দেশের স্বার্থ আগে দেখতে হবে

এটা যন্ত্রকেন্দ্রিক পার্থিব উন্নয়নের যুগ। তবে এই উন্নয়ন প্রকৃতির রূপমাধুর্য ও পরিবেশকে ধ্বংস, বিপন্ন কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত করে নয়। যন্ত্রকে বশে রেখে একে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। অন্যভাবে বলতে গেলে যান্ত্রিক সভ্যতার বিস্তার এই সুন্দর দেশের রূপমাধুর্যকে ধ্বংস করে নয়। একে আরও সুন্দর ও সৌকর্যমণ্ডিত করে গড়ে তুলতে যন্ত্রকে কাজে লাগাতে হবে। তবে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, হালে দেশের উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি সেই হতাশাব্যঞ্জক পরিণতির দিকে এগিয়ে চলেছে যেন। বিশেষত সুন্দরবনের সন্নিকটে বাগেরহাট জেলার রামপাল ও কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উন্নয়ন প্রকল্প এগিয়ে চলেছে দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থে নয় পরার্থে।

কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, ভারতীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল থারমাল পাওয়ার করপোরেশন (এনটিপিসি) ও জাপানি বহুজাতিক জাইকা বাংলাদেশে দুটি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি করছে একটা রামপালে এবং অপরটি করছে জাপানি প্রতিষ্ঠান জাইকা মাতারবাড়ী ইউনিয়নে। এছাড়াও মহেশখালীতে আরও অনেক কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে বলে শোনা যাচ্ছে। দেশে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সাধারণত মনে করা হয় দেশের উন্নয়ন হচ্ছে। সব উন্নয়ন প্রকল্পেরই ‘কস্ট-বেনিফিট’ বা লাভ-লোকসান বলে দুটি দিক থাকে। যে কোনো প্রকল্প বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে প্রকল্পের ‘কস্ট-বেনিফিট’ হিসেব পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। বলা বাহুল্য, যে প্রকল্পে লোকসানের চেয়ে লাভ বেশি সেটাই বাস্তবায়নযোগ্য হওয়া উচিত। আমাদের আরও বিবেচনায় নিতে হবে, যে সব দেশ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তাদের অভিজ্ঞতা কী।

দেখা গেছে, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উপাদন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর বলে প্রায় শতবর্ষ আগে এসব প্রকল্প বিশ্বের উন্নত দেশগুলো বন্ধ করে দিয়েছে। এ জাতীয় প্রকল্প মারাত্মক পরিবেশ দূষণ ও নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটায় বলে, তা বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশেও জনবসতি এবং সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কমপক্ষে ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটারের মধ্যে অনুমোদন দেওয়া হয় না। অথচ রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটি লোকালয় থেকে মাত্র ৯ কিলোমিটার এবং মহেশখালীতে তো লোকালয়ের প্রায় এক কিলোমিটারের মধ্যেই বাস্তবায়ন হচ্ছে। যেসব দেশ এ জাতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প বাংলাদেশে বাস্তবায়ন করছে, তাদের নিজ দেশেই লোকালয়ের এত কাছাকাছি এ জাতীয় প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি পায় না। ভারতীয় কোম্পানি এনটিপিসি বাংলাদেশের রামপালে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে সত্য। তবে এই এনটিপিসি নিজ দেশের তামিলনাড়ু এবং মধ্যপ্রদেশে এ জাতীয় বিদ্যুৎ প্রকল্প, ভারতের ১৯৭২ সালের বণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ আইনের কারণে বাস্তবায়নের অনুমতি পায়নি। ভারত সরকার প্রণীত এনভায়রনমেন্ট ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসম্যান্টের (ইআইএ) নির্দেশনা অনুসারে লোকালয়ের বা বনাঞ্চলের ২৫ কিলোমিটারের ভেতরে কোনো প্রকার কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যাবে না। অথচ বাংলাদেশ ভারতীয়সহ অন্যান্য বহুজাতিক কোম্পানিকে অনুরূপ প্রকল্প বাস্তবায়নের অনুমতি দিয়ে যাচ্ছে।

অধিকন্তু পরিবেশ ও প্রকৃতি ধ্বংসের দিক থেকে কয়লার স্থান ফসিল জ্বালানির পরেই। সে কয়লা জ্বালিয়েই বাংলাদেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ৬৩ গুণ বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় ভারত, চীন, যুক্তরাজ্য ও জাপানের মতো কয়েকটি দেশ প্রভাবকের ভূমিকায় আছে। দেশের ভেতরে এর বিরুদ্ধে সচেতন মানুষের ব্যাপক আন্দোলন সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কেন কয়লাকে আঁকড়ে ধরেছে সেটা ভাবার বিষয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, তাপবিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা সর্বাধিক ‘নোংরা’ ও ‘ক্ষতিকর জ্বালানি’ হিসেবে সমালোচিত। জ্বালানি হিসেবে কয়লা বিষাক্ত সালফার-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন-ডাই-অক্সাইড, বাতাসে ভাসমান ধূলিকণা (পিএম ২.৫), কয়লার ছাই এবং এসিড নির্গমন করে পানি ও বাতাসকে দূষিত করে। এ ছাড়াও দুরারোগ্য ব্যাধি এবং অকালমৃত্যুর কারণ হতে পারে এমন ‘ভারি ধাতু’ যেমন- সিসা, পারদ ও ক্রোমিয়াম পোড়া কয়লা থেকে নির্গত হয়। এ কারণে কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ প্রকল্পসমূহ জীব ও পরিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করতে পারে।

রামপাল তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত পশুর নদীপথে বছরে ৫০ লাখ টন আমদানিকৃত কয়লা বহন করতে হবে বলে কয়লার ভাঙা টুকরা ও জাহাজের তেল সুন্দরবনের ইকোসিস্টেম পুরোপুরি নষ্ট করে দেবে। এতে করে সুন্দরবনের কাছের পশুর নদী ও মাতারবারড়ীর পাশের কুহেলিকা খালের, যা বঙ্গোপসাগরের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, মৎস্যসম্পদ অচিরেই নিঃশেষ হয়ে যাবে। উপরন্তু হাজার হাজার টন বিষাক্ত সালফারযুক্ত ছাই ভূ-উপরিস্থিত পরিবেশের বাতাসে মিশে গাছপালা ও প্রাণিদের জীবনকে বিপন্ন করে তুলবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জমিতে উৎপাদিত ফসল-শাক-সবজি খেলে মানবদেহে অ্যাজমাসহ ফুসফুসবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়বে। এমনকি ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধিও মহামারি আকারে দেখা দিতে পারে।

এ ছাড়া তাপবিদ্যুতের জন্য প্রতিদিন যে ৭২টি গভীর নলকূপের দ্বারা ১৪৪ কিউসেক ভূগর্ভস্থ মিঠাপানি উত্তোলন করা হবে, তাতে করে ভূগর্ভস্থ মিঠাপানির মজুদ অতিদ্রুত নিঃশেষ হয়ে যাবে। এতে করে বিভিন্ন স্থাপনা দেবে গিয়ে প্রায় ৮ হাজার পরিবার তাদের জমি থেকে উচ্ছেদ হবে। মহেশখালীর ক্ষেত্রেও অনুরূপ কয়লা বিদ্যুতের প্রভাবে প্রায় দেড় লাখ মানুষ জীবিকাহীন হয়ে উদ্বাস্তুতে পরিণত হবে। এসব কথা জেনেও সরকার এ পথেই এগোচ্ছে।

বাংলাদেশের একমাত্র কয়লানির্ভর তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র বর্তমানে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়ায় অবস্থিত। এটি মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পাওয়ার প্ল্যান্ট। বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু হওয়ার পর থেকেই সেখানে নানাবিধ সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। প্রথমত, বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রয়োজনে ভূগর্ভস্থ পানি টেনে নেওয়ার ফলে এলাকাবাসী দৈনন্দিন কাজে ব্যবহার উপযোগী এবং চাষাবাদের জন্য পানি পাচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, কেবল ২৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষম এই কেন্দ্রটি চালু রাখতে কয়লা জ্বালাতে হয় প্রতিদিন ২ হাজার ৪০০ টন। এতে করে প্রতিদিন যে ৩০০ টন ছাই উৎপন্ন হয়, তাতে পুরো এলাকা ছেয়ে যাচ্ছে। এই ছাই মিশ্রিত পানি চুইয়ে মাটির নিচে ও পার্শ্ববর্তী জলাভূমিতে গড়িয়ে যাচ্ছে। এর আশপাশে দেখা যায় বিদ্যুৎকেন্দ্রের নালা বেয়ে কয়লা ধোয়া কালো পানির স্রোত পার্শ্ববর্তী কৃষি জমিতে মিশে জমির রঙ এখন নিকষ কালো হয়ে গেছে। মাত্র ২৫০ মেগাওয়াট কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশদূষণের এই যদি আংশিক চিত্র হয়, তবে ১৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল এবং ১২০০ মেগাওয়াটের মহেশখালী কয়লা নির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্রের পার্শ্ববর্তী এলাকার জনবসতি, পরিবেশ এবং কৃষিজমির কি দশা হবে তা সহজেই অনুমেয়। এটা বিদ্যুৎ জ্বালানিনির্ভর যুগ সত্য। বিদ্যুৎ না হলে আধুনিক সভ্যতা অচল। এর মানে এই নয় যে, মানব জীবন লালনকারী প্রকৃতিকে ধ্বংস করে এর জোগান নিশ্চিত করতে হবে।

সারওয়ার মো. সাইফুল্লাহ্ খালেদ
অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //