মুজিব বর্ষে প্রত্যয় ও প্রার্থনা: বিজয় দিবসের পরম প্রাপ্তি পদ্মা সেতু

কামালউদ্দিন কবিরদেশ আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপণের দ্বারপ্রান্তে। একই সময়ে সশ্রদ্ধ স্মরণে ও কর্মসূচিতে উদযাপিত হচ্ছে জাতির পিতার জন্মশতবর্ষ, মুজিববর্ষ। দেশ ও জাতির জন্য এ এক সবিশেষ সন্ধিক্ষণ। 

একদিকে বিশ্বব্যাপী বিদ্যমান অতিমারির ছোবল, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে দেশবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধ অপশক্তির তাণ্ডব- এসবের মধ্যে এবারের বিজয় দিবসের প্রাক্কালে দেশবাসীর চোখের সামনে দৃশ্যমান হলো দীর্ঘদিনের স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পূর্ণ অবয়ব। স্বাধীনতার মৌল চেতনা বা মর্যাদা বাস্তবায়নের অনন্য দৃষ্টান্ত এই পদ্মা সেতু।

প্রমত্তা পদ্মার বুকে গড়ে তোলা দেশের দীর্ঘতম সেতু ও বৃহৎ অবকাঠামো নির্মাণ যজ্ঞে যেসব কাণ্ড-কুকাণ্ড জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ঘটে গেল, তা আমরা দেশবাসী অবাক-বিস্ময়ে প্রত্যক্ষ করেছি। জাতির পিতার কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অসীম ধৈর্য্য ও ইস্পাতদৃঢ় মনোবলে স্বাধীন স্বদেশভূমির সার্বভৌমত্ব ও সাফল্যের অমরগাথা রচনা করেছেন, যা বোধ করি বিশ্ব ইতিহাসে বিরল। 

আমাদের জাতীয় সংগীত, রবীন্দ্রনাথ প্রণীত স্বদেশ পর্যায়ের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের পূর্ণ পাঠরূপের শেষাংশে ব্যক্ত হয়েছে এই কথা- ও মা, গরিবের ধন যা আছে তাই দিব চরণতলে,/ মরি হায়, হায় রে-/ আমি পরের ঘরে কিনব না আর, মা, তোর ভূষণ ব’লে গলার ফাঁসি।। বিশ্ব মোড়লদের দানে-দক্ষিণায় ‘গলার ফাঁসি’ আমাদের পরতে হয়নি, বরং নিজ বলে বলীয়ান হয়ে নিজস্ব অর্থায়নে, ‘গরিবের ধন যা আছে’ তা দিয়েই গড়ে তুলেছি স্বাধীন স্বদেশভূমির অনিন্দ্য ভূষণ এই পদ্মা সেতু; কিন্তু দুর্ভাগ্য আমাদের মহান বিজয়ের পঞ্চাশতম বর্ষে এসেও আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে, সেই পুরনো শকুনদের। ‘ফসলের সুষম বণ্টন’কে আমরা আমাদের ধর্ম করে তুলতে পারিনি। মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশ-সমাজ ও মানুষ গড়বার বদলে, আমাদের তরুণ যুবসমাজকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোগবিলাসের লীলাক্ষেত্রে। মনুষ্যত্ব বোধের পরিচর্যা, বিকাশকে শিক্ষার প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত না করে শিক্ষাকে কেবল সনদপত্র প্রদান ও প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধ করা হয়েছে। দেশে চলমান বহুধা বিভক্ত শিক্ষা পদ্ধতি ও ব্যবস্থার ফাঁক-ফোকরে ছড়িয়ে পড়েছে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী যাবতীয় অপতৎপরতা। মৌলবাদ কিংবা ধর্মান্ধতার বিষবাষ্প কেবল গোপন জঙ্গি আস্তানায় নয়, এখন তা প্রকাশ্যে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। দেশজাতির জীবনে সবিশেষ এবারকার এই বিজয়ের মাসে তারা জাতির পিতার ভাস্কর্য ভাঙার ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। আগে এই অপশক্তিকে তাদের চিন্তায় কথায় জাতির পতাকা খামচে ধরতে দেখেছি। আর এখন সেই অপশক্তি জাতির পতাকা প্রকাশ্যে গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার বিরুদ্ধে সংবিধানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিচ্ছে। দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসা, মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে সশ্রদ্ধ সম্পর্ক স্থাপনের শিক্ষা ব্যতিরেকে এই অন্ধকার দূর করা সম্ভব হবে না।

স্বাধীনতার পঞ্চাশতম বর্ষের দ্বারপ্রান্তে এসে এতসব নেতিবাচক অভিজ্ঞতার বিপরীতেও দেশ ও জাতির ইতিবাচক অগ্রযাত্রার অনন্য নজির স্থাপন করলেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। পদ্মা সেতু নির্মাণকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তিনি দেশের জন্য মঙ্গল-অমঙ্গল, শুভ-অশুভ, উচিত-অনুচিত বোধের কা-জ্ঞানটুকু দেশবাসীর মধ্যে তৈরি করে দিতে পেরেছেন বলে মনে করি। জাতির পিতার হত্যাকা-ের বিচার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং পদ্মা সেতু নির্মাণ ঘটনার মধ্য দিয়ে আমার সোনার বাংলায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

পদ্মা নদীর দুই পাড়কে যুক্ত করার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির যোগফল যে আরও বিস্তৃত হবে, তা বিশেষজ্ঞ থেকে আমজনতা সবাই ভালোভাবেই অনুধাবন করতে পারছি। তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, অর্থনীতির চাকা  ঘোরবার সঙ্গে সঙ্গে লুটেরা-দুর্বৃত্তদের তৎপরতাও যে বৃদ্ধি পাবে তা আমরা সহজেই অনুমান করতে পারি। শিল্প-কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা-সংস্কৃতি উন্নয়নের যথাযথ উদ্যোগ বা কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করা না হলে সে উন্নয়ন কেবল নামেমাত্র উন্নয়ন হবে। আর এ কারণে সমাজে দুই ধরনের ভোগবাদী শ্রেণি তৈরি হবে। ইতিমধ্যেই আমরা তা প্রত্যক্ষ্য করেছি। একশ্রেণি লুটপাটের মাধ্যমে অর্জিত ধনসম্পদের ভোগবিলাসে- দুনিয়াতেই স্বর্গীয় আরাম আয়েশে মত্ত, আর এক শ্রেণি দেশাত্মজ্ঞান বর্জিত মানবিক মূল্যবোধবিহীন শিক্ষায় বেড়ে উঠে পরলোকে স্বর্গলাভের আশায় দুনিয়াতে নারকীয় পরিস্থিতি তৈরি করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করে না।

পায়রা, বিষখালী, আন্ধারমানিক, আগুনমুখা, আড়িয়াল খাঁ, সন্ধ্যা, কীর্তনখোলা নদী বিধৌত বিস্তীর্ণ জনপদে জনকল্যাণমুখী উন্নয়ন অবশ্যই বিস্তারিত হোক; তবে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যকে আমরা যেন কলুষিত না করি। যাবতীয় উন্নয়ন কর্মপরিকল্পনার সর্বাগ্রে শিক্ষা, বিশেষত শিশু শিক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হবে। দেশের মানুষের কাছে, আগন্তুক পর্যটকের কাছে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যসহ সামগ্রিক সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরতে হবে। সদাচার, উৎকর্ষ ও আনন্দময় মানবিক দেশ-সমাজ-পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যই হোক মুজিববর্ষ ও বিজয়ের একান্ত প্রত্যয় ও প্রার্থনা।

অধ্যাপক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //