করোনার শঙ্কা ও আশার মধ্যে রাজনীতি

একদিকে শঙ্কা আর অন্যদিকে আশা। শঙ্কা এ কারণে যে, দেশে করোনার প্রথম ওয়েভ শেষ হতে না হতেই শীতে দ্বিতীয় ওয়েভ আসছে বলে অনুমিত হচ্ছে। বর্তমান দিনগুলোতে রোগী ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে বলে দেখা যাচ্ছে। করোনা আরো কত ভোগাবে ও প্রাণ নেবে তা এখনো সুস্পষ্ট নয়।

উল্টোদিকে করোনার টিকা আবিষ্কারের খবরে আশা জাগ্রত হয়েছে। ইতিমধ্যে দুই আমেরিকান কোম্পানি ফাইজার ও মডার্না ঘোষণা দিয়েছে, তারা করোনার প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেছে এবং তা ৯০-৯৫ ভাগের ওপর কার্যকর। ইতিমধ্যে তারা টিকা ব্যবহারের অনুমতির জন্য এ বিষয়ক সর্বোচ্চ সংস্থা ইউএস ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এফডিএ) কাছে অনুমতি চেয়েছে। ১০ ডিসেম্বর এ সংস্থার কর্মকর্তারা বৈঠকে বসবেন। অনুমোদন পাওয়া অনেকটাই নিশ্চিত বিধায় আশা প্রকাশ করা হচ্ছে, ১১-১২ ডিসেম্বর থেকে আমেরিকায় টিকা প্রদান কর্মসূচি শুরু হবে। ইউরোপে জার্মানি ও স্পেন প্রথমেই টিকা দিতে পারবে বলে আশা প্রকাশ করেছে।

বলাই বাহুল্য, প্রতিষেধক আবিষ্কার হওয়া ও আমেরিকা-ইউরোপসহ উন্নত দেশে প্রয়োগ শুরু হলেও পিছিয়ে পড়া বিশ্বে ব্যবহার কবে শুরু হবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, প্রথম যে উৎস থেকে পাব, সেখান থেকে আমরা উপযুক্ত টিকা সংগ্রহ করব। এজন্য আমরা সবার সাথে যোগাযোগ করেছি। এটা নিঃসন্দেহে উৎসাহজনক। 

তবে প্রথম সমস্যা হচ্ছে উৎপাদনের। জানা যাচ্ছে, অনুমতি পেলে চলতি বছর উল্লিখিত দুই কোম্পানি মিলে ৩ কোটি থেকে ৪ কোটি ডোজ টিকা পাওয়া যেতে পারে। প্রতিজন ২ ডোজ করে হলে যা দিয়ে মাত্র সর্বোচ্চ ২ কোটি মানুষকে টিকা দেয়া সম্ভব।

ইতিমধ্যে মডার্না যুক্তরাষ্ট্রকে সবার আগে ১০ কোটি ডোজ দেয়ার চুক্তি করে রেখেছে। তারপর পাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। দেশভিত্তিক বিতরণের নীতিমালা কী হবে, কোন দেশ কখন পাবে, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। উন্নত দেশগুলো আগে যে পাবে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। তাই উৎপাদন বিবেচনায় আমরা কবে পাব এর অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে। সর্বোপরি উৎপাদন হলেই তো সঙ্গে সঙ্গে তা প্রয়োগ করা যাবে না। দেশে এসে রোগীর কাছে পৌঁছাটাও সময়ের ব্যাপার। জানা গেছে, অক্সফোর্ডের টিকাও আবিষ্কার হয়ে যাবে। এর কার্যকারিতা কতটুকু জানার পর বোঝা যাবে, তা উৎপাদনের সংখ্যা বাড়ানোর ক্ষেত্রে কতটা প্রভাব রাখতে পারবে। রাশিয়া ও চীন প্রতিষেধক টিকা আবিষ্কার করেছে বলে ঘোষণা দিয়েছে; কিন্তু সঙ্গত কারণেই ওই সব টিকা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না।

দ্বিতীয় সমস্যা হচ্ছে, প্রতিষেধক সুরক্ষিতভাবে দেশে নিয়ে আসা ও তা যথোপযুক্তভাবে প্রদান করা। জানা যায়, টিকা সুরক্ষার জন্য শীতল ব্যবস্থা তথা মাইনাস কমবেশি ৭০-৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা প্রয়োজন। বাংলাদেশে মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত ব্যবহৃত হয় বলে জানলাম। আবার এটাও জানা গেছে, বেক্সিমকো ফার্মাকে নাকি এ কাজে ব্যবহার করা হবে। বাস্তবে বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা কতটুকু কী আছে, কত সহজে তা নতুনভাবে বিভিন্ন জায়গায় করা যাবে, কতটা দ্রুত তৃণমূল পর্যন্ত এটা নেয়া সম্ভব, তা এখনো সুস্পষ্ট নয়। তাই কতগুলো বিষয়ে আমাদের আগে থেকে ব্যবস্থা গ্রহণ করে রাখা প্রয়োজন। প্রথমত, টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের নীতিমালার পরিকল্পনা গ্রহণ করা। কার্যকর টিকা যথাযথ মূল্যে সংগ্রহ কে করতে পারবে? বেসরকারি সংস্থা কি পারবে? অর্থ জোগানের জন্য সরকারি-বেসরকারি পার্টনারশিপ কি প্রয়োজন? তাতে কী ফল হতে পারে? সংরক্ষণ কীভাবে হবে? তদুপরি বিতরণ বয়সভিত্তিক হবে নাকি আগে এলে আগে পাবে, সরকার ভর্তুকি দেবে কিনা প্রভৃতিও ঠিক করা প্রয়োজন। 

একটা কথা তো আমাদের বিবেচনায় নিতেই হবে যে, অব্যবস্থা ও দুর্নীতি হচ্ছে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সঙ্গী। ক্ষমতাবান ও অর্থবানরা আগেই টিকা নিতে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন। সরকারি ব্যবস্থার অদক্ষতা ও গাফিলতির সঙ্গে যখন লুটপাট, কালোবাজারি, নকল যুক্ত হওয়ার বিষয়টি সবসময়ে জড়িত থাকে। তাই টিকা ব্যবহারের আশা যখন আমরা করতে পারছি, তখন এসব বিষয়ে শক্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পূর্ব প্রস্তুতি খুবই জরুরি। 

তবে আমরা টিকা যখনই পাই না কেন, তা দ্বিতীয় ওয়েভ যদি আসে, তার আগে পাব না, এটা সুস্পষ্ট। তাই টিকা সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিতরণের নীতিমালা ও ব্যবস্থা করার সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয় ওয়েভ সামলানোর ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। করোনার আক্রমণের মধ্যেই আমাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালাতে হবে। তাই এক্ষেত্রে প্রচার বাড়ানো ও জরিমানা করা ভিন্ন আর কোনো পথ খোলা আছে বলে তো এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে না।

বলাই বাহুল্য, প্রথম ধাক্কাটা জাতি হিসেবে আমরা ভালোই সামাল দিয়েছি। বিগত দিনগুলোর সবলতা-সাফল্যের দিকটি বিবেচনায় নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতার দিকগুলোকেও আমাদের অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে- দ্বিতীয় ওয়েভ যদি আসে তবে তা সামাল দেয়ার জন্য। একই আবহাওয়ার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর চেয়ে যে আমরা রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছি; কেন তা পারলাম, তা যথাযথভাবে চিহ্নিত করে প্রচারে আনা প্রয়োজন আগামী দিনগুলোতে ভরসা ও অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা পাওয়ার জন্য। একইভাবে সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতার দিকগুলোকেও সামনে আনার গুরুত্ব রয়েছে। করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ-সম্পদ যে প্রয়োজনে কোনো সুফল দিতে পারে না, তা করোনা সবাইকে শিক্ষা দিয়ে গেছে। কথাটা যথাযথ; কিন্তু প্রশ্নটা হলো, চোর কখনো ধর্মের কাহিনি শোনে না। এক্ষেত্রে জিরো টলারেন্স ও আইনকে নিজস্ব গতিতে চলার নীতি কার্যকর করা হচ্ছে না বলে জনগণ মনে করে। এই মনোভাব পাল্টানো জরুরি, জনগণের মনে আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমাগত বাড়ানোর জন্য। 

এ ক্ষেত্রে বলতেই হয় করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ আসতে পারে বিপদ বিবেচনায় এই সময়ে রাজনীতিতে বিতর্ক কিংবা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়, এমন কোনো কাজ করা থেকে সরকার ও বিরোধী দলগুলোর বিরত থাকা প্রয়োজন। তাতে হতাশা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং এই দুই হচ্ছে ষড়যন্ত্র- চক্রান্তের আতুড় ঘর। এ সময়ে তা হতে দেওয়া একেবারেই যায় না।

প্রসঙ্গত, বলতেই হয় বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য তুলে নেয়ার কথা বলছে কারা, কী জন্য? এটাও ভাবনার প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় ছাড় দিতে থাকলে ছাড়ই হয়ে যায় ললাট লিখন। ভাস্কর্য ভাঙার কথা বলা সমাজে অরাজকতা, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিরই নামান্তর। এক্ষেত্রেও আইনকে নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া প্রয়োজন। সর্বোপরি ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে যানবাহন পোড়ানোর ঘটনা ঘটল। বিএনপির বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠছে। এই অভিযোগ বিশ্বাসযোগ্যতা পাওয়ার সঙ্গত কারণ রয়েছে।

প্রশ্নটা হলো, দল জনবিচ্ছিন্ন ও ছত্রখান অবস্থায় থাকার পর এ ধরনের কাজ করে কি বিএনপি কখনো রাজনীতির মাঠে ফিরতে পারবে? এক্ষেত্রে অতীত অভিজ্ঞাতা কী বলে? করোনার প্রভাব কাটিয়ে দেশ যখন অর্থনীতির বিপর্যয় রোধ করে অগ্রসর হচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ওয়েভ নিয়ে মানুষ যখন উদ্বিগ্ন, তখন কোন ধরনের কর্মসূচি নিলে বিএনপি তার বন্ধ্যত্ব বা বিপর্যয় রোধ করতে পারে, তা দলটির নেতৃবৃন্দের ভেবে দেখার প্রয়োজন রয়েছে। এ দিকটি বিবেচনায় নিয়েই দেশের দুই বড় দল শঙ্কা ও আশার দোদুল্যমানতার মধ্যে রাজনীতি ও সংগঠনকে গুছিয়ে তুলুক, এটাই কামনা।

- কলাম লেখক, রাজনীতিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //