‘আইনের শাসন’ কখন, কার জন্য

বাবা ও শ্বশুর সংসদ সদস্য এবং নিজেও জনপ্রতিনিধি- এরকম একজন ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছেন ও তাৎক্ষণিক সাজা দিয়ে তাকে জেলখানায়ও পাঠানো হয়েছে। এই ঘটনাকে যারা আইনের শাসনের বিরাট উদাহরণ হিসেবে দেখছেন, তাদের জন্য এই লেখা। 

ঘটনাটি পুরান ঢাকার অত্যন্ত প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমের। রাজধানীর কলাবাগান এলাকায় নৌবাহিনীর একজন অফিসারকে মারধরের জেরে এখন তিনি কারাগারে। ঘটনার পর পুরান ঢাকায় সেলিমের বাসায় র‌্যাবের অভিযানের আগপর্যন্ত এ নিয়ে সংবাদমাধ্যমে খবর পরিবেশনেও ছিল সতর্কতা; কিন্তু র‌্যাবের অভিযান শুরুর পর দৃশ্যপট পাল্টে যায়; সংবাদমাধ্যমের ভাষাও বদলে যেতে থাকে।

ধরা যাক, ইরফান সেলিমের মারধরের শিকার ব্যক্তি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো অফিসার বা সদস্য নন; বরং তিনি একজন সাধারণ মানুষ। ধরা যাক, তিনি পেশায় একজন ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ছাত্র অথবা সংবাদকর্মী। এই ঘটনার কী প্রতিক্রিয়া হতো? 

প্রথমত, হামলার শিকার ব্যক্তিটি মোটামুটি প্রভাবশালী না হলে তিনি হয়তো থানায়ও যেতেন না। বরং নিজের রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ঝাড়ার জন্য বড়জোর ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিতেন ও মানুষের সহানুভূতি আদায়ের চেষ্টা করতেন। অথবা তিনি হয়তো থানায় মামলা করতে যেতেন; কিন্তু পুলিশ যখন হামলাকারীর পরিচয় জানত, তারা হয়তো মামলা নিত না। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি সামাজিকভাবে মোটামুটি প্রভাবশালী হলে পুলিশ থানার ভেতরেই বিষয়টি মিটমাট করে দেওয়ার চেষ্টা করত। অথবা মামলা নিলেও বা নিতে বাধ্য হলেও পুলিশ বা র‌্যাব তাৎক্ষণিকভাবে ইরফানকে গ্রেফতার করত না। বরং মামলা করার দায়ে হয়তো আক্রান্ত ব্যক্তি ও তার পরিবারের লোকজনের ওপরই নানাবিধ নজরদারি শুরু হতো ও এক পর্যায়ে তাদের পালিয়েও যেতে হতে পারত। 

কিন্তু ইরফান সেলিম ভুল জায়গায় হাত দিয়ে ফেঁসে গেছেন। যাকে মেরেছেন তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। অতএব, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে অ্যাকশন নিয়েছে। অভিযান চলাকালে ওয়াকিটকি ও মদ রাখার ঘটনায় ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে হাজী সেলিমপুত্রকে ছয় মাস করে এক বছরের সাজা দেওয়া হয়। অবৈধ অস্ত্র রাখার দায়ে আলাদা মামলাও হয়। 

ইরফান সেলিমের বিরুদ্ধে মামলায় এত দ্রুত তার বাসায় গিয়ে বিশাল অভিযান ও তাৎক্ষণিক সাজা দেয়ার বিষয়টি যতটা না আইনের শাসন, তার চেয়ে অনেক বেশি একজন সতীর্থের পাশে দাঁড়াতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ক্ষমতার প্রকাশ। ইরফান সেলিমের হাতে একজন সাধারণ নাগরিক নির্যাতিত হলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অ্যাকশন ভিন্ন হতো- এর সাথে বোধ করি কেউই দ্বিমত পোষণ করবেন না। অতএব, নৌবাহিনীর একজন অফিসারকে মারধরের অপরাধে ইরফান সেলিমকে যেভাবে আইনের আওতায় আনা হয়েছে, সে ধরনের আচরণ রাষ্ট্রের সব নাগরিকের বেলায় ঘটলেই বরং দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে- এ কথা বলা যাবে। তার আগ পর্যন্ত এই ঘটনাগুলো আইন ও বিচারিক ইতিহাসে ‘ব্যতিক্রম’ হিসেবেই চিহ্নিত হবে।

দুই.

ইরফান সেলিম নামে যে এমপিপুত্র প্রকাশ্য রাস্তায় নৌবাহিনীর একজন অফিসারকে মারধর করলেন, তিনি ভুল জায়গায় হাত দেয়ায় ফেঁসে গেছেন। প্রশ্ন হলো- সারাদেশে এ রকম এমপিপুত্রের সংখ্যা কত, যাদের হাতে প্রতিনিয়তই দেশের কোনো না কোনো স্থানে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও সাধারণ মানুষ নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন? সেই পরিসংখ্যান কি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে রয়েছে? যদি থাকে, তাহলে তাদের বাড়িতে অভিযান পরিচালিত হয় না কেন? নাকি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তি ছাড়া অন্য যে কোনো নাগরিককে মারধর করা বৈধ?

অভিযানের সময় হাজী সেলিমের পাশের একটি বাড়িতে ধারালো অস্ত্র, হকিস্টিক ও রশি পাওয়া গেছে। বলা হচ্ছে- এটি ইরফানের ‘টর্চার সেল’ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। প্রশ্ন হলো- সারাদেশে এ রকম টর্চার সেলের সংখ্যা কত ও সেসব জায়গায় কেন অভিযান পরিচালিত হয় না?

ইরফান সেলিমের শ্যালক শাবাব চৌধুরীর ঘটনাও দেশবাসীর ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গাড়িচাপা দিয়ে তিনি একজন পথচারীকে হত্যা করেছিলেন। তিনিও এমপিপুত্র। ২০ লাখ টাকায় মীমাংসা হয়। সাবেক সংসদ সদস্য পিনু খানের ছেলে বখতিয়ার আলম রনিও মাতাল অবস্থায় রাজধানীর ইস্কাটনে গুলি করে দু’জন নিরপরাধ মানুষকে খুন করেছিলেন। যদিও ওই ঘটনায় রনি এখন যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করছেন। শেষমেশ ইরফানকেও হয়তো দীর্ঘমেয়াদে কারাগারে থাকতে হবে। 

কিন্তু প্রশ্ন হলো- সারাদেশে ইরফান-রনি-শাবাবের সংখ্যা কত? তাছাড়া জনপ্রতিনিধি হলেই (কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে) তার পরিবারের লোকজন যে বেপরোয়া হয়ে যায়, সেই ভয়াবহ প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় নিয়ে কি রাজনীতিবিদরা কখনো ভেবেছেন?

পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের কী ধরনের প্রভাব, সেখানে তার রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষরা বছরের পর বছর ধরে কী ধরনের নির্যাতনের শিকার, তা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। তার বিরুদ্ধে বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে স্থাপনা নির্মাণের অভিযোগও বহু পুরনো; কিন্তু তারপরও হাজী সেলিম দোর্দ- প্রতাপের সাথে পুরান ঢাকায় রাজনীতি করে গেছেন। ছেলেকে ধরতে তার বাড়িতে র‌্যাবের অভিযান শুরুর মিনিট দশেক আগে তিনি বাসা থেকে সস্ত্রীক বেরিয়ে যান। তারপর থেকে তিনি ‘লাপাত্তা’। কোনো সাধারণ নাগরিক যদি তার ছেলের হাতে লাঞ্ছিত হতেন, তাহলেও কি তাকে এভাবে নিজের বাসা থেকে উধাও হয়ে যেতে হতো? 

তিন.

বাংলাদেশের সংবিধান বলছে, ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।’ (অনুচ্ছেদ ২৭) কিন্তু আইনের দৃষ্টিতে সকল নাগরিক সমান হলেও যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন, তাদের চোখে সব নাগরিক সমান নন। তাদের দৃষ্টিতে বিরোধী মতের লোকের ওপর সব ধরনের নির্যাতন চালানো জায়েজ, যতক্ষণ না সেটি ‘রঙ নম্বরে ডায়াল’ হয়। রাষ্ট্রের চোখে বিনা বিচারে হত্যা কোনো অপরাধ নয়, যতক্ষণ না পুলিশের গুলিতে একজন সাবেক সেনা অফিসার নিহত হন। 

ঢাকা মেট্রো পলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোহাম্মদ শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ প্রভাবমুক্ত থেকে ইফরান সেলিমের মামলার তদন্ত করবে।’ 

প্রশ্ন হলো- প্রভাবমুক্ত থেকে পুলিশ তদন্ত করবে- তাকে এই আশ্বাস দিতে হলো কেন? কারণ সব মামলায়, বিশেষ করে রাজনৈতিক মামলায় পুলিশ প্রভাবমুক্ত থেকে নিরপেক্ষভাবে তদন্ত করে না বা করতে পারে না। তাদের ওপর নানাবিধ চাপ থাকে; কিন্তু ইরফান সেলিম যেহেতু আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একজন অফিসারকে মারধর করেছেন এবং এই ঘটনা তদন্তে সরকারের তরফে পুলিশের ওপর কোনো ধরনের চাপ আসবে না বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে, সে কারণে ডিএমপি কমিশনার বলতে পারছেন যে, তারা প্রভাবমুক্ত থেকে তদন্ত করবেন। 

ইরফান সেলিমের হাতে রাষ্ট্রের একজন সাধারণ নাগরিক লাঞ্ছিত হলে, সেই মামলার তদন্ত কি পুলিশ প্রভাবমুক্ত থেকে করতে পারত? যদি না পারে বা রাষ্ট্রের একজন প্রান্তিক মানুষের ওপর কোনো একজন ক্ষমতাবানের নির্যাতনের ঘটনায় যদি রাষ্ট্রের কোনো বাহিনী প্রভাবমুক্ত থেকে তদন্ত করতে না পারে, তাহলে ধরে নিতে হবে, ‘আইনের শাসন’ শব্দ যুগল আমাদের থেকে যোজন যোজন দূরে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //