৮৯তম জন্মদিনে শ্রদ্ধা

বদরুদ্দীন উমর: বিপন্ন ও বিভ্রান্ত সময়ের বিরুদ্ধ প্রতিনিধি

২০২০ সালের ২০ ডিসেম্বর ঊননব্বইতম জন্মদিন অতিক্রম করেছেন বদরুদ্দীন উমর। সাতচল্লিশের আগে ও পরে তিনি যে স্থান, কালের মধ্যদিয়ে জীবনকে দেখতে শিখেছিলেন, সেটা ছিল বিপন্ন সময়। ব্রিটিশ আমল থেকে নিয়ে পাকিস্তান পর্ব দুই-ই ছিল এই বিপন্ন সময়ের শিকার। তাতে বিভ্রান্তি ছিল না। 

কারণ আমাদের জানা ছিল যে, ইংরেজরা আমাদের শত্রু। পাকিস্তানপর্বে এসেও আমরা নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেণি পূর্ব পাকিস্তানের দুশমন। বাঙালি জীবনের এই দুই পর্বে বিভ্রান্তির প্রশ্ন আসেনি। কেননা শত্রু  চিনতে আমরা ভুল করিনি। 

বদরুদ্দীন উমর পাকিস্তান পর্বের শেষলগ্নে যে তিনটি বই লিখেছিলেন, সেখানে যে সময়কে চিহ্নিত করা হয়েছে, তা বিপন্নতায় আক্রান্ত। তখনকার পূর্ববঙ্গের বাঙালি জীবনের পক্ষে- বিশেষত, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক জীবনে সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা বই তিনটি ছিল পাকিস্তানি আদর্শের বিরুদ্ধে বাঙালির মুক্তির পক্ষে এক অসামান্য প্রতিষেধক। অবশ্য আকারে তিনটি বই হলেও, আসলে একই বিষয়ের তিনটি খণ্ড মাত্র, বিপন্ন সময়ের দলিল।

মুক্তিযুদ্ধের পরে এর পরবর্তী ইতিহাস ভিন্ন সংকটে আবর্তিত হলো। দৃশ্যত, আমরা দেখলাম যে, আগের শত্রু  নেই; কিন্তু নতুনভাবে যা এলো, তা আমাদের বিভ্রান্ত করে তুলল। আমাদের সংবিধানে একটি নয়, দুটি নয়, চারটি নীতি যুক্ত হয়ে গেল। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ আর ধর্মনিরপেক্ষতার মধ্যে কোনটির ওপর কোনটি প্রাধান্য পাবে, আমরা তা জানতে পারলাম না। এসব নীতির মান্যতা ও ব্যবহার নিয়ে আমাদের শিক্ষার মধ্যে কোনো জিজ্ঞাসা থাকল না। ফলে এই নীতিগুলো সম্পর্কে আমাদের কোনো ধরনের জ্ঞানই তৈরি হলো না। এসব বিষয়ে জনসাধারণ কার্যত ঘন-অন্ধকারেই থেকে গেল। 

মুক্তিযুদ্ধের পরে গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা কোথাও দেখা গেল না। সমাজতন্ত্র সংবিধানের পাতায় থেকে গেল একেবারে নীরব হয়ে। বলা ভালো, আমাদের সংবিধানের একটি মৃত নীতির নাম সমাজতন্ত্র। 

এরই মধ্যে আমাদের জাতীয়তাবাদের ধরন নিয়ে তর্ক উঠল! আমাদের পরিচয় ‘বাঙালি’ না কি ‘বাংলাদেশি’। শেখ মুজিবুর রহমান যখন বাংলাদেশের সব নাগরিককে বাঙালি হয়ে যাওয়ার কথা বলেন, তখন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লোকেরা এ কথাকে সহজভাবে মেনে নিতে সম্মত হননি। তারা বরং ‘বাংলাদেশি’ হতে আগ্রহ দেখিয়েছেন, বাঙালি হিসেবে নয়। সে-তর্কে অবশ্য দুটিই প্রাধান্য পেল। নাগরিক অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে আমাদের পরিচয় কায়েম হলো বাংলাদেশি বলে। নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ে আমরা হলাম বাঙালি।

সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদের মান্যতার প্রশ্নে, বাংলাদেশ পর্বে যে-ধর্মনিরপেক্ষতাকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করা হয়েছে, তার রূপের মধ্যে দেখা দিয়েছে এক জটিল দৃষ্টিভঙ্গি। ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও সেই রাষ্ট্রের তাত্ত্বিক প্রভাব থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ করা হলো সব ধর্মের সমান অধিকার অথবা দেশে প্রচলিত বিভিন্ন ধর্ম ও সেসব ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে পক্ষপাতহীনতা, যার দরুন বেতারে, টেলিভিশনে, রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে- সর্বত্র ধর্মীয় গ্রন্থসমূহ থেকে পাঠ হতে লাগল একসাথে। শুধু তাই নয়, বঙ্গভবন বা গণভবনে মিলাদ-মাহফিলও আয়োজিত হলো। পাকিস্তান আমলে আমাদের চলতে হতো এক ধর্ম নিয়ে, বাংলাদেশে চলতে থাকলাম চার ধর্ম নিয়ে। কথায় কথায় রাষ্ট্রীয় পদাধিকারীরা ঘোষণা করলেন, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়।

একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল এর মধ্যে। সুসম্পন্ন হয়ে গেল ১৯৭৭ সালের সামরিক আইনের মধ্য দিয়ে। এই সময় সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ তুলে দিয়ে তার জায়গায় বসানো হয় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ ও সংবিধানের গোড়ায় ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’। ১৯৮৮ সালে সংবিধানে যুক্ত হয় রাষ্ট্রধর্মের বিধান: ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, তবে অন্যান্য ধর্ম ও প্রজাতন্ত্রে শান্তিতে পালন করা যাইবে।’ সংবিধানের এই সংশোধনীর ফলে অমুসলমান নাগরিকদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকে পরিণত করা হলো। ১৯৯০ ও ১৯৯২ সালের সাম্প্রদায়িক নির্যাতনে এর যে ফল প্রত্যক্ষ হয়ে উঠল, তা এমনিভাবে গড়িয়ে চলল যে, নিরসনের আর কোনো পথ দেখা গেল না।

তার মানে, ধর্ম নিরপেক্ষতা গেল, বাঙালি জাতীয়তাবাদ গেল, সমাজতন্ত্র গেল আর গণতন্ত্র? ১৯৭৭ সালের পরে তো দীর্ঘ সময় ধরে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে সামরিক শাসনের অধীনে চলে গেল। বাংলাদেশের এই যে চিত্র, এটাকে সরল বাংলায় বলা যায় এক মহাবিভ্রান্তি। বদরুদ্দীন উমর ক্রমাগত এই বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে লিখেছেন। তার প্রায় সমস্ত লেখালেখির বিষয় সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস, রাজনীতি, নৃতত্ত্ব, কৃষি ও কৃষক, ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ প্রভৃতি। তার লেখালেখি কখনো থেমে থাকেনি। তিনি শাসকশ্রেণির ভয়ে ভীত হননি। মাথা উঁচু করে সত্য কথা বলায় তার তুলনা নেই। এক্ষেত্রে তিনি সম্ভবত একক ব্যক্তি, যিনি কোনোদিনই পরোয়া করেননি শাসকের চোখ রাঙানো। আমাদের দেশের অধিকাংশ লেখক যেখানে রাষ্ট্রীয় নানা পুরস্কার ও খেতাব-পদমর্যাদার লোভে নিজেকে বিক্রয় করে বসেছেন, আত্মবিকৃতির অসংখ্য নজির মেলে যে-সংস্কৃতির বিদ্বান সমাজের পরতে পরতে, সেখানে তিনি এই নির্লজ্জ বেহায়াপনার বিরুদ্ধে কলম চালিয়েছেন। মেরুদণ্ডসম্পন্ন এমন জীবন বহন করা সত্যি কঠিন। অজানা, কূলহীন, এমন ভয়াবহ জীবন তিনি বেছে নিয়েছিলেন যে বয়সে, তার নজির আমাদের সংস্কৃতিতে বেশি মেলে না! 

তিনি জীবনে চাকরি করেছিলেন চারটি। তার একটিরও মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি চাকরিদাতা সংস্থা কিংবা শাসকশ্রেণির দৌরাত্ম্যের কারণে। তার মহৎ মন ও বৃহৎ স্বপ্ন তাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মহত্তম এক মানবমুক্তির জিজ্ঞাসায়। সেখানে তিনি নিজেকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে এগিয়ে নিয়েছিলেন। নিজের কথা বলতে গিয়ে উমর তার আমার জীবন বইয়ের এক স্থানে লিখেছেন, ‘নিজের চিন্তাচেতনা ও ধারণার সাথে জীবনের বাস্তবতা বা বাস্তব factor সমূহের মিল অথবা গরমিল যে সচেতনভাবে লক্ষ্য না করে তার চিত্তের বিকাশ সম্ভব নয়। চিন্তা ও ধারণা শুদ্ধ করার জন্য বাস্তব জীবনের সাথে তাকে মিলিয়ে দেখে বিচার করার গুরুত্বের সীমা নেই।’

বদরুদ্দীন উমরের চিন্তার মধ্যে একটা ধ্রুব-স্থির নক্ষত্রের মতো সত্যের সাক্ষাৎ মেলে। সেখানে তিনি নিজেকে একটি বিশেষ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে নেবার সংকল্পে নৈতিক জীবনকে বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে একটা শুদ্ধ পদ্ধতিগত দৃষ্টি ছিল- যা জীবনকে সেই পথে এগিয়ে নেয়। উমর আমার জীবন বইয়েরই অন্য এক স্থানে লিখেছেন, ‘আমি জীবনে এই বিচার পদ্ধতির মধ্যে দিয়েই অগ্রসর হয়েছি। এ জন্য অন্যকে প্রশ্ন করার থেকে অনেক বেশি করে আমি পদে পদে নিজেকেই প্রশ্ন করে এসেছি। এ কারণেই হঠাৎ করে আমার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসেনি, এটা এসেছে ধীরে ধীরে।’

বদরুদ্দীন উমরকে কেবল একজন লেখকের মর্যাদায় দেখলে ভুল হবে। যদিও তিনি সেটি পালন করেছেন আজীবন। কারণ একজন লেখকের যে ভূমিকা, অতন্দ্রতা যার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য। উমর এক্ষেত্রেও অগ্রগণ্য মনীষী; কিন্তু তিনি যে এক অনন্য জীবনের দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে উপহার দিয়েছেন- সততায়, নিষ্ঠায়, সময়ের যথার্থ নিয়মানুবর্তিতায়, মানসিক পরিশ্রমের দৃষ্টান্তে, নির্ভীক সংগ্রামের সাধনায়, নৈতিক জীবনের লক্ষ্যে, তার তুলনা তিনি নিজে। আমাদের নৈতিক বিভ্রান্তিময় সমাজে যেখানে শিক্ষিত মানুষের পক্ষে কেবল বেঁচে থাকাটাই একটা সংগ্রাম, সেখানে উমর শুধু বেঁচে থাকেননি, আমাদের মধ্যে তিনি আজও বেছে আছেন, যথার্থ মানুষ হয়ে। তিনি আমাদের দুর্গত সামাজিক অবস্থার বশ্যতা স্বীকার করেননি, তাকে বশীভূত করতে চেয়েছেন। বলতে চেয়েছি, এটাই যথার্থ মানুষের লক্ষণ।

আমাদের চরম দুর্ভাগ্য, আমরা আমাদের জাতীয় জীবনের অপরিমেয় সংকট ও সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তির শিকার হয়ে বদরুদ্দীন উমরের এই মহৎ জীবনের কথা আমাদের কালের তরুণপ্রজন্মের সামনে তুলে ধরিনি। এই দৃষ্টান্তহীন পাপের স্খলন কোনো কালে হবে কি না, জানি না। তবে তিনি পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ পর্বে আমাদের সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি ও নৈরাজ্যের বিরুদ্ধে এবং সম্ভাবনাময় বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে যে ভূমিকা পালন করেছেন, তা মৃত্যুহীন। এক বিশেষ রাজনৈতিক অসততা ও তার চরম হিংসাত্মক মনোভাবের দরুন তার প্রতি আমাদের যে অবহেলা, উপেক্ষা, অবজ্ঞা ও অন্যায় পক্ষপাত প্রত্যক্ষ, তাও হবে ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।

জয়তু বদরুদ্দীন উমর!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক

কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //