ইয়াবা-অস্ত্র ও রোহিঙ্গা ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতের নেপথ্য অন্ধকারের বিপদ

বাংলাদেশ রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে খাবি খাচ্ছে। কারণ নানাবিধ। শরণার্থী কেন্দ্রগুলোতে অপরাধপ্রবণতাও প্রতিদিনই নতুন মাত্রা পাচ্ছে। মাত্র দুই বছরে খুনের ঘটনা ঘটেছে প্রায় একশ’টি। তার মাঝে ৬৮টিই ক্রসফায়ারজনিত। অন্য মৃত্যু ও খুনগুলোও অন্তর্দলীয় সংঘাতের ফল। 

২০১৭ সাল হতে ফি বছর খুন, অপরাধ, মাদকজনিত সংঘাত, ডাকাতি, মাদকের চালান উদ্ধার সবকিছুই বেড়েছে জ্যামিতিক হারে। মনে করা হচ্ছে, খুনোখুনির কারণ মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা। এ বছরের ৮ অক্টোবর প্রকাশিত আমাদের সময় পত্রিকার অনুসন্ধানী প্রতিবেদন মতে, রোহিঙ্গাদের বিরূদ্ধে মামলা হয়েছে ৭৩১টি। আসামি ১ হাজার ৬৭১ জন। অথচ মাত্র এক বছর আগে মাদক-সংক্রান্ত মামলা ছিল ৭৯টি। তালিকায় মাত্র ১৩ নেতৃস্থানীয় রোহিঙ্গা শরণার্থীর নাম ছিল। গ্রেফতার হয়েছিল ১১১ জন রোহিঙ্গা (প্রথম আলো, ২৬ আগস্ট ২০১৮)। গত ৩ হতে ৭ অক্টোবরে একাধিকক্রমে কয়েকটি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

কথা হচ্ছে এসব ভীতিকর অবস্থার জন্য কি সব রোহিঙ্গাকে দায়ী করা যাবে? উত্তর ‘মোটেই না’। রোহিঙ্গাদের এক ভাগেরও কম অপকর্মে জড়িত। নিরানব্বই ভাগই নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষ। তাদের চাওয়া একটিই- জন্মস্থানের মাটিতে ফেরা। মানুষের মর্যাদা ও সম্মান নিয়ে বাঁচা; কিন্তু অপরাধপ্রবণতার ছোঁয়ায় ও দ্রুত স্বচ্ছল হয়ে ওঠার আশায় যে এক ভাগের বদলে দশ ভাগ কুড়ি ভাগই অপরাধকর্মে নেমে পড়বে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? যতই দিন যাবে, বিপদ ততই বাড়বে। 

মাদক অস্ত্রের অনুষঙ্গ। মাদক বিক্রি করেই সন্ত্রাসবাদীরা অস্ত্র ক্রয়ের জন্য অর্থ সংস্থান করে। সন্ত্রাসবাদ একবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠলে সন্ত্রাস নির্মূলের ছুতায় অন্য ক্ষমতাশালী দেশের বা দেশপুঞ্জের আগ্রাসনের উদাহরণের কমতি নেই। হিরোইন বিক্রির অর্থে অস্ত্র কিনতো বলে তালেবানের বিরূদ্ধে অভিযোগ আছে। ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে আবু সায়াফ গ্রুপ ও আনসার খলিফা ফিলিপাইন্সসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীর অস্ত্র ক্রয়ের মূল উৎস মাদক চোরাচালান। 

জাতিসংঘের ড্রাগ ও অপরাধ কার্যালয়ের বিস্তারিত নথিপত্রের আলোকে র‌্যান্ড ইউরোপের ২০১৭ সালের রিপোর্টেও উল্লেখিত হয়েছে যে, মাদক বিক্রির অর্থ দ্বারাই সন্ত্রাসবাদী দলগুলো অস্ত্র কেনে।

উত্তর আমেরিকায় ফ্রি রোহিঙ্গা কোয়ালিশন নামে প্রবাসী রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন সম্প্রতি এক ওয়েবিনারে এমন একটি ধারণা দেয় যে, মাদক ও অস্ত্র বাণিজ্যচক্রের বাড়বাড়ন্ত উত্থানের পেছনে মায়ানমারের সরকার ও সামরিক বাহিনীর হাত রয়েছে। অনুমেয় যে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি অবাস্তব ধারণা নয়। রোহিঙ্গাদের নানা উপদলে বিভক্ত ও বিবাদমান রাখা গেলে তারা আর সম্মিলিত শক্তিতে বলীয়ান হতে পারবে না। যতো বেশি বিভক্তি, ততো খুন-খারাবি সংগঠিত হবে। মিয়ানমার আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ততোই জোর গলায় বলতে পারবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র বাহিনীদের মিয়ানমার ফেরত নেবে না। মিয়ানমারের অবস্থানটি যৌক্তিকও শোনাবে। 

বর্তমানে রাখাইন প্রদেশে আরাকান আর্মির সাথে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সংঘাত-সংঘর্ষ চলছে। এই বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠীর সমরশক্তি প্রবাদপ্রতীম। মিয়ানমারের সেনাসদস্যরা আরাকান আর্মির হাতে রীতিমত নাস্তানাবুদ হচ্ছে। জানা গেছে, এই বাহিনীর হাতে স্থল হতে আকাশে নিক্ষেপযোগ্য অত্যাধুনিক মিসাইলও আছে। আরাকান আর্মিও ইয়াবা ও মাদক চোরাচালানের মাধ্যমে অস্ত্র কেনার টাকা যোগায় সন্দেহটিও বাজারে চালু  আছে। মাদক-বাণিজ্য সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ আছে খোদ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধেও।

মাদক নিঃসন্দেহে হাজার-কোটি টাকার বাণিজ্যে পরিণত হয়েছে। পাচারের মুল অর্থ মিয়ানমারেই যাবার কথা। ২০১৮ সালেই রিপোর্ট হয়েছে যে, মিয়ানমার সীমান্তে কমপক্ষে ৪০টি ইয়াবা ফ্যাক্টরি, ১০টি এজেন্সি ও ক্যাম্পভিত্তিক ৫০০টি বিক্রি-বিপননের আখড়া আছে (প্রথম আলো ২৬ আগস্ট)। ২০২০ সালে এসে সেগুলো যে কয়েকগুণ বেশি বেড়েছে তা সহজেই অনুমেয়। সম্প্রতি ধরা পড়া ১৩ লাখ ইয়াবার বাজারমূল্য ৪০ কোটি টাকা (ভোরের কাগজ, ৮ অক্টোবর, ২০২০)। সেই হিসেবে গত তিন বছরে ধরা পড়া সোয়া দশ কোটি ইয়াবার মূল্য কয়েক হাজার কোটি টাকা। এটি শুধুই ধরা পড়া ইয়াবার বাজারমূল্যের হিসাব। হয়ত ৯৫ ভাগই ধরা পড়েনি। সে ক্ষেত্রে সাধারণ গণিতের হিসাবেই বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের মাদক অর্থনীতি হাজার কোটি টাকার।

যারা এ রকম হাজার কোটি টাকার অর্থনীতির মূল পান্ডা, তারা কখনোই চাইবে না আম-রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে ফেরত যাক। ক্যাম্পনিবাসী দূর্গত ১০ লাখ মানুষকে জিম্মি করে সশস্ত্র অপরাধ করবে হয়ত হাজার পাঁচেক বা দশেক রোহিঙ্গা; কিন্তু সবাই দূষবে ১০ লাখ নিরীহ আটকে পড়া ভীতগ্রস্ত রোহিঙ্গাদের। মানবের স্বভাবই এমন যে, সে খুব সহজেই অতিসরলীকরণ করে বসে; কিন্তু ন্যুনতম মানবিক বিবেচনাবোধ হতে মূল্যায়ন করতে গেলেই বুঝা সহজ যে অস্ত্রের মুখে বা হত্যার হুমকির মুখে অসংখ্য নিরীহ ও নিরপরাধ রোহিঙ্গা ব্যক্তি ও পরিবার অপরাধচক্রের ক্রীড়নক হতে বাধ্য হবে। শিশু ও নারীদের আরো নারকীয় দুর্গতির মুখোমুখি হতে হবে। অস্ত্রের মুখে ফেলে যে কাউকে দিয়েই যেকোনো কিছু করানো সম্ভব। এই ভীতিকর অবস্থাটি যেন তৈরি হতে না পারে, সেজন্য বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক পরিমন্ডল হতে অপরাধ-নির্মূল সহায়তা গ্রহণের কোনোই বিকল্প নেই। 

কিন্তু বিপজ্জনক সত্য এই যে, মিয়ানমার বাংলাদেশের সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নির্মাণের ঘোরতর বিরোধী। দেশটির একটিই কথা রোহিঙ্গা সমস্যা বা সংকটের সমাধান হতে হবে শুধুই দ্বিপাক্ষিক। বাংলাদেশ দ্বিপাক্ষিকতার প্রতি যথার্থ সম্মান দেখিয়েই ২০১৭ সালেই রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন চুক্তি করেছিল। কূটনীতি-প্রক্রিয়ার প্রথম ধাপ হিসেবে চুক্তিটিকে নির্দোষ বলা চলে। শুরুতেই আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ কামনা করলে মিয়ানমার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ঘোড়া ডিঙ্গিয়ে ঘাস খাবার অভিযোগ তুলত। ছুতা তৈরি করত যে বাংলাদেশ যেহেতু দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়ায় সমাধানে যায়নি, দেশটি কোনো দায়িত্ব নেবে না। এই বলে গোয়ার্তুমি ও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়গো- ‘দেখি তোমরা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ দিয়ে কীভাবে কী করতে পারো!’ 

সেই অর্থে দ্বিপাক্ষিক চুক্তিটি অকূশলী না হলেও মিয়ানমারের ছলছুতো বানানো, সময়ক্ষেপণ করা ও কূটকৌশলের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। গাম্বিয়া ইসলামিক সম্মেলন সংস্থার হয়ে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে মায়ানমারের গণহত্যার বিরূদ্ধে মামলা করায় মিয়ানমার বাংলাদেশের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। সম্প্রতি দেশটি বাংলাদেশকে নানারকম যুদ্ধংদেহি উস্কানি দিতে শুরু করেছে। পাশাপাশি জাতিসংঘে বসেই বাংলাদেশকে সংকটের জন্য দায়ী করে হুমকি দিতে দ্বিধা বোধ করেনি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় মিয়ানমার বাংলাদেশকে প্রকারান্তরে এরকম হুমকিই দিয়েছে যে, আন্তর্জাতিক মহলের হস্তক্ষেপে সংকট সমাধানের চেষ্টা কোনোই কাজে আসবে না। আরো দায়ী করে বলেছে যে, বাংলাদেশ শুধু অসযোগিতাই করছে না বরং ক্যাম্পে সশস্ত্র সন্ত্রাসবাদে মদদ দিচ্ছে। মিয়ানমার অবলীলায় এই মিথ্যাটি জাতিসংঘে বসেই করেছে।

এ কথা সত্য যে, বাংলাদেশের পক্ষ হতে মিয়ানমারকে আলোচনার টেবিলে বসানোর চেষ্টার তেমন ঘাটতি ছিল না। মিয়ানমারই ছলাকলা ও সময়ক্ষেপন কৌশল নিয়েছিল। তবুও মিয়ানমারের হুমকি যে ‘একমাত্র’ দ্বিপাক্ষিক প্রক্রিয়াই তার কাছে গ্রহণযোগ্য এবং ‘বাংলাদেশ যেন যথার্থ আচরণ করে’ বক্তব্য সব বিবেচনাতেই উস্কানিমূলক! ভয় করার কারণ রয়েছে যে মিয়ানমার মাদক, অস্ত্র বাণিজ্য ও ভ্রাতৃঘাতি সঙ্ঘাত জিইয়ে রেখে বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল নিতে পারে। রোহিঙ্গা-নির্ভর অপরাধের রাশ এখনই টেনে ধরা না গেলে বাংলাদেশকে সীমাহীন সমস্যার মূখোমুখি হতে হবে।

লেখক: অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //