দারিদ্র্য, ভয় ও সহিংসতা

ঠাকুরগাঁও জেলার রাণীশংকৈল উপজেলার ধর্মগড় ইউনিয়নের ভরনিয়া শিয়ালডাঙ্গি গ্রামে গত ১৫ অক্টোবর আরিফা ও তার শিশু পুত্র-কন্যার মরদেহ তাদের বাড়ির পাশের পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। পরের দিন মৃত আরিফার ঘর থেকে পুলিশ একটি চিঠি খুঁজে পায়। 

চিঠিটি আরিফার লেখা। তিনি লিখেছেন, ‘আহারে জীবন। সংসারের অভাব অশান্তি আর ভালো লাগে না। আমি একাই চলে যেতাম; কিন্তু একা গেলে আমার বাচ্চারা মা মা বলে হাহাকার করবে। এ জন্য ওদের নিয়েই চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়।’ 

আরিফার স্বামী একটি এনজিও থেকে ১৪ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন সংসারের অভাব মেটানোর জন্য; কিন্তু চারদিকের স্বচ্ছল জীবনের পাশে বঞ্চনা ও অনটনের জীবন আরিফার কাছে এতটাই অবমাননাকর, মানহানিকর হয়ে উঠেছিল যে- তিনি তা মানতেই পারেননি।

বাজারের তৈরি করে দেয়া প্রত্যাশা পূরণ না হওয়ার চেয়ে প্রাণত্যাগ করার পথ শ্রেয়তর- এই বোধ মানুষের মনে জন্মানোর পেছনে বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবশ্যই দায়ী। সারাদুনিয়ায় ফলাও করে প্রচারিত হয়- দরিদ্র মানেই মর্যাদাহীন, দারিদ্র্য একটি অভিশাপ। কার অভিশাপ? কেন্দ্রীভূত পুঁজির অভিশাপ বলেই তো মনে হয়।

এ রকম সংবাদ প্রায়ই দেখা যাচ্ছে আজকাল- ঈদে নতুন জামা না পেয়ে কিশোরীর, পরীক্ষায় এ প্লাস না পাওয়ায়, অভাবের অপমানে সন্তানদের হত্যা করে পিতার ও চাকরি হারিয়ে বা ঋণশোধ না করতে পারার গ্লানি থেকে আত্মহত্যা ইত্যাদি। অভাব তো আগেও ছিল। দারিদ্র্য অবশ্যই হতাশার জন্ম দেয়। এরসাথে যখন যোগ হয় বৈষম্যতাড়িত ব্যক্তির অন্তঃস্থ বঞ্চনাবোধ, তখনই জন্ম হয় সহিংসতার। আত্মহত্যার প্রবণতা সহিংস নিশ্চয়, প্রিয়জনদের হত্যা করে আত্মহত্যা করা অবশ্যই ততধিক সহিংস। 

এখন কভিড-১৯ এর ধাক্কায় কাজ হারিয়ে যে পঞ্চাশ হাজারেরও বেশি পরিবার নগর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গোল বাঁচতে, সঞ্চিত খোরাক শেষ হবার আগে গ্রামে যদি তাদের কর্মসংস্থান না হয়, তাহলে তাদের মধ্যে কোন প্রবণতা দেখা দিতে পারে, তা ভেবে শঙ্কা জাগে বৈকি।

গত জুন মাসে বিআইডিএসের এক গবেষণায় দেখা যায়, করোনার কারণে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে পড়ায় দেশের ৯৫ শতাংশ পরিবারের উপার্জন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কাজ হারিয়েছে ৩৬ শতাংশ মানুষ। নতুন করে দারিদ্র্যের কাতারে যুক্ত হয়েছে ১ কোটি ৬৪ লাখ মানুষ। অন্যদিকে ব্র্যাকের জরিপে দেখা যায়, ৭৫ শতাংশ নিম্নবিত্ত মানুষের আয় কমেছে। দরিদ্রদের মধ্যে ৮৯ শতাংশই নেমে গেছে অতি দরিদ্রের কাতারে। ১৪ শতাংশ মানুষ খাদ্যসংকটে আছে। 

এদিকে নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সবজিসহ সব রকম খাবার চলে যেতে শুরু করেছে মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে। আয় কমে যাওয়া ও নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার ফলশ্রুতিতে দারিদ্র্য পরিস্থিতিকে দ্রুতই নিম্নগামী করে দিচ্ছে। ২০১৬ সালে দারিদ্র্যের হার ২৪ শতাংশে উঠলেও এখন পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদনে তা দেখা যাচ্ছে ২৯.৪ শতাংশে নেমেছে। 

দারিদ্র্যের হীনম্মন্যতার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা হয়ে বর্ষিত হচ্ছে কেবলই দুঃসংবাদ। ইউনিসেফ দেখাচ্ছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার পরও অনেক পরিবারের শিশুরাই আর স্কুলে ফিরবে না। তারা শিশুশ্রমে নিযুক্ত হবে, অপুষ্টিতে আক্রান্ত হবে। মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের যে শিশুরা মাসের পর মাস ঘরে আটকে আছে, অদূর ভবিষ্যতে তাদের স্বাভাবিক জীবনে ফেরানো কঠিন হবে। ঘরে থেকে এদের দেখতে হচ্ছে সংসারের টানাপড়েন, মা-বাবার অস্থিরতা আর টেলিভিশনে প্রচারিত ভয়াবহ সব সংবাদ! এ পরিস্থিতির মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব মানুষের ওপর নিশ্চয়ই পড়বে।

একদিকে হঠাৎ দারিদ্র্যসীমার মধ্যে পতিত বিশাল জনগোষ্ঠী, অন্য দিকে একের পর এক এমন সব ঘটনা প্রকাশ পাচ্ছে, যাতে প্রমাণ হয় যে, দেশের বেশ কিছুসংখ্যক মানুষ দুর্নীতির মাধ্যমে অস্বাভাবিক সম্পদের অধিকারী হয়ে উঠেছে। সরকারি অফিসের ড্রাইভার, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী, পুলিশের এসআই, রাজনৈতিক নেতা, ক্ষমতা সমর্থিত ঠিকাদার পর্যন্ত যে পথে ধনী হতে পেরেছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আয়ের সাথে বৈষম্য বাড়িয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন বৃদ্ধি করেও দুর্নীতি কমানো সম্ভব হচ্ছে না; সহনীয় মাত্রায় ঘুষ নেয়ার পরামর্শ দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতিকে বৈধতা দিতেও দেখা গেছে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছ থেকে। 

সেই সাথে ধর্ষণ বেড়েছে, পুলিশের হাতে সংঘটিত হচ্ছে হত্যাকাণ্ড; কিশোর গ্যাং নামের অপরাধী চক্রের উত্থান ঘটেছে; পারিবারিক কলহের জের ধরে হত্যা করা হচ্ছে শিশু; জনপ্রতিনিধিদের ঘরের মাটির তলা থেকে বের হচ্ছে দরিদ্রদের জন্য বরাদ্দকৃত চাল ও টাকা; কিন্তু কোনোকিছুরই প্রতিকার হচ্ছে না। এসব থেকে মানুষের মনে ক্রমেই এই ধারণা সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে যে বিপদগ্রস্ত হলে ক্ষমতাহীন দরিদ্র মানুষের হাতে উদ্ধার পাবার উপায়গুলো দুর্বল বা অকার্যকর। অপরাধ করে পার পাবার একাধিক গুপ্তদুয়ার খোলা আছে ক্ষমতাবানের জন্য। এসব জীবনের সাহস সংকুচিত করে দেয়। বেঁচে থাকাটাই হয়ে ওঠে ভয়ের। একদিকে দারিদ্র্য অন্য দিকে ভয়। ধর্ষণের, ছিনতাইয়ের, খুন হবার, অপমানিত হবার, বিচারহীনতার এবং কথা বলতে ভয়। ফলে মানুষের বিরাট অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা দরিদ্র-নিম্নবিত্ত জনগোষ্ঠীর মানসিক ভারসাম্যের ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। এরকম পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের পক্ষে সহিংস হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে। অপেক্ষাকৃত সবলেরা সহিংসতার প্রকাশ ঘটায় দুর্বলের ওপর। আর দুর্বলেরা ব্ল্যাকআউট করে দিতে চায় নিজেকেই। মানুষ রাষ্ট্রের প্রতি বিশ্বাস এতটাই হারিয়ে ফেলেছে যে কেউ কেউ ক্ষোভে বলছেন- এ রাষ্ট্র আমার নয়! 

কাজেই নাগরিকদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি ফিরিয়ে আনতে হলে সব শ্রেণির মানুষের মনোসামাজিক সেবার কথা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। আমরা যেন ভুলে না যাই, বৃহত্তর দৃশ্যমান প্রকল্প বাস্তবায়নের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবনের নিরাপত্তা, নারী ও শিশুদের ভয়শূন্য পরিবেশ এবং সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা। মানুষের মধ্যে মনোবল ধরে রাখার শক্তি জোগান দেওয়াই এখন রাষ্ট্রের প্রধান কাজ। 

মানুষের জীবনে অন্ধকার যখন প্রলম্বিত হয়, দেশ যখন হয়ে ওঠে ‘মৃত্যু উপত্যকা’, তখন তারা ভয়ংকর সব কথা বলতে থাকে, সহিংস আচরণ করে এমনি নিজের উপরেও। মানুষ প্রকৃতপক্ষে কোথাও না কোথাও আশার আলো দেখতে চায়। 

এ অস্থির কাল নিরাপদে অতিক্রম করার একটিই পথ- রাষ্ট্রব্যবস্থার ভেতরে জ্বালিয়ে রাখতে হবে আশার আলো। দরিদ্র হবার কারণে মর্যাদাহীনতার বোধে আক্রান্ত হবার হাত থেকে রক্ষা করতে হবে প্রত্যেক নাগরিককে। যেন হাসিমুখে প্রত্যেকে সন্তুষ্টচিত্তে বলতে পারে- এই রাষ্ট্র অবশ্যই আমার।

লেখক: কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //