রাজনীতির আত্মঘাতী নীতি ও কৌশল

দেশ ও দেশের মানুষ এখন বহুমুখী সংকটে জর্জরিত। নানা কায়েমি গোষ্ঠী আবার ঘর পোড়ার মধ্যে আলু পোড়া দিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। করোনাভাইরাস দুর্যোগের প্রথম ঢেউয়ের রেস কাটতে না কাটতেই দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিপর্যয় শুরু হয়েছে। সরকারি প্রেসনোট অনুযায়ী এখন প্রতিদিন গড়ে মৃত্যু ৩৫ এর ওপর ও ভাইরাস শনাক্ত আড়াই হাজারের ওপরে। করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসার বেহাল দশা মোটামুটি আগের মতোই। চিকিৎসা ও হাসপাতালের ওপর অনাস্থা এখনো প্রবল। মারাত্মক না হলে কেউ আর হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন না। অধিকাংশ রোগী ঘরকে হাসপাতাল হিসেবে গণ্য করে বাসা-বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

অতিমারীর এ সময়কালে রোমহর্ষক দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারও আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। মহামারির দুর্যোগ এদের জন্য বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। কেবল এ সময়কালেই সাড়ে তিন হাজার নতুন কোটিপতি পরিবারের জন্ম হয়েছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ধর্ষণ, নারী, শিশু নিপীড়নের মতো সামাজিক অনাচার। থেমে নেই সন্ত্রাসী-মাফিয়াদের তৎপরতা। চলছে দখল-জবরদখল ও ভূমি গ্রাসীদের আগ্রাসী তৎপরতা। সবচেয়ে বেপরোয়া এখন বাজার সিন্ডিকেট। মুনাফাখোর অসৎ বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে কোটি কোটি ভোক্তা সাধারণ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত প্রায়। এরা মানুষকে রীতিমতো জিম্মি করে ফেলেছে।

সরকারের দিক থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণে বাস্তবে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের মধ্যে যেন এই সিন্ডিকেটগুলো আরেক সরকার, বোঝাই যায়, এদের হাত অনেক লম্বা। এরা দিনকে রাত আর রাতকে দিন বানাতে পারে। সরকারের প্রভাবশালী নানা অংশের সঙ্গে এই মাফিয়া সিন্ডিকেটের আঁতাতের কারণেই এরা এতখানি বেপরোয়া। এরাও বিদ্যমান নৈরাজ্যিক অবস্থার সুযোগ গ্রহণ করছে ও রাতারাতি মানুষের পকেট থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। সামাজিক নৈরাজ্যের এই ক্রমবিস্তারে জীবন-জীবিকার সংকটও প্রবল হয়ে উঠছে। দরিদ্র-হতদরিদ্রের সংখ্যা মারাত্মকভাবে বেড়েছে। 

আশঙ্কা করা যাচ্ছে আগামী ছয়মাসে আরো কয়েক লাখ পরিবার নতুনভাবে দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে আসবে। এদের বড় অংশের উপযুক্ত কর্মসংস্থান নেই; বেকারত্ব-ছদ্ম বেকারত্ব এদের জীবনকে দুঃসহ করে তুলেছে। চুরি-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণের কারণে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও অনেকখানি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে।

  • (এদের ঔদ্ধত্ব্য এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এরা এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে ও তার ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই অশুভ তৎপরতা এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে এরা এখানেই থেমে থাকবে না; বাড়তে দিলে এরা এদের আসল চেহারা নিয়ে হাজির হতে থাকবে..........)

এর মধ্যে ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্টশক্তি আবার তাদের নখ দেখাতে শুরু করেছে। ভোটের অধিকার হরণ করে গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব করে সমাজে চরম দক্ষিণপন্থী মৌলবাদী শক্তির উত্থানের জমিন তৈরি করে দেয়া হয়েছে। মুক্ত চিন্তা অবরুদ্ধ করে গোটা সমাজ ও দেশকে ক্রমান্বয়ে আরও অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার পথ প্রশস্ত করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সংস্কৃতির পরিসর যত সীমিত ও দুর্বল হয়েছে, সমাজে কূপম-ূক, সাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ এবং মন-মানসিকতা ততই বিস্তার লাভ করেছে। সরকার সাপের মুখে চুমো খাওয়া আর ব্যাঙের মুখে চুমো খাওয়ার দ্বিমুখী কৌশল অনুসরণ করে আসছে। এটা স্পষ্ট, যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকার রাজনৈতিক সমীকরণ থেকে তারা নানা রকম কৌশল অবলম্বন করেছে; যা দেশের অবশিষ্ট গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক কাঠামো ও সংস্কৃতিকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে। সরকারের এই দ্বি-চারী ভূমিকা, মদদ ও প্রশ্রয়ের কারণে আজ সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারছে এবং ভাস্কর্যের বিরুদ্ধে আস্ফালন দেখাতে পারছে; শেখ মুজিবের ভাস্কর্যকেও আঘাত করছে। 

বিএনপির জামায়াত আঁতাতকে ব্যালেন্স করতে গিয়ে আওয়ামী লীগ-হেফাজত ঘনিষ্ঠতা, হেফাজতের দাবির কাছে মাথানত করে পাঠ্যপুস্তকের সিলেবাস পরিবর্তন, হেফাজত কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর ‘কওমি জননী’ উপাধি লাভ, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ সনদ প্রদানের স্বীকৃতি, হেফাজতকে নানা ধরনের বৈষয়িক ও আর্থিক প্রণোদনা প্রভৃতি নানাভাবে হেফাজতসহ এই মৌলবাদী শক্তিসমূহকে মদদ ও ইন্ধন জুগিয়ে আসছে; তাদের সরকার বিরোধী রাজনৈতিক তৎপরতা থেকে বেশ নিরাপদ দূরত্বেই রাখতে পেরেছে। এটা নিশ্চয় সরকার ও সরকারি দলের আপাতত দৃশ্যমান একটি সাফল্য; কিন্তু আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে এখন সরকারের পায়ে আগুনের আঁচ লাগতে শুরু করেছে। এদের ঔদ্ধত্ব্য এই পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এরা এখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছে ও তার ভাস্কর্যকে বুড়িগঙ্গায় নিক্ষেপ করার ঘোষণা দিয়েছে। এই অশুভ তৎপরতা এখনই প্রতিরোধ করতে না পারলে এরা এখানেই থেমে থাকবে না; বাড়তে দিলে এরা এদের আসল চেহারা নিয়ে হাজির হতে থাকবে। সরকারের এই আত্মঘাতী নীতিকৌশল শেষ পর্যন্ত সরকারকে কতখানি রাজনৈতিক পুঁজি জোগাবে তা দেখার জন্য হয়তো আরো কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

ভাস্কর্য ইস্যুকে কেন্দ্র করে সরকারের পক্ষ থেকে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ ঘটাবার চেষ্টা চলছে তা একদিক থেকে সরকারকে লাভবান করছে। এই ইস্যু যত প্রলম্বিত হবে সরকারের কর্তৃত্ববাদী স্বৈরতান্ত্রিক শাসন তত আড়ালে রাখা যাবে; ভোটাধিকারসহ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক প্রশ্নসমূহ, দুর্নীতি-দুর্বিত্তায়ন, সামাজিক নৈরাজ্য, খাদ্য-বেকারত্বসহ জনগণের বেঁচে থাকার ইস্যু এবং এসব প্রশ্ন কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী গণআন্দোলন-গণসংগ্রামের সম্ভাবনা দুর্বল ও ছত্রভঙ্গ করে রাখা যাবে। এই অবস্থায় আমজনতা ‘পা না ধরে, লাঠি নিয়েই’ টানাটানি করতে থাকবে। এ কারণে মৌলবাদী শক্তির বর্তমান তৎপরতার পিছনে সরকারের কোনো মহলের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা পরিকল্পনা রয়েছে কিনা-এই প্রশ্নও ইতিমধ্যে নানা জায়গা থেকে উঠে এসেছে।

বিদ্যমান ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনকামী রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি যদি আবারও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এই কৌশলী ফাঁদে জড়িয়ে পড়ে তাহলে সর্বনাশ ঘটার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। পরিবর্তনকামী প্রকৃত গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঠ্যাং বাদ দিয়ে লাঠি ধরে টানাটানি করে লাভ হবে না। জনগণের ভোটাধিকারসহ আশু গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দাবিসমূহের ভিত্তিতে কর্তৃত্ববাদী স্বৈরশাসন বিদায় দেবার লড়াইয়ে শ্রম ও মনযোগ নিবন্ধ করা প্রয়োজন। এই লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক পরিসর যত বৃদ্ধি পাবে, মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক শক্তি ও প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে গণচেতনাও তত শানিত হবে। 

একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক পরিবেশে সমাজের নানা জায়গা থেকে উত্থিত ইস্যুসমূহ কীভাবে মীমাংসা করা যাবে- আগামীতে তার গণতান্ত্রিক পথ নিশ্চয় খুঁজে বের করতে হবে।

-লেখক: সাধারণ সম্পাদক

বাংলাদেশের বিপ্লবী 

ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //