নেপাল সংকটের ভবিষ্যত কি?

নেপাল আবার দেশি-বিদেশি সংবাদের শিরোনাম হয়েছে। তত্ত্বগতভাবে না, ব্যবহারিক ও বাস্তব রাজনীতি ও সংবিধানিক জটিলতা- এসবই এখন নেপালের বর্তমান রাজনৈতিক সংকটের মূল কারণ।

সারকথায় বললে, নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি অলি অসময়ে (পাঁচ বছরের সরকারের প্রায় এক বছর আগেই) সংসদ ভেঙে দেয়ার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করেছেন আর নেপালি প্রেসিডেন্ট গত ২০ ডিসেম্বর তা তৎক্ষণাৎ কোনো এক্সপার্ট অপিনিয়নের বোঝাবুঝিতে না গিয়ে সরাসরি বাস্তবায়ন করে ফেলেছেন। আগামী এপ্রিল-মে মাসে নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। অবস্থা এখন এমনই যে, নেপালের কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা ব্যক্তি বা কনস্টিটিউশনাল-প্রফেশনাল কেউই বাদ নেই যে অলি বা প্রেসিডেন্টের এই সিদ্ধান্তকে বেআইনি বলেননি। এমনকি চীন বা ভারতসহ কোনো বিদেশি সরকারও নেই যে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। 

নেপাল মানেই ছিল এক রাজতন্ত্রী রাষ্ট্র; এমন এক পরিচয় পেরিয়ে এ কালের রিপাবলিক নেপাল হয়ে পুনঃজন্ম রাষ্ট্র হওয়া, সে ছিল এক লম্বা রাস্তা ও সফর। রাজতন্ত্র ভাঙবার এই নতুন রাজনীতি নেপালে মাওবাদীদের হাতে শুরু হয়েছিল ১৯৯৬ সালে। যা বহু চড়াই উৎরাই, সশস্ত্র সংগ্রাম আর সব শেষে সর্বদলীয় গণ-আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান শেষে রাজাকে উৎখাত করতে পেরেছিল। আর তা হয়েছিল ২০০৮ সালের ২৮ মে। এরপর পুরনো সেই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা থেকে একটা নতুন সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র রূপান্তর ঘটিয়ে একটা নতুন সংবিধান রচনা খুব সহজ কাজ ছিল না। যার মূল সমস্যা ছিল আগের প্রায় দেড়শ’ বছরের পুরা রাজতান্ত্রিক আমলজুড়ে। 

নেপাল ছিল ভারত-নির্ভর এক দেশ- যা নেপাল-ভারতের ১৯৫০ সালের কলোনি-চুক্তিতে প্রতিফলিত হতো। তাই নতুন সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র নেপালের ওপর ভারতের প্রভাব-অবস্থান আর থাকছে না এটা বুঝতে পেরে ভারত হয়ে যায় সাংবিধানিক নেপালে ঘোষণার ক্ষেত্রে প্রধান ও প্রবল বাধা। তাতে প্রথম কনস্টিটিউশন এসেম্বলি (২০০৯-১২) লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই ব্যর্থ ও বাতিল হয়ে যায়। পরে বহু কাঠখড় পেরিয়ে দ্বিতীয় কনস্টিটিউশন এসেম্বলি (২০১৩-২০১৬) গঠনের পরে প্রধান তিন রাজনৈতিক দলের যৌথ পরিকল্পনা ও তাদের পারস্পরিক ও জনগণের প্রতি দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কারণে ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরের ২০ তারিখে এক সাংবিধানিক প্রজাতন্ত্র হিসাবে নতুন নেপাল রাষ্ট্রের ঘোষণা ও সূচনা হয়েছিল। তবুও ভারতের আপত্তি ও বাধা শেষ হয়নি।

ল্যান্ড-লকড নেপালকে বাইরের কোনো দেশ ও ভারত থেকে কোনো কিছু আমদানি করতে দেয়নি, সবকিছু অবরোধ করে রেখেছিল টানা প্রায় ছয় মাস। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ভারতের রান্নার সিলিন্ডার গ্যাসসহ সবকিছুরই সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল। আর এই বিরূপ সময়েই এই প্রথম চীন অর্থনৈতিকভাবে নেপালের পাশে এসে দাঁড়ায়। এ কারণে পরবর্তীকালে নেপালিদের ভারতের ভেতর দিয়ে পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে যাওয়ার চেয়ে চীনের ভেতর দিয়ে বাইরের দুনিয়ায় বের হবার পথ খুলে যায়। ফলে ভারতের সব সিদ্ধান্ত যে তার নিজেরই বিরুদ্ধে চলে যাবার জন্য যে সে নিজেই দায়ী তা স্পষ্ট হয়ে যায়- যা দেখে ভারতের নিজের হাত-কামড়ানো আফসোস ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না। 

এভাবে গত ২০১৭ সালে প্রথম নতুন সংবিধান অনুসারে নেপালে ২৭৫ আসনের ফেডারল বা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নেপাল এখন সাত প্রদেশে (যেখানে প্রাদেশিক সরকারও আছে) বিভক্ত ও কেন্দ্রে এক ফেডারেল সরকার। মনে করা হয়েছিল এবার নেপাল নিশ্চয় ক্রমেই একটা স্থিতিশীল রাষ্ট্র হবার পথে এগোতে পারবে; কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না! পথ এখনো অনেক বাকি। কেন? এভাবে মোট ২২ (১৯৯৬-২০১৭) বছর ধরে যে নেপাল রাষ্ট্রটি এতদিন ধরে তৈরি হলো, আজন্ম কিছু দুর্বলতাও থেকে গিয়েছে। প্রথমত, নতুন নেপাল রাষ্ট্রের মূল শক্তি জনগণ শুরু থেকেই প্রধান তিন রাজনৈতিক দলে বিভক্ত ছিল। মাওবাদী কমিউনিস্ট, অলির কমিউনিস্ট আর নেপালি কংগ্রেস এই প্রধান তিন দলে। তিন দলের কেউই এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ভোটে এ পর্যন্ত কখনো ক্ষমতায় আসতে পারেনি। বরং যে কোনো দুটি দল একপক্ষে গেলে তবেই তা সম্ভব হয়েছে। 

দ্বিতীয়ত, এটাই মাওবাদী দলের প্রধান দুর্বলতা। অথচ গত ২২ বছরে নেপালের সব প্রধান পরিবর্তনে প্রধান উদ্যোক্তা ও অগ্রগামী ছিল এ মাওবাদী দল। যেখানে বাকি সব দলের ইতিহাস বলে, রাজার অনুগ্রহ লাভ ছিল তাদের প্রধান তৎপরতা। কারণ সেই শর্তেই রাজা কেবল তাদের মন্ত্রিসভায় বসাতেন। ফলে দলের কাঠামো ও গড়ন হিসাবে মাওবাদী দল এবং এর মূল নেতা পুস্প কমল দাহাল অন্যান্য সব দলের চেয়ে একেবারেই আলাদা; কিন্তু অন্যান্য দলের কাছে মাওবাদী দলের সীমাবদ্ধতাগুলো হলো- পাবলিক ম্যানেজমেন্ট, পপুলার চেহারায় দল হাজির রাখার কায়দা না জানা।

এক কথায় বললে, সঠিক সিদ্ধান্ত ও সঠিক পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষেত্রে গত ২২ বছর ধরে মাওবাদী দল ছিল চ্যাম্পিয়ন। প্রতিটি ক্রাইসিসে সে ছিল সবাইকে নিয়ে তা মোকাবেলার নায়ক; কিন্তু তা থেকে নিজেদের সবচেয়ে পপুলার দল হিসেবে হাজির করা কেন সম্ভব হলো না? অর্থাৎ নিজের দলকে সবার চেয়ে পপুলার কীভাবে রাখতে হয় এই প্রশ্নে মাওবাদী দল ঘাটতিতে আছে। গত ২০১৫ সালে ভারতের ওপর দিয়ে নেপালে সবকিছু আমদানি নিষিদ্ধ করে অবরোধের মধ্যে রাখার সময় সারা নেপাল বিশেষ করে গরিব খেটে খাওয়া মানুষরা হয়ে উঠেছিল সবচেয়ে ভারতবিরোধী। 

আর এ থেকে ভারতবিরোধী গণক্ষোভকে নেতৃত্ব দেয়া প্রধান ও পপুলার দল হয়ে উঠেছিল ওলির কমিউনিস্ট পার্টি। অথচ সবচেয়ে প্রবল ওই ক্রাইসিসের সময়ে সমস্ত সংকটে একমাত্র ট্রাবল শুটার ছিল মাওবাদী নেতা দাহাল। যেমন, সংবিধান রচনা শেষে (২০১৫) ঘোষণা দেওয়া যখন হয়েছিল, তখন সাত প্রদেশের সীমানা বা কোন এলাকা কোন প্রদেশের ভাগে থাকবে এসব কিছুতেই সবাইকে একমত করা যাচ্ছিল না, মূলত মাধোসি নৃ-গোষ্ঠীর জন্য; যাদের অপর অংশ সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের উত্তর প্রদেশ বা বিহারে বসবাস করে। আর ভারত তাদের কব্জা করে নেপালে প্রদেশ গঠন সংক্রান্ত সব তর্ক-বিবাদ যেন কোনোভাবেই সমাধান না হয়ে যায়, সে চেষ্টা জারি রেখেছিল। অথচ পরের এক বছরের মধ্যে এই মাধোসি জনগোষ্ঠীকে নিজ দল ও কোয়ালিশন সরকারের সাথে আস্থায় এনে একটি আপোষরফায় নিয়ে আসার মূল কারিগর ছিলেন এই দাহাল। 

সারকথায় পপুলার দলের ইমেজ খাড়া করার ব্যাপারে মাওবাদী দাহাল সবসময় অলির দলের সামনে থেকেছে। আবার নেপালের সাথে চীনের দরকষাকষির (২০১৫ সালের পরে) ঠিক কী হবে, যাতে বাইরের দুনিয়ার সাথে নেপালের নিজের স্বাধীন সম্পর্কের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা খর্ব করে দেয়া যায়- এ বিষয়ের মূল কারিগর ছিলেন দাহাল। আর পরে তা পপুলার প্রধানমন্ত্রী অলির সাথে চীনের সম্পর্ক হয়ে দাঁড়ায়।

পরবর্তীতে এই সম্পর্ক থেকেই ২০১৭ সালে নেপালের সাধারণ নির্বাচনে অলি আর দাহালের দুই কমিউনিস্ট পার্টি একদল হয়ে লড়ুক এই প্রস্তাব দিয়েছিল চীন। এটা অবশ্যই সফলতা এনে দিয়েছিল। দুই দল মিলে নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন দখল করেছিল। আবার এই সিদ্ধান্তের মধ্যে সুবিধাবাদিতাও ছিল, যার খেসারত দিচ্ছে এই দুই দলের এখনকার মিলিত দল । 

অলি এমন এক ব্যক্তিত্ব যিনি সবসময় নিজেই সর্বেসর্বা প্রধান আর তার একক সিদ্ধান্তের অধীনেই সবাইকে চলতে হবে- এভাবে তিনি চলতে পছন্দ করেন। সব ডিসিপ্লিন তার একক ইচ্ছামতোই হতে হবে। তাই এখন তাদের মিলিত দলের অবস্থা হলো, অলি একাই একপক্ষে আর অলির বিরুদ্ধ পক্ষের সবার মূল নেতা হলেন দাহাল- এই হলো ভাগাভাগির বিষয়। তাই মিলিত দলের প্রস্তাব হিসাবে অলিকে যখন দলের যৌথ সভাপতির (অলি-দাহাল দু’জনের কো-চেয়ারম্যানের দল ছিল সেটা) পদ থেকে গত ২২ ডিসেম্বর অপসারণ করা হয়, এই দিনই অলি সংসদ ভেঙে দেয়ার সুপারিশ নিয়ে প্রেসিডেন্টের কাছে যান। কারণ তিনি বুঝেছিলেন এরপর মিলিত দল তাকে প্রধানমন্ত্রী থেকেও অপসারণের প্রস্তাব পাস করবে। তাই সংসদ আগাম ভেঙে দিয়ে তিনি আগামী মে মাস পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী থাকার ব্যবস্থা করে নিলেন। কাজেই অলি সম্পর্কে চীনের পর্যবেক্ষণ যে মারাত্মক ভুল তাই প্রমাণিত হতে দেখা যাচ্ছে; কারণ গত এক বছরে অলিকে সরানো যায়নি চীনের পরামর্শেই।

আবার অলি বুঝতে পেরেছিলেন দল তাকে অপসারণ করবে। তাই সেই ভারতের সাথেই খাতির জমাতে তিনি গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর প্রধান গোয়েলকেই প্রকাশ্যে নেপাল সফরের আমন্ত্রণ করে এনেছিলেন। গত দু’মাসে এরপর ভারতের সেনাপ্রধান, শ্রীংলা বা বিপিন রাওয়াত নিয়মিত নেপাল সফর করেছেন। ভারতও খুশি ছিল যে, নেপালে আবার তাদের নাক গলানোর সুযোগ এসে গেছে; কিন্তু হায়! সংসদ ভেঙে দেওয়ার পরে অলিই উলটা নেপালে একঘরে হয়ে যায়; সমাজের কেউই তাকে সমর্থন করেনি। এমনকি প্রো-ইন্ডিয়ান নেপালি কংগ্রেসও (সব ফ্রাকশন) অলির বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে। এতে সব আশায় ঠান্ডা পানি ছিটিয়ে পড়ায় ভারত একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে গেছে।

ওদিকে দাহালের নেতৃত্বে অপরপক্ষ এখনও যদি অলিকে অন্তর্বর্তী-প্রধানমন্ত্রী পদ থেকেও অপসারণ করতে না পারে, তবে সে পর্যন্ত নেপালের রাজনীতি পথহারা এক সংকট হয়েই থাকবে!

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //