অসম্ভবকে সম্ভব করলেন শেখ হাসিনা

যেদিন পদ্মা সেতুর শেষ স্পেনটি বসানো হয়, সেদিন ফেসবুকে একটি ছবি ভাইরাল হয়েছিল। এক ব্যক্তি পদ্মা সেতুর সামনে দাঁড়িয়ে বুকে বাংলাদেশের লাল-সবুজ পতাকা জড়িয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছিলেন। ছবিটি বলে দিচ্ছিল অনেক না বলা কথা। ছবিটির মর্মকথা অনুবাদ করলে এই দাঁড়ায়, ‘বাংলাদেশ পারে, অসম্ভবকে সম্ভব করে দেখাতে। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ দেখিয়ে দিয়েছে এই দেশ যে কোনো অংশে কম নয়।’

সত্যিটা দেখিয়ে দিলেন শেখ হাসিনা। জেদ মানুষের জন্য অকল্যাণকর। জেদ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অশান্তি, অসফলতা ও দুর্ভোগ বয়ে আনে; কিন্তু জেদ যে কখনো কখনো সফলতাও বয়ে আনে, তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। শেখ হাসিনার জেদ আর অদম্য সাহসের কারণে পদ্মার বুকে আজ শোভা পাচ্ছে এক বিশাল সেতু। এটি কেবলই একটি সেতু নয়, এটি বাংলাদেশের গৌরবের প্রতীকও বটে। যখন এই সেতু নির্মাণের প্রস্তুতি শুরু হয়েছিল, সেই সময়ের ঘটনা তো এ দেশের মানুষ জানে। কোনো প্রমাণ ছাড়াই পদ্মা সেতুর কর্মকাণ্ডে দুর্নীতির অভিযোগ তোলা হলো। সেই অভিযোগে তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন পদত্যাগ করেন আর তখনকার সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে গ্রেফতারের পাশাপাশি চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। কানাডার একটি কোম্পানি এসএনসি-লাভালিনের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ পাওয়ার চেষ্টার অভিযোগ করে। এই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে তাদের ঋণ বন্ধ করে দেয়। বিশ্বব্যাংকের সুরে সুর মেলালেন নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ সুশীল সমাজের অনেকে। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বললেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বারা কখনোই পদ্মা সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না। পদ্মা সেতুর কথা বলে মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে সরকার। বিএনপি ক্ষমতায় এলে দুটি পদ্মা সেতু বানাবে। একটি শিমুলিয়ায়, অন্যটি পাটুরিয়ায়।’

শেষ পর্যন্ত পদ্মা সেতু নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগে করা মামলাটি কানাডার আদালত খারিজ করে দেয়। পাঁচ বছরের বেশি সময়ের বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে কানাডার আদালত বলে, ‘এই মামলায় যেসব তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা অনুমানভিত্তিক, গালগল্প এবং গুজবের বেশি কিছু নয়।’ সেই রায়ে প্রমাণিত হয়, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই ওই অভিযোগ আনা হয়েছিল। সেই সময় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকেও চলছিল পদ্মা সেতু নিয়ে তর্ক-বিতর্ক। 

কিন্তু সব কিছুকে পাশ কাটিয়ে শুরু হলো পদ্মা সেতুর নির্মাণযজ্ঞ। উন্নয়নবিরোধী, দেশবিরোধী এবং অশান্তিপ্রিয় কিছু মানুষের ঘুম উবে গেল। পদ্মা সেতুর কাজ শুরু হয়ে গেছে, এ কী করে সম্ভব! তারা শুরু করে দিলেন নতুন কুৎসা। সারাদেশে গুজব ছড়িয়ে দিলেন পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা প্রয়োজন, মাথা দেওয়া হচ্ছে সেতুর পিলারের গোড়ায়। ছেলেধরা সন্দেহে নিরপরাধ মানুষদের গণপিটুনি দিয়ে মারা হতে লাগল। আজ এখানে তো কাল ওখানে। সেই তাসলিমার কথা কি কখনো ভোলা যাবে, যে রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা প্রাথমিক স্কুলে মেয়েকে ভর্তি করার জন্য খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন? তাকে ছেলেধরা সন্দেহে স্কুলের বাইরে এনে বেধড়ক মারধর করা হয়। মারের চোটে তিনি মারা গেলেন। তাসলিমার মতো এমন অনেক নির্দোষ মানুষকে প্রাণ বলি দিতে হয়েছে। 

পদ্মা সেতু আমাদের বিজয়ের প্রতীক, আমাদের সক্ষমতার প্রতীক, আমাদের বীরত্বের প্রতীক। সদিচ্ছা থাকলে যে-কোনো কাজ করা যে আমাদের পক্ষে সম্ভব, তার প্রমাণ পদ্মা সেতু। আগামী এক বা দেড় বছরের মধ্যে পদ্মা সেতুর সব কাজ শেষ হবে। তারপরই শুরু হবে সেতুর ওপর দিয়ে যান চলাচল। এই সেতুর কারণে সোনালি ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে ২১ জেলার মানুষ। এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক যোগাযোগে ভূমিকা রাখবে এই সেতু। পদ্মার দুই পারে গড়ে তোলা হবে সিঙ্গাপুর ও চীনের সাংহাইর আদলে শহর। মোট জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার ৫% পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে। ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ কোটি লোকের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্র তৈরি হবে এবং জাতীয়ভাবে দারিদ্র্যের হার কমবে ০.৮ শতাংশ।

উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের প্রশংসা করা যায়; কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি জনগণের মননের উন্নয়ন কি হচ্ছে? সরকার কি পারছে মানুষের মনন বিজয় করতে? না, মনন অনেক তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বৈশ্বিক জ্ঞানসূচকেও তলানিতে রয়েছে বাংলাদেশ। সম্প্রতি জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইভিত্তিক মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম নলেজ ফাউন্ডেশনের যৌথ উদ্যোগে বৈশ্বিক জ্ঞানসূচক-২০২০ প্রকাশ হয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে ১৩৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১২তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ রয়েছে সবার নিচে।

তার মানে বোঝাই যাচ্ছে, জ্ঞান ও মননের উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সমাজে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অপরাধ। রাজনীতিকে ব্যবহার করে যা ইচ্ছে তাই করছে একটি চক্র। তাদের লাগাম টেনে ধরার কেউ নেই। চিকিৎসার নামে গলা কাটছে বেসরকারি হাসপাতালগুলো। সেবার পরিবর্তে ডাক্তাররা হয়ে উঠেছে কসাই। স্কুল-কলেজের বদলে শিক্ষা চলে গেছে কোচিং সেন্টারে। বিদেশের পাচার হয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। এক হেফাজত নেতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেওয়ার, লাশের পর লাশ ফেলার হুমকি, বঙ্গভবন গণভবন সংসদ ভবন রক্তে ভাসিয়ে দেওয়ার এবং বায়াত্তরের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা বাদ দেওয়ার ঘোষণা দিলেন, অথচ তার বিরুদ্ধে এখনো পর্যন্ত কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ধর্মব্যবসায়ীদের উস্কানিতে মৌলবাদীরা কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য ভাংচুর করেছে।

মানুষের জ্ঞান ও মননের যে অধঃপতন, এই অবস্থা দীর্ঘদিন চলতে পারে না। জনগণের মানসিকতা উন্নয়নের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এর দায় রাষ্ট্রের। কোনো কিছুই রাষ্ট্র বা রাজনীতির বাইরে নয়। মানুষের মনন তৈরি করার দায়ও রাষ্ট্রের। আমরা চাই খুন, ধর্ষণ, বলাৎকার, দুর্নীতিহীন এবং ধর্মান্ধতামুক্ত একটি দেশ। এমন দেশ গড়ার জন্য জনগণের মনন গড়তে হবে আগে। সরকারকে জনগণের মনন বিজয়ের ওপর জোর দিতে হবে। তবেই অর্থবহ হবে অবকাঠামোগত উন্নয়ন।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //