ক্ষমতা, কারাগার আর নতুন বছরের প্রত্যাশা

গেল ২৭ ডিসেম্বর ’২০ কেরানীগঞ্জে নবনির্মিত ‘মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগার’ উদ্বোধনকালে ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ক্ষমতার চেয়ার এবং কারাগার খুব পাশাপাশি থাকে’। 

২০০৭ সালে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে নিজের গ্রেফতারের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘তখন সবার আগে আমাকেই গ্রেফতার করা হয়েছিল। কাজেই আমরা জানি যে, রাজনীতি করতে গেলে এটা করতেই হবে। সে জন্য আমরা কারাগারগুলোর উন্নতিও করে যাচ্ছি’ (দৈনিক সমকাল, ২৮ ডিসেম্বর ২০)।

প্রধানমন্ত্রীর এই উপলব্ধি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবে তার প্রধানমন্ত্রিত্বের টানা ১২ বছরের মাথায় নির্দিষ্টভাবে কোন পরিপ্রেক্ষিতে এই কথা বলেছেন সেটা একমাত্র তিনি বলতে পারবেন। ’৭৯/৮০ তে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় জিয়াউর রহমান সরকারের তৎকালীন সিনিয়র মন্ত্রী থাকাকালে মশিউর রহমান যাদু মিয়াও সরকারি-বেসরকারি সব রাজনীতিকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন- জেলখানাগুলোকে সংস্কার করে বাসযোগ্য করা দরকার। গণেশ উল্টে গেলে কাকে কখন জেলে যেতে হবে, তাতো ঠিক নেই। এই মিটিংয়ের পর অবশ্য তাকে আর জেলে যেতে হয়নি। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেছিলেন। 

সেনা মদদে ক্ষমতায় থাকা ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগে শেখ হাসিনা আর খালেদা জিয়াসহ আওয়ামী লীগ-বিএনপির শীর্ষ নেতাদের অনেককেই জেলে যেতে হয়েছিল। গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অতিউৎসাহ আর কারসাজিতে অনেক নেতাদের জবানবন্দির অডিও ফাঁস হওয়ায় নেতা-নেত্রীদের জন্য এক মারাত্মক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এসবের জেরে কারও কারও রাজনৈতিক জীবনও শেষ হয়ে যায়। তবে এদের অধিকাংশই আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হয়েছেন ও তারা আগের মতোই বাণী দিয়ে চলেছেন। ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দীনের সরকার তাদের কথিত ‘সংস্কার এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের সুযোগ পেলে শাসকশ্রেণির দলগুলোর প্রচলিত রাজনীতি ও পরিচিত রাজনীতিকদের পরিণতি কী হতো, সেটা রীতিমতো গবেষণার বিষয়। দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো সেই সুযোগ তাদের দেয়নি। 

২০০৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে রুজু করা আওয়ামী লীগ নেতাদের প্রায় সব মামলাই প্রত্যাহার বা খারিজ করা হয়; রয়ে যায় খালেদা জিয়াসহ বিএনপি নেতাদের অধিকাংশ মামলা। এরকম একটি মামলাতেই বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া এখনো সাজাভোগ করছেন। সেনা মদদের সরকারের আমলে দায়ের করা অধিকাংশ মামলারই ‘মেরিট’ বিচারের সুযোগ হয়নি। এ কারণে সরকারি দলের রাজনীতিকরা ধোয়া তুলসীপাতা হয়েই আছেন এবং প্রতিনিয়ত জনগণকে সুনীতির ছবক দিয়ে যাচ্ছেন; দুর্নীতির বিরুদ্ধেও হুংকার দিয়ে চলেছেন। আর কয়েক লাখ মামলা নিয়ে বিএনপিসহ বিরোধী রাজনীতিক, সাংবাদিক ও নাগরিক সমাজের অনেকেই চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিন পার করছেন। এই হাজার হাজার মামলার অধিকাংশই যে রাজনৈতিক বিরোধীদের হয়রানির উদ্দেশ্যে করা হয়েছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই।

বস্তুত রাজনৈতিক বিরোধীদের নিয়ন্ত্রণ ও দমনের উদ্দেশ্যেই হয়রানিমূলক মামলা-মোকদ্দমাকেই বড় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। আত্মগোপন আর কোর্টের বারান্দায় দৌড়াদৌড়ি করতেই অসংখ্য বিরোধী রাজনীতিক আর কর্মী-সংগঠকদের নাভিশ্বাস ওঠার মতো পরিস্থিতি বিরাজমান। জেলখানাগুলো কয়েদিদের চাপে উপচে পড়ছে। পুলিশের গ্রেফতার বাণিজ্যেরও রমরমা পরিস্থিতি। হয়রানিমূলক মামলার অর্থ একটি পরিবারের প্রায় সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়া। সম্ভবত এসব কারণে কেউই আর বিরোধী দলে থাকতে চায় না। কারণ বিরোধী দলে থাকাটা বাংলাদেশে এখন প্রবল ঝুঁকিপূর্ণ। তাতে জান-মালও গুরুতর হুমকির মধ্যে পড়ে। প্রকৃত বিরোধী হয়ে থাকা এখন খানিকটা নরকবাসের মতো; আর সন্দেহ নেই ক্ষমতায় থাকা এখানে অনেকখানি স্বর্গবাসের মতো। ক্ষমতার মূলকেন্দ্রে জায়গা না হলে ক্ষমতার গলি ঘুপচিতে থাকলেও বিরাট প্রাপ্তি; ক্ষমতার বারান্দা আর উঠানের আশপাশে থাকলেও অনেক লাভালাভ। যে কোনো মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার প্রধান প্রণোদনা বোধ করি এটিই। 

ইতিহাসের বড় শিক্ষা নাকি এটিই যে, ইতিহাস থেকে কেউই শিক্ষা নেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্ষমতাসীনরা এটি ভুলে যান যে, তাদেরও একদিন কোনো না কোনো সময়ে বিরোধী শিবিরে যেতে হবে। বিরোধীদের জন্য প্রতিনিয়ত যে নরকযন্ত্রণা তারা তৈরি করছেন, এক সময় তাদেরও এই যন্ত্রণা ভোগ করতে হতে পারে। এটা মনে রাখলে বিরোধী দলে থাকলে তারা সরকারের কাছে যে সহিষ্ণু ও গণতান্ত্রিক আচরণ আশা করেন এখন বিরোধী দলগুলোর প্রতিও তারা একই আচরণ করতেন; কিন্তু আমাদের এখানে বিরোধীদের রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার পরিবর্তে পরষ্পরকে নিঃশেষ করার রাজনৈতিক চর্চা চলে আসছে; দমন করে শাসন করাকেই প্রধান নিয়ামক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এ কারণে ভোটের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়াটা ক্ষমতায় থাকার নিদানে পরিণত হয়েছে। এক ধরনের কবরের শান্তি আর নির্জনতা তৈরির প্রচেষ্টা চলছে। এই পরিস্থিতি ভয়ংকর উদ্বেগজনক; এটা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতার পরিপন্থী।

এ কারণে সরকারি দলের নীতিনির্ধারকরাও স্বস্তিতে নেই। কিছু হলেই তারা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের আলামত খোঁজেন। সমস্যা হচ্ছে বিদ্যমান প্রায় অবরুদ্ধ অবস্থা চলতে দিলে, নিয়মতান্ত্রিক গণতান্ত্রিক পথে সরকার পরির্তনের সুযোগ বন্ধ থাকলে অনাকাক্ষিত চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের আশঙ্কাই বাড়ে; জমিন প্রশস্ত হয় চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিবাদী উত্থানের। এই ধরনের আলামততো স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের উদ্বিগ্ন হয়ে এখন দেশবাসীকে এ ব্যাপারে সতর্কবাণী দিতেও দেখা যাচ্ছে।

দেশের সচেতন ও সংবেদনশীল কারোরই এ ধরনের আধা নৈরাজ্যিক, অস্থিতিশীল ও অনিশ্চিত পরিস্থিতি কাম্য নয়। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি যে বক্তব্য রেখেছেন, মানুষ বিশ্বাস করতে চায় যে, সেটা তার ও তার সরকারের আন্তরিক উপলব্ধি। তাই যদি হয়, তাহলে সরকারকে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির পথে হাঁটতে হবে। জনগণের ভোটের অধিকারসহ গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে; বিরোধী রাজনীতিকে বলপ্রয়োগে দমন ও নিঃশেষ করার কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। সরকারি দল যে গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করেন বিরোধী দল ও জনগণের জন্য তা নিশ্চিত করতে হবে। তারা যে শান্তিপূর্ণ নিয়মতান্ত্রিক পথে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ অবারিত করতে চান, তার বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ রাখতে হবে; ধসে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পুনর্গঠিত করতে হবে; বিরোধী দল ও জনগণকে আস্থায় নিয়ে সংকট উত্তরণে রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে হবে। 

করোনা দুর্যোগে সরকার ও সরকারি দল এই পথে হাঁটলে মহামারি দুর্যোগের পাশাপাশি রাজনৈতিক দুর্যোগ থেকে উত্তরণের পথও নিশ্চয়ই খুঁজে পাওয়া যাবে। নতুন বছরের প্রাক্কালে এটাই প্রত্যাশা।

সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //