পাহাড়ে উন্নয়নের নামে ভূমি থেকে উচ্ছেদ

পরিবেশ-প্রতিবেশ ভারসাম্যের অনিবার্য প্রাকৃতিক উপাদান হলো পাহাড়। পরিবেশ বিরুদ্ধ বাণিজ্যায়নের প্রক্রিয়া পাহাড়ি-বাঙালি সবার জন্য অমঙ্গলের। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণগুলো বাংলাদেশের মতো সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে থাকা দেশের জনগণ কমবেশি জানেন। কেবল সতর্ক হবার প্রয়োজনীয়তা প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক উপলব্ধিতে অনুপস্থিত। 

ফলে সাম্প্রতিককালে পাহাড়ি জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে পর্যটন হোটেল নির্মাণকে ঘিরে যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে, তার সুরাহা সহজ নয়। পাহাড়িদের অনুমোদন ব্যতীত পাহাড়ের জমি কি ব্যবসায়িক বা উন্নয়ন উদ্দেশ্যে দখল করা উচিত? 

ঊনিশশ’ সালের সিএইচটি ম্যানুয়াল অনুসারে, হেডম্যানদের দাপ্তরিক সম্মতির বাইরে পাহাড়ের জমি কারো কাছে হস্তান্তর বেআইনি। হেডম্যানদের সুপারিশের ওপরে রাজার অনুমতি নেবার বিধানও কার্যকর আছে। এমনকি বর্তমান নিয়ম অনুসারে সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকের অনুমোদনে পাহাড়ের জমি ব্যবহারের অধিকার পেতে হলেও পাহাড়িদের প্রতিনিধিত্বকারী সংস্থার সম্মতি আবশ্যক। পার্বত্য অঞ্চলের খাসজমি বন্দোবস্তের ক্ষেত্রেও হেডম্যানের রিপোর্টের আইনি সম্মতির গুরুত্ব আছে। 

অন্যদিকে পাহাড়ের জমির মালিক ঐতিহ্যসূত্রে হওয়ার বিধান যেমন আছে, তেমনি রেজিস্ট্রি সূত্রেও মালিক বনে যাওয়া যায়। তবে সব ক্ষেত্রেই পাহাড়ের জমি পেতে গেলে স্থানীয় বাসিন্দা হওয়া আবশ্যক। সংক্ষেপে পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধির সংশ্লিষ্টতা ছাড়া স্থায়ী বাসিন্দা হবার প্রমাণ হাওয়া থেকে জোগাড় করা সম্ভব নয়। এতকিছুর পরেও, অপাহাড়ি কেউ পাহাড়ের স্থায়ী বাসিন্দা কীভাবে হয়ে যায় সে এক রহস্য বটে।

  • পার্বত্য জেলা পরিষদ পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, কেবল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আখের গোছানোর জন্য। তবে হিসেব এত সরল নয়। হেডম্যান চাপের মুখে সুপারিশ করতে পারে। অথবা নিজেদের পাহাড়ের সন্তান বিশ্বাস করেও পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধি ভূমি-মাকে যে তুলে দিতে পারেন ব্যবসায়ীদের হাতে, তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা কি আদৌ আছে?

নানা গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে যে, পাহাড়িরা ঐতিহ্যগতভাবে নিজেদের পাহাড়ের সন্তান মনে করেন। তাই তাদের ব্যবহৃত জমির রেজিস্ট্রেশন দলিলের গুরুত্ব তারা দেশের প্রচলিত আইন অনুসারে করেন না। সমস্যা এড়াতে রেজিস্ট্রি করার নিয়ম চালু হবার পর অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর যে পাহাড়িরা তাদের দখলি জমির কাগজ তৈরি করে নিলেন, তারা কি পাহাড়ের সন্তানই রয়ে গেলেন, না মালিক বনে গেলেন- সে প্রশ্ন ওঠারই কথা পাহাড়িদের মধ্যে। সেটেলারদেরও নিয়ম অনুসারে পাহাড়ের মালিক হবার অধিকার আছে। কেবল ব্যক্তি ও ব্যবসায়িক দল কেন, মানবাধিকার ব্যবসায়ীরাও (!) কি পাহাড়ের মালিক হয়নি? পাহাড়ের প্রকৃতি রক্ষা করার অজুহাতে অবকাঠামো বানাতে গিয়ে বন ও বন্যপ্রাণী সুরক্ষাদাতারাও বাস্তবে পাহাড়ের মালিক হয়েছেন! মালিকাকানা প্রতিষ্ঠার পর সংশ্লিষ্ট সীমানায় মালিক দালান তুলবে, সেতু বানাবে, নাকি ঝিরি বয়ে যাওয়ার পথ করে দেবে- সে তো মালিকের ইচ্ছা। বিশেষ অঞ্চলের জমি বাণিজ্যিক বিনোদন উৎপাদন করার জন্য বরাদ্দ দেবার সুপারিশ করা ও অনুমোদন দেবার আগে স্থানীয় পাহাড়ি নেতৃবৃন্দ নিশ্চয় তা মাথায় রাখেন। 

‘সাজেক ভ্যালি’তে রিসোর্ট নির্মাণকালেও আন্দোলন হয়েছিল; কিন্তু স্থানীয় কুকি (লুসাই, পাংখোয়া) জনজাতি ‘রাজি’ না হলে কি এটি সম্ভব হতো। সেখানে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিনোদন স্পট বানানোতে আন্তর্জাতিক নীতি, স্থানীয় বিধি-বিধান, সবকিছু মানলে অবশ্যই তা সম্ভব হতো না। সাজেকের স্থানীয় জনগোষ্ঠী লোভের ফাঁদে পা দিয়েছিলেন। তারা মনে করেছিলেন রিসোর্ট হলে তাদের আয়েশের জীবন হবে। উন্নত জীবন হবে। রিসোর্টে ঝাড়ুদার, মালি, চাকর হয়ে তারাও পাবেন পুঁজির চোয়ানির স্বাদ নিতে। আসলে পুঁজি এমন ক্ষমতাই অর্জন করেছে যে, সেই উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। প্রবৃদ্ধির আলোকে যেমন দেশের উন্নতি মাপা হয়, তেমনি টাকার গন্ধ ছড়ানোর মাত্রা দিয়ে দরিদ্র মানুষের উন্নতি মাপা যায় জীর্ণ সমাজে। আসল রহস্য এখানেই। 

রিসোর্ট-হোটেলে বিনিয়োগকারীদের থেকে দরিদ্র শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবাবঞ্চিত পাহাড়ি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বৈষম্যের পরিমাপ কতো বিশাল তা অনুমানও করতে পারে না স্থানীয় মানুষগুলো। তো সাজেকের ঐতিহ্যসঞ্জাত সন্তানরা এখন গভীর দূরত্ব বজায় রেখে বা রাষ্ট্রীয় সীমানার ওপার থেকে হা করে চেয়ে দেখে সাজেকের উন্নতি! পাহাড়িদের মধ্যে যারা ‘বেশি পাহাড়ি’- কারবারি, হেডম্যান, রাজা, পার্বত্য জেলা পরিষদের ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি- তারা কি পারেন এই পরিণতির দায় এড়াতে? 

চিম্বুক পাহাড় রক্ষা করার মানসে ম্রোদের বর্তমান ঐক্যবদ্ধ আওয়াজের ব্যাখ্যা হলো, তাদের নেতার সুপারিশে সর্বস্তরের ম্রো জনগণের অংশগ্রহণ ছিল না। এখন হেডম্যান যদি আর্থিকভাবে, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হবার বিনিময়ে হোটেল বানানোর জন্য সিকদার গ্রুপ তথা আর অ্যান্ড আর কোম্পানিকে পাহাড়ের জমি ব্যবহার করতে দেবার সুপারিশ করে থাকেন, সে অনুযায়ী রাজার সম্মতি থাকে এবং তাতে জেলা প্রশাসকের আইনি সমর্থন থাকে, তাকে ম্রো জনগণের সম্মতি হিসেবে প্রচার করাই যায়। পার্বত্য জেলা পরিষদ পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে, কেবল ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আখের গোছানোর জন্য। তবে হিসেব এত সরল নয়। হেডম্যান চাপের মুখে সুপারিশ করতে পারে। অথবা নিজেদের পাহাড়ের সন্তান বিশ্বাস করেও পাহাড়ি জনগণের প্রতিনিধি ভূমি-মাকে যে তুলে দিতে পারেন ব্যবসায়ীদের হাতে, তাদের জবাবদিহির ব্যবস্থা কি আদৌ আছে?    

আদিবাসী জনজাতির অধিকারবিষয়ক জাতিসংঘ ঘোষণাপত্রের অনুচ্ছেদ ৮ ২ (খ)-এর মোতাবেক, রাষ্ট্র এমন কার্যকর নীতি বাস্তবায়ন করবে, যাতে সে সব কার্যাবলি প্রতিরোধ ও প্রতিকার করা যায় যেগুলোর কারণে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষরা তাদের ভূমি, অঞ্চল বা সম্পদ থেকে বিতারিত হয়। রাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠান নিশ্চয় দায়িত্ব পালন করবে। 

বান্দরবানের চিম্বুক পাহাড়ে ম্যারিয়ট হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট নির্মাণ বন্ধ করার দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের ৬২ জন বিশিষ্ট নাগরিক যৌথ বিবৃতিতে বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান, পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন, ভূমি বিরোধ নিস্পত্তি কমিশন আইন লঙ্ঘন করেন ম্রো জাতির স্বাধীন ও পূর্ব সম্মতি ছাড়া তাদের বিবেচনায় না নিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জোর করে বিলাসী স্থাপনা নির্মাণ ম্রো সম্প্রদায়ের ওপর আগ্রাসন। তারা বিষয়টিকে প্রিন্সিপাল অব ন্যাচারাল জাস্টিসের লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

প্রকৃতপক্ষে একজন নাগরিকেরও জীবন ও জীবিকার অধিকার লঙ্ঘন হওয়া বা প্রতিবেশ-বিরুদ্ধ উন্নয়ন অনুমোদন পাওয়া ম্লান করে দেয় পুরো রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি।

লেখক- নূরুননবী শান্ত, কথাসাহিত্যিক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //