ড. মো. কামাল উদ্দিন
প্রকাশ: ২৯ নভেম্বর ২০২০, ০৯:৫০ এএম
ড. মো. কামাল উদ্দিন
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন শেষ হলো। নির্বাচন নিয়ে এখন আর কারও আগ্রহ নেই। তবে মার্কিন জনগণের আগ্রহের জায়গা হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাদের জন্য কেমন হবে নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। সত্যিই তিনি কীভাবে ভিন্ন হবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প থেকে! মার্কিন জাতীয় নীতিতে কী কী পরিবর্তন আনতে পারেন, সেগুলো নিয়েই এ লেখার অবতারণা।
জো বাইডেন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অধীনে বিগত চার বছরে করোনাভাইরাস ও স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে পরিবেশ, শিক্ষা ও আরো অনেক বিষয় নিয়ে যা দেখেছেন তার থেকে দেশকে একেবারেই আলাদা পথে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। সত্যিকার অর্থে বাইডেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে কেমন হবেন সে সম্পর্কে পুরোপুরি জানার সুযোগ এখনো নেই। তবে তার নির্বাচনকালীন প্রতিশ্রুতি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। বাইডেন যুক্তি দিয়েছিলেন, করোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতি পুরোপুরি পুনরুদ্ধার সম্ভব নয়।
বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় পর্যায় চলে এসেছে বলে বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন। আর এখন যেকোনো শাসকের শাসনকার্য কতটুকু ইফেক্টিভ তা অনেকাংশে নির্ভর করছে করোনাভাইরাস মোকাবেলার নীতির ওপর। এবারের মার্কিন নির্বাচনে দেখা গেছে যে, ভোটদানকারীরা তাদের রাষ্ট্রপতি পদে ভোট দেয়ার সময় করোনাভাইরাস মহামারির বিষয়টি শীর্ষ বিবেচনায় রেখেছিল। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় ডোনাল্ড ট্রাম্পকে একজন অদক্ষ শাসক হিসেবে দেখেছেন অনেক মার্কিন নাগরিক। সরাসরি সমালোচনাও করেছেন। আর এক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প থেকে বাইডেনকে তারা বেশি বিশ্বাস করেছেন।
বাইডেনও করোনাভাইরাসকে বেশি প্রাধান্য দেবেন বলে ভোটারদের আশ্বস্ত করেন। করোনাভাইরাস পরীক্ষা, যোগাযোগের সন্ধান ও ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত ব্যক্তিদের পৃথকীকরণ ও তাদের সহায়তার ব্যবস্থা করার জন্য তহবিল বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। জনস্বাস্থ্যকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাইডেন রাষ্ট্র পরিচালিত বীমা ক্রয়কারী ব্যক্তিদের জন্য ভর্তুকি বাড়ানোর কথা বলছেন ও সরকারিভাবে পরিচালিত আরো বিকল্প বীমা পরিকল্পনার প্রতিশ্রতি দেন। যেকোনো আমেরিকান যদি তাদের ব্যক্তিগত পরিকল্পনায় সন্তুষ্ট না হয় তবে তারা বিকল্প বীমা পরিকল্পনা কেনার জন্য বেছে নিতে পারেন। এমন সাশ্রয়ী মূল্যের আইনের কথা চিন্তা-ভাবনা করছেন জো বাইডেন।
করোনা সম্পর্কে ট্রাম্পের সাথে তার তীব্র বিপরীত কয়েকটি যুক্তি দিয়েছিলেন। এ জাতীয় সংকটের মোকাবেলা করবার জন্য কিন্তু রাষ্ট্রপতি ও ফেডারেল সরকার বিদ্যমান রয়েছে। বাইডেন মহামারি ও আর্থিক চূড়ান্ত মন্দার মোকাবেলায় রাষ্ট্র ও স্থানীয় সরকারদের পাশাপাশি ব্যবসায়ী ও ব্যক্তিগত সহায়তা সমর্থন করেন। বাইডেন জনগণের কাছে ধারাবাহিক বার্তা দেয়ার চেষ্টা করেছেন যে, তার আমলে বিজ্ঞানী ও চিকিৎসকদের সংখ্যা উন্নত করা হবে। তিনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় পুনরায় যোগদান করতে চাইবেন। তিনি প্রত্যেক গভর্নরের সাথে বৈঠক করার জন্য দায়িত্ব নেয়ার আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ও তাদেরকে দেশব্যাপী মাস্ক ম্যান্ডেট কী হবে তা আরোপ করতে বলবেন। কারণ ফেডারেল সরকারের সেই ক্ষমতা নেই।
বাইডেন বলেছেন যে, তিনি কাউন্টি ও স্থানীয় কর্মকর্তাদের কাছ থেকে এই জাতীয় বিধিগুলো জারির আশা করছেন। যদিও জাতীয়ভাবে এই ধরনের আদেশ কার্যকর করা অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। ‘ওবামা কেয়ার’ হিসেবে পরিচিত স্বাস্থ্যসেবা আইনটি ওবামা প্রশাসনের অন্যতম সাফল্য ছিল। বাইডেন এ স্বাস্থ্যসেবা আইনের অধীনে সবার জন্য পলিসি কভারেজ সরবরাহের পদক্ষেপ নিতে চান। কর্মজীবী আমেরিকানদের জন্য বেসরকারি বীমা বাজারের পাশাপাশি তিনি একটি ‘জাতীয় মেডিকেয়ার পলিসি’র বিকল্প তৈরি করবেন, যেখানে ইতিমধ্যে ব্যবহার করা বহু লোকের প্রিমিয়াম ভর্তুকি বাড়িয়ে তুলতে সহায়তা করবে। মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোর ভর্তুকিযুক্ত স্বাস্থ্য বীমাতে অ্যাক্সেস থাকবে।
বাইডেন অনুমান করেছেন যে, তার পরিকল্পনার বাস্তবায়নের জন্য ১০ বছরেরও বেশি সময় ব্যয় হবে। এতে অতিরিক্ত খরচ হবে ৭৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ব্যবস্থাপত্রের ওষুধগুলোতে বাইডেন সরকারি কর্মসূচির পাশাপাশি বেসরকারি দাতাদের দর কষাকষির সুযোগ দেয়ার আইনকে সমর্থন করেন। তিনি ওষুধ সংস্থাগুলোকে মেডিকেয়ার এবং অন্যান্য ফেডারেল কর্মসূচির আওতাভুক্ত লোকদের জন্য এর মূল্য দ্রুত বাড়াতে নিষেধ করবেন। গুরুতর রোগের চিকিৎসার জন্য অন্য দেশগুলো যে অর্থ প্রদান করে, তা প্রথমেই নিজের দেশে ব্যবহার করে তিনি প্রাথমিক দামগুলো সীমাবদ্ধ রাখতে চান। বাইডেন মেডিকেয়ার তালিকাভুক্তদের জন্য বার্ষিক ওষুধ ব্যয়ের সীমাবদ্ধতা রাখতে চান।
জলবায়ু পরিবর্তন ও সবুজ শক্তি প্রকল্প বাইডেনের কাছে অগ্রাধিকার পাবে বলে স্পষ্ট করেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য ২ ট্রিলিয়ন ডলার পরিকল্পনার প্রস্তাব করেছেন। বিদ্যুৎ সংস্থাগুলোকে কার্বন মুক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনে উৎসাহিত করার জন্য বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। আরো বেশি বৈদ্যুতিক যানবাহন নির্মাণের জন্য জোর দিয়েছেন।
বাইডেনের একটি অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পটি ২০৩৫ সালের মধ্যে নেট জিরো কার্বন নিঃসরণের দিকে নিয়ে যাওয়া এবং সমগ্র মার্কিন অর্থনীতিতে ২০৫০ সালের মধ্যে নেট শূন্য কার্বন নির্গমন নিশ্চিত করে উৎপাদন করা। জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে খারাপ প্রভাব রোধ করার জন্য জাতিসংঘের অনুমানের সাথে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করা। বাইডেনের জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের অদক্ষতা ও পরিবেশ দূষণকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগের ক্ষেত্রে ধীরগতির বিপরীতে এসব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানিয়েছিলেন বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে। তিনি পরিবেশ দূষণ রোধে বিচার বিভাগের মধ্যে একটি জলবায়ু ও পরিবেশগত বিচার বিভাগ স্থাপন করতে চান। বাইডেন পরিবেশগত ন্যায়বিচারের ওপর জোর দিয়েছিলেন। করপোরেট পরিবেশ দূষণকারীর মাধ্যমে নিম্ন-আয়ের এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অপ্রয়োজনীয় ক্ষতির সমাধানের বিষয়ে গুরুত্ব দেন।
বাইডেনের অন্য একটি আগ্রহের জায়গা হলো পারিবারিক বিষয়ক শিক্ষা। বাইডেন স্বল্প আয়ের পাবলিক স্কুলগুলোর জন্য ফেডারেল শিরোনামে অর্থ প্রদান প্রোগ্রামটি তিনগুণ করার প্রস্তাব দিয়েছেন। স্কুলগুলোর শিক্ষকদের একটি প্রতিযোগিতামূলক বেতন ও বেনিফিট প্রদানের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি লাভজনক স্কুলগুলোর জন্য ফেডারেল অর্থ নিষিদ্ধ করতে চান ও কেবল ওই সব স্কুলগুলোতে নতুন অর্থ সরবরাহ করতে পারেন, যদি তারা দেখায় যে অভাবী শিক্ষার্থীদের সেবা দিচ্ছেন। বাইডেন দুই বছরের জন্য কমিউনিটি কলেজকে ফ্রি করতে চান। বার্ষিক ১২৫ হাজার ডলারের নিচের আয়ের পরিবারগুলোর জন্য পাবলিক কলেজগুলো বিনামূল্যে করার জন্য আইন সমর্থন করেন। ঐতিহাসিকভাবে কৃষ্ণাঙ্গ কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য স্কুলে নিম্নবর্ণের সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করে তাদের জন্য ৭০ বিলিয়ন ডলার বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি।
বাইডেনের একটি সামাজিক সুরক্ষা পরিকল্পনা রয়েছে- যা মার্কিন নাগরিকদের সামাজিক উপকারগুলোকে আরো প্রসারিত করবে; কিন্তু উচ্চ-আয়ের লোকদের জন্য তিনি কর বাড়িয়ে দিতে পারেন। তিনি মুদ্রাস্ফীতি সূচকের সঙ্গে যুক্ত করে সামাজিক সুরক্ষার বার্ষিক জীবনযাত্রার সামঞ্জস্যকে পুনর্র্নিমাণ করবেন, যা বয়স্ক ব্যক্তিদের জন্য ব্যয়ের ক্ষেত্রে বিশেষত স্বাস্থ্যসেবাতে আরও ঘনিষ্ঠভাবে ইতিবাচক ফলাফল প্রতিফলিত করবে। তিনি বয়স্কদের মধ্যে আর্থিক অসুবিধা সমাধান করে স্বল্প আয়ের অবসরপ্রাপ্তদের ন্যূনতম সুবিধাও বাড়িয়ে তুলতে চান।
নির্বাচনকালীন বক্তব্য, মিডিয়া ও অন্যান্য আলোচনা থেকে জো বাইডেনের এসব বিষয় স্পষ্ট হয়। জানুয়ারিতে ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে বোঝা যাবে সত্যিকার অর্থে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জো বাইডেন কী পরিবর্তন করবেন। আর তার এসব জাতীয় নীতি মূল্যায়িত হবে চার বছর পর পরবর্তী মার্কিন নির্বাচনে।
- অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ABOUT CONTACT ARCHIVE TERMS POLICY ADVERTISEMENT
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ | প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
প্রধান সম্পাদক: ইলিয়াস উদ্দিন পলাশ
প্রকাশক: নাহিদা আকতার জাহেদী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী
অনলাইন সম্পাদক: আরশাদ সিদ্দিকী | ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭
© 2021 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh