‘খুঁটি’ সমাচার

খুঁটি শব্দটির সাথে পরিচয় আমার ছোটবেলা থেকে। আমার সর্বজন শ্রদ্ধেয় নিঃসন্তান বড় চাচাকে দেখতাম জলচকিতে বসে আটচালা ঘরের মাঝের খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে পিতলের হুকার কাঠের নল টেনে আয়েশ করে তামাক সেবন করতেন। আসলে ঝড়-বাদলে ঘর খাড়া রাখতে হলে খুঁটির জোর চাই। তাই ছোটকাল থেকেই জানি ঘর টিকে থাকে খুঁটির জোরে। এ খুঁটির নিচের অংশ মাটির নিচে গাড়া থাকে। 

এমনো কোনো কোনো অঞ্চল আছে, যেখানে ঘরের খুঁটি মাটির নিচে গাড়া হয় না। এক্ষেত্রে ঘরের ভিত্তি তৈরির পর খুঁটির নিচে পাথরের মজবুত পাটা রাখা হয়। এতে সুবিধা এই যে, প্রচণ্ড ঝড়-বাদলে পাটার উপরের ঘরটি খুঁটিসমেত উড়ে যায় না ও জান-মালের ক্ষতি হয় না বললেই চলে। এ পদ্ধতিতে নির্মিত ঘর খুঁটির জোরেই টিকে থাকে, তবে এই খুঁটি রক্ষকের ভূমিকা পালন করে, ভক্ষকের নয়। তাই এ পদ্ধতিতে নির্মিত ঘর নিরাপদ থাকে। পক্ষান্তরে মাটির নিচে পোঁতা খুঁটির ঘর ঝড়-বাদল যত প্রচণ্ডই হোক না কেন, খুঁটিসমেত ঘরটি ভিটার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে ঘরের ভেতরের জান-মালের ক্ষতি করে। এ খুঁটি ঘরের নিরাপত্তার জন্য প্রশস্ত হলেও ও ঝড়ের তীব্রতাভেদে গৃহবাসী অনিশ্চিত নিরাপত্তা পেলেও গৃহের বাসিন্দা ও অস্থাবর সম্পত্তির জন্য সব সময় নিরাপদ নয়। এ খুঁটি ঘরের নিরাপত্তার পক্ষে হলেও বিপদে ঘরের বাসিন্দা ও আসবাবপত্রের নিরাপত্তার পক্ষে বলা চলে না। তাই পাটার ওপর দাঁড়ানো খুঁটিকে আমরা ঘরের বাসিন্দা ও আসবাবপত্রের নিরাপত্তার পক্ষে যথার্থ বললে ভুল হবে না। 

আরেক প্রকার খুঁটি হলো গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি ঘাসক্ষেতে চড়ার সময় ব্যবহার করা হয়। এ জাতীয় পশুদের ঘাসক্ষেতের সীমানার ভেতর আটকে রাখার জন্য গলায় দড়ি বেঁধে খুঁটির সাথে আটকে রাখা হয়। গরু, মহিষ জাতীয় পশুর মধ্যে যেগুলো বলদ তারা গোবেচারার মতো খুঁটির বাঁধন মেনে মাথা নত করে শান্তভাবে ঘাস খায়। খুঁটিতে তেমন টান পড়ে না। ছাগল ভেড়ার ক্ষেত্রেও সাধারণত সে রকমই দেখেছি। তবে মাঝে-মধ্যে গোল বাধায় ষাঁড় ও ছাগল। এরা খুঁটির বাঁধন মানতে চায় না। ষাঁড় প্রায়শই খুঁটি উপড়ে দৌড় দেয়। পাশের ক্ষেতের ফসল নষ্ট করে। ছাগল কমজোর হওয়ায় তা পারে না তবে কুঁদে। আশপাশের জমির ফসল খেতে বা প্রতিপক্ষের প্রতি ক্ষেপে সে আস্ফালন করে বা কুঁদে। প্রতিপক্ষের শক্তি যাই হোক সে বুঝে দড়ি ছেঁড়ার বা খুঁটি উপড়াবার সাধ্য তার নেই; তাই সে দ্বিগুণ উৎসাহে কুঁদে। তার দড়ি ছেঁড়ার বা খুঁটি উপড়াবার যেহেতু ক্ষমতা নেই তাই তার বিপদেরও সম্ভাবনা নেই, তাই সে কুঁদে কুঁদে ঘাড়ের ছাল তুলে ফেলে। খুঁটিবদ্ধ ছাগলের এই কুঁদে থেকেই ‘ছাগল কুঁদে খুঁটির জোরে’ প্রবাদের উৎপত্তি। এ প্রবাদের ব্যাপ্তি ছাগলের স্বভাব ছাড়িয়ে মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ে। রূপকার্থে এ জাতীয় খুঁটি থাকলে মানুষও ক্ষেত্রবিশেষে কুঁদে।

আমাদের দেশে চাকরির ক্ষেত্রে মামা, চাচাসহ বিভিন্ন প্রকার জোরের কথা আমরা অহরহই শুনে থাকি। এ জাতীয় খুঁটির জোর থাকলে সমাজে ও কর্মজীবনে ব্যাপক প্রভাব প্রতিপত্তি লাভ করা যায়। ইদানীং রাজনীতিতেও এ জাতীয় খুঁটির জোরের তেলেসমাতি দেখা যায়। পিতা, মাতা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী অনেকের ক্ষেত্রে খুঁটি হয়ে শক্তি জোগাচ্ছে। এসব খুঁটির জোরে জীবনে অনেকে ঝড়-ঝাপ্টা উতরে চলা যায়। আমাদের দেশের রাজনীতিতে হাল আমলে এর চল শুধু ব্যাপক নয় মহামারি আকার ধারণ করেছে। এরা নিয়ম-কানুন মানে না ‘খুঁটি’কে সেলাম করে রবি ঠাকুরের ভাষায় বলার চেষ্টা করে ‘ন্যায় অন্যায় মানিনে মানিনে, শুধু তোমারে মানি’। জীবনে তরিক্কি বা সাফল্য লাভে খুঁটির জোরই সর্বেসর্বা। তাই সবাই হন্যে হয়ে খুঁটি লাভের সাধনায় ব্যস্ত।

এ শুধু জাতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রেই নয় আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যেমন ইসরায়েলের খুঁটি যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা বিশ্ব। এ খুঁটির জোরে ক্ষুদ্রায়তনের ইসরায়েল বিশাল মধ্যপ্রাচ্যকে ধরাশায়ী করে রেখেছে। এমনকি মাঝে-মধ্যে খুঁটি উপড়ে ইসরায়েল পার্শ্ববর্তী কোনো কোনো দেশে হানা দেয়। আন্তর্জাতিক চাপে এর মনিবেরা রে রে করে ওঠে। তখন শান্ত হয়। তাইওয়ানও খুঁটির জোরে বিশাল চীনকে টেক্কা মেরে দীর্ঘদিন জাতিসংঘের ভেটো পাওয়ার ভোগ করেছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবা খুঁটির জোরে পরাক্রমশালী পুঁজিবাদী যুক্তরাষ্ট্রের নাকের ডগায় ভিমরুলের মতো বহু বছর ধরে টিকে আছে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এ জাতীয় আরও উদাহরণ দেয়া যাবে। 

যেকোনো সভ্যদেশের সরকারের খুঁটি সে দেশের জনগণ। তবে সরকারের এ খুঁটি পাটার ওপর নির্মিত ঘরের খুঁটির মতো। গণজোয়ারে সরকার উড়ে যায়; কিন্তু জনগণ ও তাদের সম্পদ অক্ষুণ্ন থাকে। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক পদ্ধতির সরকার এ জাতীয় সরকারের আদর্শ উদাহরণ। জনগণ নামক খুঁটির জোরে সেখানে সরকার টিকে থাকে আবার জনগণের জানমাল অক্ষুণ্ন রেখেই প্রয়োজনে সরে পড়ে। পশ্চিমা দেশগুলোর প্রায় সর্বত্রই সেরকম দেখা যায়; কিন্তু আমাদের মতো দেশের সরকার প্রায়ই মাটিতে পোঁতা খুঁটির জোরে টিকে থাকে। যখন সরকার পড়ে জনগণের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কারণ জনগণ এদের খুঁটি নয়। এদের খুঁটি হলো দলীয় কর্মী, রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন বাহিনী। এমন কি বহির্বিশ্বের কোনো শক্তিধর দেশও এদের খুঁটি হিসেবে কাজ করে। তাই এ জাতীয় সরকার যখন পড়ে যায়, তখন রাজপথে জনগণের লাশ ও রক্তের দাগ রেখে যায়। পাটার ওপর খুঁটির ঘরের মতো গণচাপে আলগোছে উড়ে যায় না। আমাদের দেশে এ দু’জাতীয় সরকারেরই উদাহরণ আছে। 

দূর অতীতে না গিয়ে নিকট অতীত ও বর্তমান সরকারের কথাই বলি। ১৯৯৬ সালে বিএনপিদলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে জিতে প্রতিবাদের মুখে পাটার ওপর স্থাপিত খুঁটির ঘরের মতো আলগোছে উড়ে গেছে। জনগণ বা জানমালের কোনো ক্ষতি হয়নি। আবার ২০০৬ সালে বিএনপি ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার প্রাক্কালে রাজপথে রক্তপাত হয়েছে। পাটার ওপর স্থাপিত খুঁটির ঘরের মতো আলগোছে উড়ে যায়নি। আবার ২০১৪ সালের ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার মাটিতে পোতা খুঁটির ঘরের মতো এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে, এদের পতন হলে এদেরই ভাষায় ‘পাঁচ লাখ লোক’ মারা পড়বে।

এদের খুঁটি দেশের জনগণ নয়। কারণ উপর্যুক্ত উভয় নির্বাচনে জনগণ স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেনি। তাই তাদের ভয় ক্ষমতা হারালে তাদের ‘পাঁচ লাখ লোক’ প্রাণ হারাবে। তাই ছাত্র, শ্রমিক ও নানা পেশার মানুষ অভাব-অভিযোগ নিয়ে প্রতিনিয়ত নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম ও দেশব্যাপী অরাজকতার মুখে তারা খুঁটির জোরে ক্ষমতায় টিকে আছে। দেখিয়া-শুনিয়া মনে হয় চারদিকে কেবল খুঁটির জয়-জয়কার।

লেখক: অর্থনীতির অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //