এলাকাভিত্তিক শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা সময়ের দাবি

সম্প্রতি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রুরাল রিকনস্ট্রাকশন ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ‘ক্ষুদ্র মোটরগাড়ি শিল্পের উন্নয়ন’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভায় যশোরে অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল স্থাপনের দাবি উঠেছে। 

সভায় প্রধান অতিথি জেলা প্রশাসক বলেছেন যে, ‘সম্ভাবনাময় এই শিল্পের উন্নয়নে সরকার আন্তরিক। সরকারিভাবে অটোমোবাইল শিল্পপার্ক স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই শিল্পকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে শিল্প মন্ত্রণালয়।’ 

এলাকাভিত্তিক ঐতিহ্য ও প্রান্তিক মানুষের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় শিল্পপার্ক স্থাপন একটি সাধু উদ্যোগ। 

দেশের বৃহৎ শিল্পগুলো লোকসানের বোঝা মাথায় নিয়ে এক এক করে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সরকারি শিল্প কারখানাগুলো লোকসানের অজুহাতে বন্ধ করে দিয়ে বেসরকারীকরণের সব উদ্যোগ স্বমহিমায় চলমান। লোকসানের কারণ অনুসন্ধান না করেই বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক শিল্পগুলো, অথচ এগুলোকে লাভজনক করার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না। সরকারি লোকসানের পাশাপাশি রাজস্ব আয়ের হিসাব করা গেলে, মানুষের সংকটপূর্ণ জীবনের হিসাব করা হলে ভালো কিছু ভাবার সুযোগ সৃষ্টি হতো। 

নগদে বিশ্বাসী শাসক শ্রেণির এত ভাবার সময় কোথায়? সামনে যা কিছু পাওয়া যায় তাই নিয়েই তারা বিচার শেষ করে ফেলে। পিছনের দিতে তাকাতেই চায় না। একটা বৃহৎ শিল্প কত টাকার পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস-টেলিফোনে রাজস্ব দিয়েছে, আমদানি করা থেকে কত টাকার বৈদেশিক অর্থ বাঁচিয়েছে, কৃষিতে কতটা অবদান রেখেছে- এসব হিসাবের পেছনে না তাকালে কিছু বোঝা যাবে না। এমন বেহিসাবি পথে ইস্পাত কারখানা, নিউজপ্রিন্ট, রাসায়নিক কারখানা, পাটকল. চিনিকল ইত্যাদি হেঁটেছে। বিপরীতে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ জোন গড়ে তোলা হয়েছে। 

আমাদের দেশের বৃহৎ শিল্পগুলোর লোকসানের চিহ্নিত কারণগুলোর পাশাপাশি ব্যর্থতার অন্যতম প্রধান কারণ ফিডার শিল্প কারখানা গড়ে না তোলা। প্রতিটি বৃহৎ শিল্পের জন্য ফিডার শিল্প কারখানা খুব জরুরি। বেসরকারি উদ্যোগে কিছু কিছু ফিডার কারখানা গড়ে উঠলেও তা খুব একটা পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। ফিডার কারখানাকে কেন্দ্র করে মানুষের কাজের ক্ষেত্র বাড়ত, বৈদেশিক নির্ভরতা কমতো। 

মানুষ নিজের প্রয়োজনে, বেঁচে থাকার গরজে, উন্নত, নিরাপদ, আরামদায়ক জীবনের জন্য হাতিয়ার তৈরি করেছে। আদিকাল থেকে মানুষ হিংস্র পশুর কবল থেকে আত্মরক্ষার জন্য, বন জঙ্গল থেকে খাদ্য সংগ্রহের জন্য, জীবনমান উন্নয়নের জন্য নিজের মেধা ও শ্রম ব্যবহার করে বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশের সহযোগিতায় মানুষ তার উন্নয়নশীল হবার প্রক্রিয়াটি আজও সক্রিয়ভাবে ক্রিয়াশীল রেখেছে। প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল অবস্থা থেকে আজকের সভ্যতায় হাতিয়ারের আকৃতি, গঠন, নির্মাণ ও ব্যবহারের ভিন্নতা সময়ে সময়ে বিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়েছে মাত্র। মানুষ ব্যবহার করতে শিখেছে পাথর, ব্রোঞ্জ, তামা, লোহা প্রভৃতি। 

সময়ের সাথে সাথে মানুষ একটার পর একটা উদ্ভাবন আর আবিষ্কারের মাধ্যমে গড়ে তুলেছে সভ্যতা। মানুষ লেখাপড়া শেখার ব্যবস্থা করেছে, কৃষি কাজ শিখেছে, যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের পথ করে পারস্পরিক আদান প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করেছে, স্থায়ী বসতি তৈরি করেছে, সমাজ গড়ে তুলেছে। মানুষ তার আয়েসি জীবনের দিকে ছুটে গিয়ে প্রযুক্তির জ্ঞান আয়ত্ত করেছে- যা তাদের জীবনকে ক্রমান্বয়ে সহজ করে দিয়েছে। 

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের ধারাবাহিকতায় উৎপাদন, নির্মাণের উপরে ব্যক্তির নিয়ন্ত্রণ ও পছন্দের অগ্রাধিকার ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। দিনে দিনে মানুষ তার দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা মতো নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছে। নানারকম যান্ত্রিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নির্মাণকে সহজতর করেছে। উন্নতি ও অগ্রগতির জন্য মানুষ এই যে নিরন্তর প্রচেষ্টায় নিবেদিত, সেখানে প্রয়োজন আধুনিকতা, প্রয়োজন পৃষ্ঠপোষকতা। আর্থ-সামাজিক অবস্থার কারণে শ্রমজীবী মানুষ তার পূর্বপুরুষদের রেখে যাওয়া জ্ঞানকে আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে সমন্বয় করে নতুনের আবির্ভাব ঘটাতে পারছে না। স্বাভাবিক কারণেই তারা ব্যক্তি, পরিবার, এলাকার বাইরে উৎপাদন ও নির্মাণকে নিতে চায় না। এমনকি দেশে এমনো দেখা যায় বিশেষ কোনো উৎপাদন ও নির্মাণ কাজ শেখানো থেকে নারীদের বিরত রাখা হয়। যাতে করে বিয়ের পর এ বিশেষ জ্ঞান সে অন্য কাউকে শেখাতে বা অন্য কোনোখানে ব্যবহার না করতে পারে; কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্মাণের পর শ্রমিকদের মেরে ফেলা, হাত কেটে নেয়া, অন্ধ করে দেয়ার সময় শেষ। সমগ্র পৃথিবী পরিণত হচ্ছে একটা বৈশ্বিক গ্রামে, জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি আকাশ ছোঁয়া হচ্ছে চাহিদা- সেখানে মানুষের পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া জরুরি। এ জন্য প্রয়োজন শিল্পাঞ্চল বা পল্লী গড়ে তোলা। প্রয়োজন পরস্পরের প্রতি পরস্পরের সৌহার্দ্য। 

আমাদের দেশে কুটির শিল্প বিকাশে বিসিক নগরী প্রতিষ্ঠা করা হলেও তার সাফল্য প্রশ্ন সাপেক্ষ। প্রকৃতদের আর্থিক অবস্থা ও ক্ষমতার জোরের কাছে পরাজিত হওয়াটা এখন স্বাভাবিক নিয়মে দাঁড়িয়ে গিয়েছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা একটা বলয়ের মধ্যে ঘুরপাক খায়। তাই বণ্টন ব্যবস্থায় নজরদারি নির্দিষ্ট করা প্রয়োজন। সরকার সদিচ্ছা নিয়ে শিল্পাঞ্চল বা পল্লী প্রতিষ্ঠা করলেই হবে না, তার জন্য নীতিমালা প্রণয়ন করে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করতে হবে।

এলাকাভিত্তিক ঐতিহ্য বিবেচনায় ছোট ছোট শিল্পাঞ্চল বা পল্লী প্রতিষ্ঠা করে তার পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে আমাদের অনেক ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। ঐতিহ্য রক্ষার পাশাপাশি মানুষকে কর্মমুখী করতে পৃষ্ঠপোষকতা বিশাল ভূমিকা রাখবে। সামাজিক সুরক্ষা বলয়ের ৫০০ টাকা বর্তমান বাজারে বেঁচে থাকার রসদ নিশ্চিত করে না। অক্ষম বাদে ব্যক্তির সক্ষমতা অনুয়ায়ী কর্মের ব্যবস্থা করা গেলেই জীবন রক্ষার রসদ সংগ্রহ হতে পারে। ছোট ছোট শিল্পাঞ্চল বা পল্লী এবং তাদের ফিডার গড়ে তোলা হলে বিশাল এক কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হতে পারে। 

দেশে অটোমোবাইল শিল্পকে ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। নিজেদের দক্ষতা, মেধা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে গড়ে ওঠা এ কারখানাগুলো দেশব্যাপী সমাদৃত। সরকারি নীতিকৌশলে দেশের পরিবহন ব্যবস্থায় সড়ক সবচেয়ে গুরুত্ব পাওয়ায় এই শিল্প কারখানার প্রয়োজনীয়তাও দিনে দিনে বেড়ে চলেছে; কিন্তু এর প্রসার ঘটে চলেছে অপরিকল্পিতভাবে। যশোরের খেজুরের গুড়, পোড়াবাড়ীর চমচম ইত্যাদি সারাদেশে তৈরি হলেও আদিকালের ঐতিহ্য মানুষ ভুলে যায়নি।

তাই দেশের ঐতিহ্য বিবেচনা করেই শিল্পাঞ্চল বা পল্লী প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ প্রয়োজন। রফতানি প্রক্রিয়াকরণ জোন দিয়ে আমাদের ঐতিহ্য রক্ষা হবে না। সাধু দাবি হিসেবে অটোমোবাইল শিল্পাঞ্চল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ কামনা করি।

-লেখক: সাবেক সভাপতি, ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //