এটি এখন গ্লোবাল অর্ডার, ভূ-রাজনীতি নয়

আজকাল দেখা যাচ্ছে জিও-পলিটিক্স (ভূ-রাজনীতি) শব্দটার ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। আসলে হয়েছে উল্টাটা; দেখা যায় আমরা আমাদের কিছু অপরিচিত বা নতুন ফেনোমেনা যখন ঠিকমতো ব্যাখ্যা করতে পারি না বা নিজেই বুঝতে পারি না অথবা সেই ব্যাখ্যাটা নিজের কাছেই সন্তোষজনক মনে হয় না- এমন পরিস্থিতিতে তখনকার মতো ব্যাপারটা ঢাকা দিতে বা অমীমাংসিত ফেলে রাখতে একটাই শব্দ ব্যবহার করি- ভূ-রাজনীতি। 

যেমন- বলতে দেখি, ‘এগুলো হলো ভূ-রাজনীতির বিষয়’ ‘ভূরাজনীতির কারণে এমনটা হয়েছে’ ‘চুক্তিটি ভূ-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক দিক থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ’ ইত্যাদি। ফলে কমবেশি আমরা সবাই পরিষ্কার যে কোথাও একটা বড় অস্পষ্টতা থেকে যাচ্ছে। 

একইভাবে দেড়-দুই বছর আগে আমরা লক্ষ্য করেছিলাম ‘রিজিওনাল’ বা ‘আঞ্চলিক’ শব্দটির ব্যবহার বেড়ে গেছে। যেমন- কেউ বলছে হয়তো ‘আঞ্চলিক’ রাজনীতিতে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। অথবা এটি হতেই পারে, কারণ ফেনোমেনার কেন্দ্রস্থল এশিয়া; কিন্তু এরপরেও ঘটনাস্থল বা কেন্দ্র দেখে তা ‘আঞ্চলিক ঘটনা’ বলে সাব্যস্ত করা বড় ভুল হবে। কেন? কারণ প্রকাশটি আঞ্চলিক হলেও মূল ঘটনাটি গ্লোবাল; মানে দুনিয়াজুড়ে বিস্তৃত ফেনোমেনা এটি। তাই সেদিক থেকে দেখতে হবে। অর্থাৎ ফেনোমেনাটা দুনিয়ার সবখানে আছে ও ঘটছে; কিন্তু বিশেষ করে এশিয়ায় এর ঘনঘটা বেশি। ঠিক যেমন এখন এশিয়া দুনিয়ার প্রধান রঙ্গমঞ্চ হয়ে উঠেছে। 

তবে এখানে ‘এখন’ মানে কী? আর তা কখন ও কবে থেকে? সাধারণভাবে বলা যায়, ঘটনাটি চলতি শতকের শুরু থেকে। আরো সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তা ২০০৯ সাল থেকে। যদিও আরেকটু সুনির্দিষ্টও করা যায়। গত শতকের সত্তর দশকে চীন-আমেরিকান সম্পর্ক থেকে, আনুষ্ঠানিকভাবে ওই দুই দেশ ১৯৭৮ সালের জানুয়ারিতে দূতাবাস খুলেছিল। আর ওই সময় থেকে ‘কমিউনিস্ট’ চীনের রূপান্তরে আমেরিকান বিনিয়োগ ঢেলে দেয়া শুরু হয়েছিল।

সে ঘটনাটিই এখন ফুলে-ফলে কয়েক শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। সাথে সাথে শত নতুন ফ্যাক্ট জাগিয়ে এক গ্লোবাল ফেনোমেনা হয়ে হাজির হয়েছে। এটিই এখন দুনিয়ার এক নম্বর গ্লোবাল ফেনোমেনা- চীন আসিতেছে। আর তা বুঝি বা না বুঝি অবস্থায় পড়ে অস্পষ্টতায় এটিকে ‘ভূ-রাজনীতি’ বা ‘আঞ্চলিক’ ঘটনা বলছি। এটি কেবল চীন-আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ইস্যু না, গ্লোবাল ফেনোমেনা। কারণ এটি গ্লোবের সব রাষ্ট্র ও জীবনকে প্রভাবিত করছে। গ্লোবাল মানে দুনিয়াজুড়ে যা বিস্তৃত, অনেকে যাকে বাংলা করে থাকে ‘বিশ্ব’ বলে। তবে বিভ্রান্তি এড়ানোর জন্য, চিন্তায় স্বচ্ছতা রাখার জন্য সরাসরি ‘গ্লোবাল’ বলাটাই ভালো।

‘ভূ-রাজনীতির’ টেক্সট বুক সংজ্ঞা

টেক্সট বুক সংজ্ঞা হিসেবে ‘ভূ-রাজনীতি’ ধারণাটা অনেক পুরনো। কলোনি-দখলের যুগেরও (১৬০৭-১৯৪৫) আগের। আবার কিছু ঘটনার ক্ষেত্রে এরও আগের। যেমন- কলোনি-দখলের যুগই আবার সমান্তরালভাবে আধুনিক রাষ্ট্র (নেশন-স্টেট আকারে) উত্থানের যুগ। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে যখন মডার্ন রাষ্ট্র হওয়ারও আগে রাজা-সম্রাটদের এক ধরনের সাম্রাজ্য ছিল (যেমন রাশিয়ান জার, বা অটোমান সুলতান)- এই আমলেও ‘ভূ-রাজনীতি’ ধারণাটি পাওয়া যেতে পারে। 

কারণ ‘ভূ-রাজনীতি’ কী? এ নিয়ে টেক্সট বুক সংজ্ঞা বলছে, এটি হলো- ‘রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ওপর ভূগোলের যে প্রভাব তাই ‘ভূ-রাজনীতি’। যেখানে আবার ভূগোল বলতে বস্তুগত ও মানবসত্তা হিসেবে বুঝতে হবে। আবার এর ফোকাস যখন ক্ষমতা, তখন নিজ ভৌগোলিক সীমার ভেতরে যে রাজনৈতিক ক্ষমতা, সেটি বুঝে নিতে হবে। 

এছাড়া আরেকভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, ‘ভৌগোলিক অবস্থানের সাথে স্ট্র্যাটেজির সম্পর্ক নিয়ে যা কথা বলে ‘এটিই ভূ-রাজনীতি’। যেখানে উদ্দেশ্য থাকে কোন দেশের সুনির্দিষ্ট স্ট্র্যাটেজির বাস্তবায়ন।

বইয়ের সংজ্ঞা মানে তো কথার কচকচানি। ফলে এবার সরাসরি ভেঙে বলতে হবে। এক. সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে যে ভূ-শব্দটি ব্যবহার করা হতো, তার মানে হলো দেশ (রাষ্ট্র)। তবে ১৯৪৫ সালের আগ পর্যন্ত রাষ্ট্র বুঝাতে জাতি-রাষ্ট্র ধারণার প্রবল প্রভাব ছিল। তাই রাষ্ট্র শব্দটি তত ব্যবহার হতো না, বদলে ‘দেশ’ বহুল প্রচলিত শব্দ ছিল। যেমন, দেশপ্রেম, দেশাত্মবোধ ধরনের আবেগধর্মী শব্দ ব্যবহার হতো। 

তাহলে সেকালের অর্থেই ‘ভূ-রাজনীতি’ কথার আসল মানে দাঁড়াল কোন দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও কৌশল। যদিও এটি আবার ছোটখাটো কোন রাষ্ট্র বুঝলে হবে না। বরং সেই রাষ্ট্র যে অন্তত রাশিয়ান জার বা তুরস্কের সুলতানের মতো বড় এম্পারার; ফলে যে অন্য সমতুল্য এম্পারারের ওপর প্রভাব, আধিপত্য ফেলতে সক্ষম। 

দ্বিতীয়ত, দেখা যাচ্ছে ‘ভূ-রাজনীতি’ শব্দের এ কালে ব্যবহার নিয়ে আপত্তির কিছু নেই। বরং আপত্তি প্রবলভাবেই আছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, ওপরের সংজ্ঞায় কোথাও ‘অর্থনীতি’ শব্দটি বা অর্থনীতি-সংশ্লিষ্ট কোনো ধারণা নেই; কিন্তু না থাকলে তাতে কী অসুবিধা?

আগেকার ‘ভূ-রাজনীতি’ শব্দে ধরে নেয়া আছে যে, রাজনৈতিক ক্ষমতাই শেষ কথা। বাকি সব কিছুই রাজনীতির ভেতরেই অন্তর্ভুক্ত। এই আগাম অনুমানটি ভুল। এছাড়াও বাস্তবে ১৯৪৫ সালের পরের পরিবর্তিত দুনিয়ায় ভূ-রাজনীতি শব্দটি ছাপিয়ে গ্লোবাল অর্থনীতি, গ্লোবাল পলিটিকস শব্দগুলোর চল শুরু হয়েছিল। ফলে ভুলটি তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। এমনকি আরো স্পষ্ট করে ১৯৪৫ সাল থেকে গুছিয়ে বলা শুরু হয়েছিল ‘গ্লোবাল অর্ডার’ বলে। কেন এমন হয়েছিল?

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে বড় সাম্রাজের সম্রাটের আমলে তো বটেই এমন কি কলোনি দখলদার ব্যবসায়ী কিন্তু মডার্ন রাষ্ট্রের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যেও রাজনীতি ও ক্ষমতাই মূল বিষয় ছিল, অর্থনীতি বলে তেমন কিছু ছিল না। মনে করা হতো, ‘অর্থনীতি’ ব্যবসায়ীদের ব্যাপার-স্যাপার; রাষ্ট্রের নয়। এর সবচেয়ে ভালো প্রমাণ হলো, ১৯৪৫ সালের আগে সরকারি মালিকানাধীনে পরিচালিত কোনো ব্যাংক ছিল না। মানে ব্রিটিশ এম্পারার রাষ্ট্র এমনকি রাণীও (ব্যক্তিগতভাবে) ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের অ্যাকাউন্টধারী একেকজন খাতক বা ক্লায়েন্টই ছিল মাত্র। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক ধরনের কেন্দ্রীয়ভাবে ব্যাংক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী বলে কোন ধারণাই ছিল না। এসব এসেছে ১৯৪৪ সালে আইএমএফ- বিশ্বব্যাংক ধরনের বহু রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান জন্মের পরে। যেমন প্রাইভেট ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ রাষ্ট্রীয় মালিকানায় চালু হয়। আর এভাবেই শুরু হয়েছিল প্রথম দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ ও মুখ্য ভূমিকা নেয়া। আর তা শুরু হয় মূলত ব্যাংক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকারী কেন্দ্রীয় ব্যাংক হিসাবে ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ ভূমিকা নেয়াতে। এছাড়া সরকার দেশের অর্থনীতিতে ফিসক্যাল পলিসি ও মনিটারি পলিসি ঘোষণা করে তখন; কিন্তু সাবধান, এটি কোন রাষ্ট্রেরই একক অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত ছিল না। আসলে আইএমএফ- বিশ্বব্যাংকের জন্ম দেয়া হয় একটি গ্লোবাল বাণিজ্য ব্যবস্থা চালু করার জন্য, যাতে আন্তঃরাষ্ট্রীয় এক্সচেঞ্জ বিনিময় দুনিয়াতে সম্ভব হয়। যেটি আগে খুবই সীমিত আকারে চালু ছিল। যেটি আবার ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ব্যবস্থাটি ফাংশনাল থাকে। মানে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে দেশে দেশে একটি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে। এ জন্য বর্তমানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে পালন করতে হয় দুটি ভূমিকা। একদিকে রাষ্ট্র অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করে এ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে, অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হলো আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের বাড়তি ডানা- যা দিয়ে ওই সংস্থাগুলো গ্লোবাল বাণিজ্যের সমন্বয় করে থাকে। 

তাহলে এ বার ‘ভূ-রাজনীতি’ ধারণাটির কী পরিণতি পেল? শব্দটিই এখান থেকে অকেজো হয়ে গেল। কেন? প্রথমত তখন থেকে দেশের অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের মুখ্য ভূমিকার আসনে বসে পড়েছে। আর দ্বিতীয়ত, আইএমএফ- বিশ্বব্যাংক এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আবার এর সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অর্থনৈতিক নীতিগুলোর সমন্বয় শুরু হয়েছে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি বলতে কোনো রাষ্ট্রের কেউ আর বিচ্ছিন্ন না। এই গ্লোবাল সমন্বয়ের মাধ্যমে এক গ্লোবাল অর্থনীতি ও বাণিজ্য ব্যবস্থা একটি গ্লোবাল অর্ডার কার্যকরভাবে বলবত হয়ে গেছে। অতএব ভূ-রাজনীতি ধারণাটির দিন ফুরিয়ে গেছে।

ভূ-রাজনীতি ধারণাটি ফেলে দেয়া হয়েছে। আর এর বদলে বার বার গ্লোবাল শব্দটি ব্যবহার করছি। কেন? মূল কারণ, পুঁজি এই ফেনোমেনাটায় লোকাল বলে কিছু নেই আর। পুঁজি মাত্রই গ্লোবাল। মানে কী? এর একেবারে কেন্দ্রীয় ধারণাটি হলো বিনিময় বা এক্সচেঞ্জ। গ্রামের সঙ্গে গ্রামের পণ্য বিনিময় শুরু হওয়া মাত্র পুঁজি আর একটি গ্রামের থাকে না। প্রতিটি গ্রাম তাদের সব ধরনের ইকোনমিক অ্যাক্টিভিটি পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত হয়ে যাবেই। সেখান থেকে গ্রাম-শহর-রাজধানী সবই কালক্রমে পরস্পর সংযুক্ত হয়ে পড়বেই। তবে এই সংযুক্ত থাকার মূল চাবিকাঠিটি হলো- মুদ্রা। একই বাংলাদশি মুদ্রা দিয়ে আমরা সবাই কানেকটেড। এখান থেকে তা একটি দেশের অর্থনীতি বলে ধারণার জন্ম। কারণ দেশ ছাড়িয়ে পণ্য-বিনিময় করতে গেলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা লাগবে, আর সে জন্যই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক বহুরাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্ম এবং সর্বোপরি গ্লোবাল ধারণাটির উৎপত্তি।

আর তা থেকে ভূ-রাজনীতি বা ‘ভূ’ বলে যা কিছু সব অচল। যারা ‘ভূ’- বলে কোনো শব্দ ব্যবহার করছেন, তারা বেশির ভাগ এ শব্দের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন নন। তারা আসলে বোঝাতে চাচ্ছেন, জনগণ মানে পণ্য উৎপাদকরা যেন সংযুক্ত নয়। যেটি একেবারেই মিথ্যা ও অপরিপক্ব ধারণা। দুনিয়ায় আমরা এখন সবাই একই ও ‘এক গ্লোবাল অর্ডারের’ মধ্যে বসবাস করি। তাতে এর ভালো, মন্দ যাই থাকুক। অতএব, এটি এখন গ্লোবাল অর্ডার, ভূ-রাজনীতি বলে আর কিছু নেই।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //