ভারতের কৃষক আন্দোলন প্রসঙ্গে

এত দীর্ঘস্থায়ী কৃষক আন্দোলন এর আগে ভারতে তো বটেই বিশ্বের কোথাও হয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। লাখ লাখ কৃষক ট্রাক্টর ভর্তি করে রসদ আর মানুষ নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে অবস্থান করছেন দিনের পর দিন। 

দিল্লি অনেক দূর হলেও সমস্ত ধরনের কষ্ট, প্রতিকূলতা, পুলিশি আক্রমণ, লাঠিপেটা, জল কামান, মামলা, হামলা উপেক্ষা করে প্রয়োজনে ৬ মাস অবস্থান করার প্রস্তুতি নিয়ে কৃষকরা এসেছেন। তারা এসেছেন পাঞ্জাব, হরিয়ানাসহ ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে। গত ২৬ নভেম্বর থেকে তারা অবরোধ করে রেখেছেন দিল্লির প্রবেশ পথ। 

গত সেপ্টেম্বরে ভারতের কৃষিখাত সংস্কারের লক্ষ্যে তিনটি কৃষি আইন পাস হয়। মোদি সরকার বলছে, নতুন আইনের মাধ্যমের মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে কৃষক। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত কৃষকরা মনে করছেন নতুন এই আইনের ফলে তাদের লাভের চেয়ে ক্ষতি বেশি হবে। এই আইনের প্রয়োগ হলে করপোরেট হাউস এবং বড় প্রতিষ্ঠানগুলোই লাভবান হবে এমন আশঙ্কা থেকেই রাস্তায় নেমে এসেছেন তারা।

এর ফলে শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সবচেয়ে বড় কৃষক আন্দোলন। নভেম্বরের শেষ সপ্তাহে ভারতের উত্তরাঞ্চলের পাঞ্জাব ও হরিয়ানা প্রদেশের হাজার হাজার কৃষক জড়ো হয়েছেন রাজধানী দিল্লিতে। দিল্লিতে প্রবেশের আগেই শহরের সীমান্তে পুলিশি বাধার মুখে পড়েছিলেন তারা; কিন্তু তাদের থামানো যায়নি। লাখ লাখ কৃষক অবস্থান করে দিল্লির সাথে পাঞ্জাব ও হারিয়ানার সংযোগ সড়ক অচল করে রেখেছেন। 

  • (ভারতের কৃষিখাত সংস্কারের লক্ষ্যে তিনটি কৃষি আইন পাস হয়। মোদি সরকার বলছে, নতুন আইনের মাধ্যমের মধ্যসত্ত্বভোগীদের অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে কৃষক; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্নভাবে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক)

নতুন এ আইনে কৃষিপণ্য বিক্রি, গুদামজাতকরণ ও মূল্য নির্ধারণ নীতিতে পরিবর্তন এসেছে। নতুন আইনে ব্যবসায়ীদের পণ্য মজুদের অনুমতিও দেয়া হয়েছে। ফলে মহামারির সময় ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে পণ্য মজুদ করে লাভবান হবেন ব্যবসায়ীরাই। ইতিপূর্বে ভারতের কৃষি আইনে পণ্য মজুদ করা অপরাধ হিসেবে গণ্য হতো। 

নতুন আইনের ব্যাপারে কৃষকদের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো এ আইনের মাধ্যমে তাদের রক্ষাকবচ কেড়ে নেয়া হয়েছে। ভারতের মোট কৃষিজমির ৮৬ শতাংশই ক্ষুদ্র কৃষকদের। তাদের জমির পরিমাণ ২ হেক্টরেরও কম। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দরদাম করে ন্যায্য মূল্য পাবেন না তারা- এমনটাই আশঙ্কা তাদের। পাঞ্জাবের কৃষকদের প্রতিনিধি বলেছেন, ‘সরকার আমাদের বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে জিম্মি করে করুণার পাত্র বানিয়েছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে দরদাম করে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পাবে এ চিন্তা একেবারেই অমূলক।’ নতুন এ আইনের ফলে সমস্যা সমাধানে কৃষকরা সমঝোতা বোর্ড গঠনের দাবি জানাতে পারবেন মাত্র। এ আইনের কারণে সমস্যা নিয়ে আদালতে যাওয়ার সুযোগও থাকছে না।

এছাড়াও নতুন আইনের অধীনে কৃষকদের সাথে চুক্তির ক্ষেত্রে এমনকি লিখিত চুক্তিও বাধ্যতামূলক নয়। ফলে চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন হলেও আদালতে প্রমাণ করার সুযোগও থাকবে না। বড় প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্যবসা করার অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। সার ও বীজের মতো কৃষিপণ্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিক্রি করায় প্রতি বছর বর্ধিত দাম পরিশোধ করতে হয় কৃষকদের। ফলে ঋণ করা ছাড়া উপায় থাকে না। মহাজনদের ঋণের প্রায় ২৫ শতাংশ সুদ দিতে হয়। যার চাপ সহ্য করতে না পেরে ভারতে কৃষকদের একটা অংশ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। 

সম্প্রতি দেশটির ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর (এনসিআরবি) প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমন ভয়াবহ পরিসংখ্যান উঠে এসেছে। এনসিআরবির তথ্য মতে, ২০১৯ সালে ভারতে মোট ১০ হাজার ২৮১ জন কৃষক ও ৩২ হাজার ৫৬৩ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছেন। এ সংখ্যা পূর্ববর্তী বছরের চেয়ে ছয় শতাংশ বেশি। ২০১৮ সালে দেশটিতে ১০ হাজার ৩৫৭ জন কৃষক ও ৩০ হাজার ১৩২ জন দিনমজুর আত্মহত্যা করেছিলেন। ভারতের অপরাধ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, ২০ বছরে প্রায় ৩ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করেছে। কৃষিতে লোকসান, অনিশ্চয়তা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে অসহায় হয়ে পড়া, ঋণের বোঝা, মহাজনদের চাপ কৃষকদের আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দেয়। 

সবচেয়ে বেশি ক্ষোভ ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস (এমএসপি) নিয়ে। ভারতের কৃষি ব্যবস্থায় এমএসপি প্রথা চালু রয়েছে বহু দশক ধরে। পণ্য বিক্রিতে আর্থিক ক্ষতির হাত থেকে চাষিকে বাঁচিয়ে ন্যায্যমূল্য দিতে সরকার প্রতি বছর বিভিন্ন ফসলের এমএসপি ঠিক করে দেয়। এটাই ছিল ভারতের কৃষকের প্রধান সুরক্ষা। নির্ধারিত দামের নিচে সরকার ফসল কিনতে পারত না। ফলে এই ব্যবস্থা চাষির কাছে ছিল একটা বড় নিরাপত্তা। নতুন আইনে কিন্তু এই প্রথা বাধ্যতামূলক রাখা হয়নি। 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রী আন্দোলনের মুখে বলছেন যে, এমএসপি ছিল, আছে ও থাকবে; কিন্তু নতুন আইনে তার কোনো স্বীকৃতি রাখা হয়নি। কৃষক সংগঠন ও বিরোধীরা চাইছেন, এমএসপি প্রথাকে নতুন আইনের আওতায় এনে সবার জন্য বাধ্যতামূলক করতে, যাতে বেসরকারি দেশি ও বহুজাতিক সংস্থা কম দামে ফসল বিক্রিতে কৃষককে বাধ্য করাতে না পারে। 

মোদি সরকার ও বিরোধীরা তাই মুখোমুখি। মোদি যে সংস্কারকে ‘ঐতিহাসিক পদক্ষেপ’ বলেছেন, বিরোধীদের কাছে তা ‘গণতন্ত্রের কৃষ্ণপক্ষ’ ও ‘কৃষকদের মৃত্যু পরোয়ানা’। বিরোধীরা বলছে, স্বাধীন কৃষক হতে চলেছেন বেসরকারি পুঁজির হাতের পুতুল ও ক্রীতদাস। সরকার বলছে, এর ফলে কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়বে। মধ্যস্বত্বভোগী বা ফড়িয়াদের দৌরাত্ম্য দূর হবে। বিরোধীদের আশঙ্কা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না থাকায় কৃষকশোষণ শুরু হবে। 

আইনগুলো এভাবে জীবন-জীবিকাকে অনিশ্চিত অবস্থার দিকে ঠেলে দেবে দাবি করে ভারতের কৃষকরা আইনগুলো বাতিল, ফসল কিনতে সরকারের বাধ্যবাধকতা বহালসহ আরও বেশ কিছু দাবি নিয়ে দিল্লির উপকণ্ঠে; কিন্তু নীরব কান্না রাষ্ট্র ও সরকার শোনে না। তাই সংগঠিত প্রতিবাদের কোনো বিকল্প নেই।

-লেখক: কেন্দ্রীয় সদস্য, বাসদ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //