়ে গেছে। এর জের ধরে সে চার্চ সংলগ্ন এলাকায় প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলে সেখানে খ্রিস্টান-মুসলমান দাঙ্গা বেধে প্রায় ১২ জন মানুষ প্রাণ হারায়।

দ্বিতীয় ঘটনা, ২০১০ সালে এক খ্রিস্টান যাজক দাবি করেন তার স্ত্রীকে একজন মুসলিম অপহরণ করে নিয়ে জোর করে ধর্মান্তরিত করে বিয়ে করেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে খ্রিস্টানরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে ফেটে পড়লে রাষ্ট্রীয় বাহিনী সেই নারীকে তার বর্তমান মুসলিম স্বামীর কাছ থেকে ‘উদ্ধার’ করে চার্চের হাতে তুলে দেয়। এটা নিয়ে সেখানে তুমুল বিতর্ক শুরু হলে, মেয়েটি মিডিয়ায় একবারের মতো এসে বলে, তাকে অপহরণও করা হয়নি, এমনকি সে ধর্মান্তরিতও হয়নি।

সাবা দেখান স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এসব ঘটনার ভিন্নভিন্ন প্রতিক্রিয়া ঘটে। একদিকে চার্চ ‘মুসলমান হওয়া মেয়েদের’ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে নিয়ে গিয়ে মেরে ফেলছে এই অভিযোগ তুলে আল-কায়েদা কয়েকটা চার্চে ‘প্রতিশোধমূলক’ বোম্বিং করে মানুষ মেরেছে। অন্যদিকে দুনিয়াজুড়ে সক্রিয় খ্রিস্টান সংগঠনগুলো দাবি করে যে, ‘প্রতারণা’ পূর্বক খ্রিস্টান মেয়েদের ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে প্রায় ৫০ হাজার খ্রিস্টান মেয়েকে মিসরে পাচার এবং অপহরণ করা হয়েছে। এসব সংগঠনগুলো জোর প্রচারণা চালিয়ে আমেরিকা এবং জাতিসংঘকে দ্রুত মিসরে হস্তক্ষেপের আহ্বান জানায়। তাদের দাবি ছিল, হয় ‘অপহরণের শিকার এসব মেয়েদের’ দ্রুত উদ্ধার করতে হবে অথবা মিসরে অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে হবে। তাদের কেউ কেউ আবার আলাপ তোলে মুসলমানদের ধর্মটাই এমন।

এসব তর্ক-বিতর্কে সক্রিয় প্রতিটি গোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক ধর্মীয় পরিচয়ের যে রাজনীতি, সেটিকে হাজির রাখার হাতিয়ার হিসাবে মেয়েদের ব্যবহার করেছে; কিন্তু মেয়েরা কখনো এসব তর্ক-বিতর্কের কর্তাসত্তা হতে পারেনি। সীতা কিংবা ‘সুন্দরী’ হেলেন থেকে শুরু করে দুনিয়ার ইতিহাস জুড়েই এমন অসংখ্য অপহরণ গল্পের অন্যতম চরিত্র নারী থাকলেও এসব কোনো গল্পেই নারীর নিজস্ব কর্তাসত্তা থাকে না। দেখা যায়, মেয়েদের সবগোষ্ঠী ব্যবহার করে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র এবং তার সংখ্যালঘু নারীদের জীবনের বাস্তবতাও এর থেকে আলাদা না। অনেক বছর আইনি লড়াই চালানোর পর, আমাদের দীর্ঘসূত্রীয় আইনি দরবারে সম্প্রতি একজন হিন্দু নারী স্বামীর সম্পত্তির ওপর মালিকানার রায় পেয়েছেন। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই এত আলাপ তোলা। আমরা জানি না এই রায় কতটুকু বাস্তবায়ন করবে রাষ্ট্র। হিন্দু নারীদের অধিকারের জন্য হিন্দু নারীদের কথা বলতে হবে, নিজের অধিকার নিজেকেই লড়াই করে অর্জন করতে হবে।


লেখক: সিনিয়র লেকচারার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //