করোনা: অতীতের শিক্ষা ভবিষ্যতের আশঙ্কা

দ্বিতীয় ধাক্কা দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে করোনা। সংক্রমণ ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়িয়ে শীতের কাঁপুনিকে আরো বাড়িয়ে তুলবে করোনা। এ ভবিষ্যদ্বাণী করছেন সারাবিশ্বের স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীরা। আমাদের ছোটবেলাটা কেটেছে রূপকথার গল্প শুনে এবং পড়ে। সেখানে দুঃখী রাজপুত্র ব্যাঙের রূপ ধরে রাজকন্যার ভালোবাসা পেত, অথবা রাজকন্যাকে বন্দিদশা থেকে মুক্ত করত। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি রূপকথার জগতে ফিরে যেতে পারতাম আর করোনার যদি কথা বলার ক্ষমতা থাকত, তাহলে করোনা হতো বিভ্রান্ত দৈত্য। বিশেষ করে বাংলাদেশের কর্তা ব্যক্তিদের বচন শুনে সে ঘাবড়ে গিয়ে দিশা হারিয়ে ফেলত। কোনটা যে সত্য আর কোনটা যে সান্ত¦না, কোনটা যে ভরসা দেবার জন্য আর কোনটা যে ভয় দেখাবার জন্য কর্তারা বলছেন, তা সে কোনোভাবেই বুঝতে পারত না। মানুষের মৃত্যু কামনা করা মোটেই শোভন নয়, সেটা মেনে নিয়েও কেউ কেউ চাইতেন করোনায় যদি এসব বাগাড়ম্বরকারী কর্তাব্যক্তিদের মৃত্যু হতো তাহলে তারা খুশি হতেন। যে কোনো রোগের কার্যকারণ আছে, তা দূর করা বা নিয়ন্ত্রণ করার বিজ্ঞানসম্মত পথ আছে, এতে সময় লাগতে পারে; কিন্তু ধৈর্য ধরে এই পথেই মানবজাতিকে এগোতে হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও হবে; কিন্তু তোষামোদির প্রবল জোয়ারে সমস্ত যুক্তি এবং পরিমিতিবোধ হারিয়ে ফেলার এক প্রতিযোগিতা দেখেছে মানুষ করোনার সংক্রমণকালে। সে না হয় হলো অতীতের কথা, এখন ভবিষ্যতের সংকট সমাধানের প্রশ্নে শাসকদের কোন ধরনের কথা শুনবে মানুষ?

  • দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য খাতে ১১ ধরনের দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য ২৫ দফা সুপারিশ দিয়েছিল বলে আমরা জেনেছি; কিন্তু সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে বা দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল কি-না তা অবশ্য জানা যায়নি। দুর্নীতিবাজ ধরা হয়েছে বলে যে শোরগোল তোলা হচ্ছে তার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট প্রশ্নটি, কীভাবে এত বড় দুর্নীতি দিনের পর দিন হতে পেরেছিল

নিকট অতীত বা চলমান করোনা সংকটে মানুষ দেখেছে সমন্বয়হীন চিকিৎসা ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাতের বেহাল দশা আর দুর্বল অবকাঠামো। চিকিৎসার প্রয়োজনে এমন কোনো বিষয় নেই, যা নিয়ে মানুষকে ভোগান্তি সহ্য করতে হয়নি। একদম শুরুতেই যখন বলা হয়েছিল সংক্রমণ রোধে সবচেয়ে কার্যকর হলো- মাস্ক, হ্যান্ড সানিটাইজার, সহজ এবং সস্তা ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি দিয়ে সাধারণ মানুষের চলাচলের স্থান জীবাণুমুক্ত করা। শুরু হয়ে গিয়েছিল এসব সামগ্রী নিয়ে ব্যবসা, দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ব্যয় বাড়ানো। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল, টেস্ট, টেস্ট এবং টেস্ট। বাণিজ্যিক তথা বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ৩৫০০ টাকা টেস্ট করার খরচ ধার্য করা এবং সরকারি হাসপাতালে টেস্টের তেমন কোনো ব্যবস্থা না থাকায়, মানুষ যে কী পরিমাণ হয়রানি এবং আতঙ্কিত হয়েছে, তা এখনো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। অক্সিজেন আর ভেন্টিলেটর নিয়ে কী হয়েছে তা উল্লেখ না করাই ভালো। এর মধ্যে সাহেদ আর সাবরিনা ওপর মহলের কিছু মানুষের সহায়তায় বিনা টেস্টে সার্টিফিকেট দেয়ার যে জালিয়াতি করেছে, তাও মানুষ আতঙ্কের সঙ্গে বহুদিন মনে রাখবে। এসব কিছু ছাপিয়ে প্রচারিত এবং উদঘাটিত হলো- নকল মাস্ক, সানিটাইজার আর পিপিই সরবরাহের ঘটনা। মানুষের সামনে একমাত্র প্রশ্ন এবং উদ্বেগ, কোথায় যাবে এবং কার কাছে পাবে চিকিৎসা ও ভরসা? করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে জাতীয়ভাবে গঠিত সমন্বয় কমিটির সমন্বয়হীনতা পদে পদে দৃশ্যমান হয়েছিল।

সব কিছু ছাপিয়ে প্রকট হয়ে উঠেছিল রাষ্ট্রের ও ক্ষমতাসীন দলের বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য। এই সরকার করোনার চেয়ে শক্তিশালী, আমাদের দেশের মতো এত উন্নত ব্যবস্থা কোথাও নেই, পৃথিবীর অনেক দেশ আমাদের কাছ থেকে করোনা মোকাবেলায় সহায়তা চেয়েছে, কোথাও কোনো সংকট নেই, করোনা নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই, করোনা এমনিতেই চলে যাবে ইত্যাদি। এসব কথায় মানুষ এটুকু বুঝেছে যে, নিজেদের ব্যবস্থা নিজেদেরকেই করতে হবে। বেশিরভাগ মানুষ এটা করতে গিয়ে রোগ লুকিয়েছে এবং নিজেদের অজ্ঞতার কারণে করোনার বিস্তার ঘটিয়েছে। সরকারিভাবে পরীক্ষার ক্ষেত্রে করোনা টেস্টের জন্য প্রথমে ৫০০ টাকা ফী ধার্য করা হয়েছিল। পরে তা ২০০ টাকায় পুনর্নির্ধারণ করা হয়। এতে রাষ্ট্রের কত টাকা আয় হয়েছে বা কত সাশ্রয় হয়েছে, তা জানা যায়নি। তবে গরিব মানুষ, যারা জীবিকার চাপে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাইরে বেরিয়েছে, কাজ করেছে তারা যে টেস্ট করার খরচ বহন করতে পারেনি, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। রাষ্ট্র যদি ১০ কোটি মানুষকে ১০টি করে মাস্ক দেয়ার ব্যবস্থা করত তাতে কত খরচ হতো? সর্বোচ্চ ৩০০ কোটি টাকা। এই পরিমাণ টাকা তো রাষ্ট্রের কাছে তেমন কোনো বড় ব্যাপার ছিল না; কিন্তু এটা করলে রাষ্ট্র একটা বড় দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে পারত। ঠিক তেমনি এক লাখ মানুষের টেস্ট বাবদ সরকার ফী পেয়েছে মাত্র ২ কোটি টাকা। এই টাকার জন্য গরিবদের টেস্ট করা ভীষণভাবে কমে গিয়েছিল। ১০ লাখ মানুষকে টেস্ট করালে এবং টেস্টের ফি আরোপ না করলে করোনা নিয়ন্ত্রণ করা আরো সহজ হতে পারত।

স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির ছিদ্রপথে কত শত কোটি টাকা যে লোপাট হয়েছে এবং দেশের সীমানা পেরিয়ে কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমিয়েছে তা মিঠু, আফজাল আর মালেকের ঘটনায় কিছুটা জানা গিয়েছে। মালেকের দরজার ছবি প্রচার মাধ্যমের কারণে আমরা জেনেছি; কিন্তু কাদের কারণে সে লুটপাটের দরজা খুলতে পেরেছিল, তা হয়তো কোনোদিনও জানতে পারা যাবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাস্থ্য খাতে ১১ ধরনের দুর্নীতি চিহ্নিত করে তা দূর করার জন্য ২৫ দফা সুপারিশ দিয়েছিল বলে আমরা জেনেছি; কিন্তু সেই সুপারিশ আমলে নিয়ে বা দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল কি-না তা অবশ্য জানা যায়নি। দুর্নীতিবাজ ধরা হয়েছে বলে যে শোরগোল তোলা হচ্ছে তার আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে ছোট প্রশ্নটি, কীভাবে এত বড় দুর্নীতি দিনের পর দিন হতে পেরেছিল? এই প্রশ্নের উত্তর বের করা না গেলে, আরো ধূর্ত এবং সতর্ক দুর্নীতিবাজের জন্ম হবে।
করোনায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। শ্রম শক্তি জরিপ অনুযায়ী দেশে কর্মক্ষম শ্রমশক্তি ৬ কোটি ৩৫ লাখ। এই শ্রমশক্তির ৮৮ শতাংশের বেশি অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের শ্রমিক। অর্থাৎ দিন এনে দিন খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ। তারা কাজ হারিয়েছে, যারা কাজ করছে তাদের আয় কমে গেছে। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৯১ শতাংশ মানুষের আয় কমেছে। তাদেরকে আর্থিক সহায়তার জন্য যা বরাদ্দ হয়েছিল তা বিতরণে অনিয়ম হয়েছে ব্যাপক। কর্মহীনতার কারণে পরিবহন, হকার, হোটেল ও দোকান কর্মচারীদের জীবনে দুর্দশা বেড়েছে, অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে। ফলে জীবন হয়েছে দুর্বিষহ। চালের বাজার চড়া এটা ক্রেতারা অনুভব করলেও সরকারি ঘোষণায় বলা হচ্ছে, সব কিছু নিয়ন্ত্রণে আছে। নিয়ন্ত্রণে আছে তা তো শোনা যাচ্ছে; কিন্তু কার নিয়ন্ত্রণে আছে সেটা বুঝলেও বলছে না কেউ।

এসব নিয়েই ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকে অক্টোবর মাসে আমরা পদার্পণ করেছি। সংক্রামক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপে করোনা পরিস্থিতি আরো কঠিন হবে। কারণ শীতে আবদ্ধ বাতাস, কাছাকাছি বসা ও চলাফেরা সীমিত হয়ে পড়ে বলে সংক্রমণের বিস্তৃতি ঘটার আশঙ্কা বেশি। বাংলাদেশে অত বেশি শীত না পড়লেও এবার শুরু থেকেই রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির মুখ থেকেই সতর্কবাণী এসেছে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী আগের মতোই বলে যাচ্ছেন; কিন্তু অনেকেই শীতের সঙ্গে করোনার সম্পর্ক নিয়ে আতঙ্কের কথা বলছেন। ভ্যাকসিন নিয়েও শুরু হয়েছে বিভিন্ন রকম কথা বার্তা। এই শীতকালীন করোনা আতঙ্ক ভ্যাকসিন গবেষণা বা ট্রায়ালের ক্ষেত্রে উদ্যোগ না বাড়ালেও বেশি দামে ভ্যাকসিন ব্যবসার এক সুবর্ণ সুযোগ হাজির করবে ওষুধ ব্যবসায়ীদের জন্য। এই দেশে বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়সহ যে কোনো দুর্যোগ বা ঈদ, পূজা, বড় দিনসহ যে কোনো উৎসব ব্যবসায়ীদের কাছে মুনাফা বাড়ানোর সুযোগ। শীতকালে নির্বাচন ও আন্দোলনের একটা ঐতিহ্য আছে। করোনার আতঙ্ক এবং ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি দুটোই চলছে সমান তালে।

ভবিষ্যতে কি পদক্ষেপ নেয়া হবে, তা নিয়ে ভাবার সঙ্গে সঙ্গে এটাও মূল্যায়ন করতে হবে অতীতের দুর্বলতা বা ঘাটতি কতটুকু এবং তা দূর করার পদক্ষেপ কী নেয়া হয়েছে? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় যা করেছে তা প্রশংসনীয় এই ঢালাও স্বীকৃতি দুর্বলতা নিয়ে সমালোচনার পথ বন্ধ করে দেবে। এ কথা ভুলে গেলে চলবে না যে, সমালোচনার কণ্ঠরোধ করে সংকট উত্তরণ এবং সম্ভাবনার পথ উন্মুক্ত করা যায় না।

রাজেকুজ্জামান রতন
কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //