পাঠকের কলাম

মৃত্যুদণ্ড কি বাঁচাতে পারবে ধর্ষণ থেকে?

সম্প্রতি ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে একটি আইন পাস করেছে সরকার। এতে কি ধর্ষণ বন্ধ হবে? ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের গতি বাড়তে না বাড়তেই এক রকম তড়িঘড়ি করে এ আইন পাস করা হলো; যেন এটাই চাচ্ছিল সরকার। 

এর আগেও সরকার তড়িঘড়ি করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ নামক আইনটি পাস করেছিল; কিন্তু নারী ও শিশু নির্যাতন কি বন্ধ হয়েছে? বরং এ আইন পাস হওয়ার পর থেকেই এর অনেক অপপ্রয়োগ হচ্ছে।

ধর্ষণ কি শুধু পুরুষই করে? ধর্ষক যে নারীও হতে পারে এমন প্রমাণও আছে ভুরিভুরি। ২০০৭ সালে আমেরিকায় এক পিতা আদালতে মামলা করেন, তার ১৪ বছরের ছেলে স্কুল শিক্ষিকা কর্তৃক ধর্ষিত হয়েছে এবং ওই শিক্ষিকা যথারীতি অন্তঃসত্ত্বাও হয়েছে। আদালত সুস্পষ্ট প্রমাণের পরিপ্রেক্ষিতে সাজা প্রদান করেন। নারী ধর্ষিত হলেই শোরগোল পড়ে যায়, অন্যদিকে একজন পুরুষ তার ধর্ষিত হওয়ার কাহিনি চেপে যায়। 

বহুদেশে মৃত্যুদণ্ড বলে কোনো আইন নেই। মৃত্যুদন্ড দিয়ে কোনো অপরাধের বিচার হতে পারে না। যেকোনো অপরাধের বিচার করা মানেই হলো অপরাধীকে সংশোধন হওয়ার সুযোগ দেয়া ও ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্রে নজির সৃষ্টি করা। আর তাই যদি হয় তবে একজন ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলে একদিকে সেই অপরাধী যেমন সংশোধনের সুযোগ বঞ্চিত হলো, অন্যদিকে সমাজে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘমেয়াদি কোনো প্রভাবও তৈরি হয় না। অর্থাৎ একজন ধর্ষককে মৃত্যুদণ্ড দিলে উক্ত ঘটনার মধ্যেই তা শেষ হয়ে যায়। এতে সমাজ ও রাষ্ট্র কতটুকু লাভবান হচ্ছে, তাও নিশ্চয় নতুন করে ভাবার বিষয়।

যেকোনো ঘটনার পেছনে একটা কারণ থাকে, আবার প্রত্যেকটা কারণের পেছনেও একটা কার্যকারণ থাকে। যেকোনো ঘটনার কারণ নির্ণয় করা নিশ্চয় অবশ্যক। আমরা যদি ধর্ষণের মতো অপরাধের কারণ ও কার্যকারণ না নির্র্ণয় করে হঠাৎ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছে যাই, তবে নিশ্চিত সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া হবে না। অনেকটা রোগ না বুঝে ওষুধ দেয়ার মতো হবে। ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধের অনেক কারণ থাকতে পারে। 

পৃথিবীর সব প্রাণীই মস্তিষ্ক দ্বারা পরিচালিত হয়। মস্তিষ্কে অসংখ্য কোষ রয়েছে এই কোষ সময় মতো সংকেত দেয় ও মানুষ তা অনিবার্যভাবে পালন করে থাকে। মশা মানুষের শরীরের যে অংশে আক্রমণ করবে মানুষের হাতও সেখানেই প্রতিহত করবে- এটাই মস্তিষ্কের সিগন্যাল। তেমনি মানুষ অপরাধও করে মস্তিষ্কের সিগন্যালে। বৈজ্ঞানিক মতে, মস্তিষ্কে পি নামক কোষ বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণ করে, পি কোষ নারী-পুরুষ উভয়ের মাঝে বিদ্যমান, সমযোগ্যতা সম্পন্ন ও সমপরিমাণ পি কোষ একে অপরকে আকর্ষণ করবে। প্রাণী কুলেও এ আকর্ষণ বিদ্যমান। মিলনের প্রয়োজনে পরষ্পর পরষ্পরকে বিভিন্নভাবে আকর্ষণ করে ও মিলিত হয়। 

দার্শনিক এরিখ ফার্ম তার ‘দি আর্টস অব লাভিং’ গ্রন্থে এই পি কোষকে অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে বিশ্লেষণ করেছেন। অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তি ও ক্ষমতা নির্র্ণয় করে। আর তাই তিনি দেখিয়েছেন, রূপকথার গল্পে রাজকন্যা রাখালের হাত ধরে রাজ্য ছেড়ে পালালেও, বাস্তবে এমন দৃশ্য কল্পনা করা যায় না। অর্থনৈতিক অবস্থান সমপর্যায়ে না হলে পরষ্পরের মধ্যে ‘প্রেম কিংবা ভালোবাসার’ আকর্ষণ তৈরি হলেও সেটা হয় নিতান্তই শরীর নির্ভর।

আমরা প্রচলিত ও গতানুগতিক চিন্তার ফ্রেমে বাধা পড়ে গেছি। কোন কিছুকেই আমরা নতুনভাবে ভাবতে চাই না, কিংবা ভাবতে পারি না। যে কোনো ঘটনা শুধু একটি কারণে নয়; ঘটতে পারে হাজারো কারণে। কাক মানেই কালো, সাদা কি হতে পারে না? 

বৈজ্ঞানিক মতে, মানব মস্তিষ্ক অসংখ্য কোষের সমাহার। আর এ মস্তিষ্কের যে কোষগুলো যখন সক্রিয় হয়, মানুষ তখন সেই কোষগুলো কর্তৃক নির্দেশিত কাজটাই করে। যখন মানুষের যৌন অনুভূতির কোষগুলো সুড়সুড়ি দেয়, তখন মানুষ যৌনাকাক্ষা বাস্তবায়নে সক্রিয় হয়ে ওঠে। সমাজ কি যৌনতার সুড়সুড়ি দেয় না? নারী স্বাধীনতার মানে কি অশ্লীল দেহ প্রদর্শন বা নারী স্বাধীনতা মানে কি কেবলই যৌন আবেদনময়ী বিজ্ঞাপন? নারীর আকর্ষণ কতটুকু, তা আমরা ট্রয় নগরীর হেলেনের কাহিনিতে জানি বা ফেরেস্তা হারুৎ মারুতের চরিত্র হননের কারণ জোহরা নামক নারী। যা প্রায় সবারই জানা। ভারতীয় কামসূত্র নারী স্বাধীনতার প্রতীক নয়- এটাই অনেক নারীবাদী মানতে পারেন না। প্রাকৃতিকভাবেই নারী-পুরুষের সীমা নির্ধারণ করা রয়েছে, ধারণক্ষমতার বেশি ওজন নিলে যেমন জাহাজের ভরাডুবি হয়, ঠিক তেমনি মানুষের ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। তাই সামগ্রিক সত্য বিচারে নতুন করে ভাবতে হবে, ভাবনার দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে, কোনো নির্দিষ্ট চিন্তার ফ্রেমে আটকে থেকে নয় ফ্রেমের বাইরে এসে ভাবতে হবে।

বর্তমানকালে দেশজুড়ে সংগঠিত ধর্ষণের মূল কারণ হলো- রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার আর কার্যকারণ হলো বিচারহীনতার সংস্কৃতি। এ যাবৎ যতগুলো উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংগঠিত হয়েছে, তার প্রায় সবই অপরাধী পার পেয়ে গেছে ক্ষমতার দাপটে এবং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। 

কেবল নতুন নতুন আইন করলেই অপরাধ নির্মূল হবে না যদি না তার সঠিক প্রয়োগ করা হয়। ওষুধ কিনে সেবন না করে যত্ন করে লকারে রাখলে রোগ সারবে না, উপযুক্ত চিকিৎসকের পরামর্শে নিশ্চয় সে ওষুধ সেবন করতে হবে। ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়েছে; কিন্তু দুখঃজনক হলেও সত্য যে, এতে ধর্ষণ বন্ধ হবে না। যত দিন না ধর্ষণের কারণ চিহ্নিত করে এর উৎপত্তিস্থল বন্ধ করা যাবে?

আলী আকবার

সমাজকর্মী, ফতুল্লা, নারায়ণগঞ্জ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //