অটোপাসের দেশে কঠিন প্রশ্ন মানা যায়?

প্রশ্নপত্র কঠিন, তাই পরীক্ষার হলে ভাঙচুর। যারা এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন, তারা সবাই আইনজীবী হতে চান। পরীক্ষা দিতে এসেই যারা এ রকম নৈরাজ্য সৃষ্টি করলেন, আইনজীবী হওয়ার পরবর্তী ধাপগুলোয় তারা কী কী করবেন ও তাদের মধ্যে যারা সত্যি একদিন বার কাউন্সিলের সনদ পেয়ে আইনজীবী হয়ে যাবেন, তখন তারা কী করবেন- সেই প্রশ্ন আপাতত শিকেয় তুলে রাখা যাক। 

ঘটনাটি ঘটেছে গত শনিবার। এদিন আইনজীবী তালিকাভুক্তির লিখিত পরীক্ষা ছিল। রাজধানীর ৯টি কেন্দ্রে প্রায় ১৩ হাজার পরীক্ষার্থী অংশ নেন। কিন্তু প্রশ্নপত্র হাতে পাওয়ার পর ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন পরীক্ষার্থীরা। অনেকে পরীক্ষা বর্জন করে কেন্দ্র থেকে বের হয়ে যান। 

শিক্ষার্থীদের দাবি, এবারের প্রশ্নপত্র অনেক ‘কঠিন’ হয়েছে। তাছাড়া সিলেবাসের বাইরে থেকে প্রশ্ন এসেছে। এতে ১০ শতাংশ পরীক্ষার্থীও পাস করবেন কি-না, তা নিয়ে তাদের সন্দেহ।

করোনাভাইরাসের অজুহাতে এবার লিখিত পরীক্ষা না নিয়ে শুধু ভাইভার মাধ্যমে আইনজীবী সনদ দেয়ার দাবিতেও আন্দোলন হয়েছে। পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ, এই আন্দোলনের কারণে প্রশ্নপত্র ‘কঠিন’ করা হয়েছে। যে কারণে প্রশ্ন হাতে পাওয়ার পরই পরীক্ষার্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন ও ঢাকার মহানগর মহিলা কলেজ কেন্দ্রে, মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কলেজসহ বিভিন্ন স্থানে হৈ-হুল্লোড় শুরু হয়। এমনকি কোনো কোনো পরীক্ষাকেন্দ্রে ভাঙচুরও করা হয়। বিক্ষুব্ধ পরীক্ষার্থীরা অন্যদের খাতা ছিঁড়ে ফেলেন। 

তবে এ কাজ সব পরীক্ষার্থী করেননি। কারা পরীক্ষাকেন্দ্রে এ ধরনের ঘটনা ঘটান? ধারণা করা অযৌক্তিক নয় যে, যারা লিখিত পরীক্ষা ছাড়া শুধু ভাইভা নিয়ে বার কাউন্সিলের সনদ পাওয়া তথা আইনজীবী হওয়ার দাবিতে আন্দোলন করেছিলেন, তারাই মূলত ‘প্রশ্ন কঠিন’ অজুহাতে এই উচ্ছৃঙ্খলতা চালিয়েছেন। তাদের সাথে পরে হয়তো কিছু সাধারণ পরীক্ষার্থীও অংশ নিয়েছেন। বিশেষ করে যাদের পাস করার সম্ভাবনা কম। অর্থাৎ পরীক্ষা বাতিল হলে যাদের সুবিধা- তারা নিশ্চয়ই এই উচ্ছৃঙ্খলতায় সরাসরি অংশ না নিলেও সমর্থন দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে আইনজীবীদের সনদ পেতে নৈর্ব্যক্তিক, লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়। আবার ওই তিন ধাপের যেকোনো একটি পরীক্ষায় শিক্ষার্থীরা একবার উত্তীর্ণ হলে পরবর্তী পরীক্ষায় তারা দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো অংশগ্রহণের সুযোগ পান। তবে দ্বিতীয়বারেও অনুত্তীর্ণ হলে তাদের পুনরায় শুরু থেকেই পরীক্ষায় অংশ নিতে হয়।

সে অনুসারে, ২০১৭ সালের ৩৪ হাজার শিক্ষার্থীর মধ্য থেকে লিখিত পরীক্ষায় দ্বিতীয় ও শেষবারের মতো বাদপড়া তিন হাজার ৫৯০ জন শিক্ষার্থী ও ২০২০ সালে প্রায় ৭০ হাজার শিক্ষানবিশ আইনজীবীর মধ্যে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আট হাজার ৭৬৪ শিক্ষার্থীসহ মোট ১২ হাজার ৮৫৮ জন সনদপ্রত্যাশী এবার লিখিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করছেন।

এখানে প্রশ্ন কয়েকটি- প্রথমত, লিখিত পরীক্ষা ছাড়া শুধু ভাইভা নিয়ে কাউকে আইনজীবীর সনদ দেয়া কতটা যৌক্তিক বা নিরাপদ? দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার্থীদের অভিযোগ যদি সত্যিই হয়- বার কাউন্সিলের ইতিহাসে এমন বাজে প্রশ্ন অতীতে হয়নি- তাহলে এর পেছনে কী কারণ রয়েছে? 

অস্বীকার করার উপায় নেই, পরীক্ষা মানেই সেখানে একটি সিলেবাস থাকে। সব বইয়ের প্রতিটি পৃষ্ঠা মুখস্ত করে পরীক্ষার্থীরা কেন্দ্রে যান না। এটি সম্ভবও নয়। যে কারণে তাদের একটি সিলেবাসের মধ্যে থেকে পড়াশোনা করতে হয়। কেউ কেউ ঝুঁকি নিয়ে কম পড়াশোনা করেই কেন্দ্রে যান ও সেই কম পড়াশোনার মধ্য থেকে প্রশ্ন হলে তারা পরীক্ষায় ভালো নম্বর পান। অনেকে ঝুঁকি এড়াতে অনেক বেশি পড়েন। বিশেষ করে যারা পরীক্ষায় কোনো অসদুপায় অবলম্বন করতে চান না; কিন্তু তারপরও প্রশ্ন যদি নির্ধারিত বইয়ের বাইরে থেকে কিংবা একেবারেই সিলেবাসের বাইরে থেকে আসে, তাহলে পরীক্ষার্থীদের ক্ষুব্ধ হওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ আইনজীবী হওয়ার পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ জটিল ও সময়সাপেক্ষ। 

জীবনের একটি বড় সময় এই পড়ালেখা ও প্রক্রিয়ার ভেতরে চলে যায়। ফলে সবারই প্রত্যাশা থাকে লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া। লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে ভাইভার সময় রাজনৈতিক তদবির ও অনেকে মোটা অংকের ঘুষ দেয়ার সুযোগ পান। 

তৃতীয় প্রশ্ন হলো- প্রশ্ন যতই কঠিন হোক, পরীক্ষার্থীরা এভাবে হলের ভেতর ভাঙচুর করতে পারেন কি-না? ভাঙচুর করা ফৌজদারি অপরাধ। যারা সনদ পাওয়ার পরে আইনজীবী হবেন, তারাও বইপত্রে ফৌজদারি আইনের নানা ধারা পড়েছেন। সুতরাং তারা নিজেরাই যখন ফৌজদারি আইন ভঙ্গ করেন, তখন তারা সমাজ ও রাষ্ট্রে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় কী ভূমিকা রাখবেন?

অনেকে রসিকতা করে বলছেন, করোনাকালের অজুহাতে যখন শিক্ষার্থীদের অটো-প্রমোশন ও কেন্দ্রে লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই মূল্যায়নের ভিত্তিতে পাস করিয়ে দেওয়া হয়েছে, সেখানে আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হতে চাওয়াদের কী দোষ? আর আইনজীবী হওয়ার পর তারা যা করবেন, তাতে লিখিত পরীক্ষার প্রয়োজনই বা কী? 

নিজের সন্তানের অভিজ্ঞতা দিয়ে লেখাটি শেষ করি। আমার মেয়ে রাজধানীর একটি স্কুলে পড়ে। এবার নার্সারি থেকে কেজিতে উঠেছে। আগামী মাসের শুরুতে ভর্তি। অথচ গত প্রায় এক বছরে কোনো ক্লাস হয়নি। অনলাইনে ক্লাস হলেও শিশুদের এই অনলাইন ক্লাসে বসানো কঠিন। মূল্যায়ন পরীক্ষার খাতায় অভিভাবকরা বাসায় বসে পরীক্ষা নিয়েছেন; কিন্তু কতজন অভিভাবক এই পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে সৎ থেকেছেন বা থাকতে পেরেছেন- সে প্রশ্ন তোলাও অযৌক্তিক নয়।

যেহেতু করোনাভাইরাসের কারণে ক্লাস হয়নি ও শিশুরা অনলাইন ক্লাসেও নিয়মিত ছিল না, ফলে ধরেই নেয়া যায় যে, পুরো বছরে তাদের ওই অর্থে কোনো পড়াশোনা হয়নি। অর্থাৎ যে শিশুটি গত এক বছর নার্সারিতে ছিল, সে নার্সারির সব পড়াশোনা বুঝতেও পারেনি। অথচ মূল্যায়ন পরীক্ষার মাধ্যমে তাদের সবাইকে অটো-প্রমোশন দিয়ে কেজিতে উঠিয়ে দেয়া হলো। অথচ সে নার্সারির পড়া-লেখাটাই ঠিকমতো বোঝেনি। এই যে একটি ক্লাস পুরোপুরি না বুঝেই পরের ক্লাসে উঠে গেল, এই শূন্যতা তো তাকে বয়ে বেড়াতে হবে। 

কেজিতে কি সে নার্সারির পড়াশোনার শূন্যতা পূরণ করতে পারবে? আবার যে শিশুটির সৎভাবে পরীক্ষা নিলে হয়তো পাসই করত না, তারও জীবন থেকে একটি বছর যাতে নষ্ট না হয়, অর্থাৎ আগের ক্লাসেই যাতে আরো এক বছর থাকতে না হয়, সেজন্য অভিভাবকরা হয়তো সন্তানের পরীক্ষা নেয়ার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সৎ থাকেননি; কিন্তু শিশুটি যে পরবর্তী ক্লাসে উঠে আরো বেশি পড়াশোনার চাপে পড়ে যাবে ও সেই চাপ নেয়ার মতো মানসিক অবস্থা তার আছে কি-না, সেটি অভিভাবকদের কতজন ভেবেছেন?

আইনজীবী নিয়োগ পরীক্ষার বেলায়ও ওই একই কথা খাটে যে, লিখিত পরীক্ষা ছাড়াই যারা শুধু ভাইভার মাধ্যমে সনদ পেতে চান, ধরেই নেয়া যায় যে, তারা পড়াশোনাটা ঠিকমতো করেননি। এ জন্যই এখন করোনাভাইরাসের অজুহাতে বিনা কষ্টে সনদ পেয়ে গায়ে কালো কোট পরে আদালতের বারান্দায় হাঁটতে চান। পয়সা কামাতে চান; কিন্তু লিখিত পরীক্ষা না নিলে তাদের অবস্থাও তো ওই নার্সারির শিশুদের মতোই হবে। অর্থাৎ নার্সারির পড়াই শেষ করতে পারেনি; কিন্তু সে উঠে গেছে কেজিতে। 

অথচ একজন শিশুর এই উত্তীর্ণ হওয়া আর কাউকে অটোপাস করিয়ে আইনজীবী বানিয়ে দেয়া তো আর এক কথা নয়!

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //