ইউজিন ডেবসের বয়ানে যীশু ও ধর্ম

কার্ল মার্ক্সের একটি উক্তি ধর্ম সম্পর্কে বিশ্বব্যাপী বিরাট বিতর্ক তৈরি করেছে, এর ব্যাখ্যা হয়েছে হরেক রকম। সাম্যবাদীরাও পড়েছেন নানারকম ফাঁদে এবং হয়েছেন ক্ষতিকারক বিতর্কের শিকার। আন্দোলন-সংগ্রাম থেকে দূরে বাসবাসকারী বামপন্থী তর্কবাজরা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন, সেয়ানারা সুযোগ গ্রহণ করেছে এসবের। আবার অনেক প্রগতিশীল নেতা জনগণের সঙ্গে থাকার অজুহাত দিয়ে নানারকম কুসংস্কারকেও প্রশ্রয় দিয়েছেন। তারা যে ধর্মের বিরুদ্ধে নয় সেটি বোঝাতে যেসব আচরণ করছেন জনগণের অনেকের কাছে তা ভান মনে হয়েছে।

তারা মনে করেছে কমিউনিস্টরা যতই ধার্মিক ভাব করুক না কেন তলে তলে তারা ঠিকই ধর্মবিরোধী। ফল যা হয়েছে তা হলো প্রত্যেক ধর্মের মাঝে বিশেষ করে ধর্ম-প্রবর্তকদের যে বৈষম্য-বিরোধী সংগ্রাম ও সাম্যবাদী চেতনার বৈশিষ্ট্য তাকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম করা যায়নি, বরং ভেদ তৈরি হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ধর্মীয় আদর্শ-চেতনা ও কমিউনিস্টদের সংগ্রাম ইতিহাসে বহুবারই হাত ধরাধরি করে চলেছে, যদিও তা স্থায়ী হয়নি।

ধর্মীয় ও প্রগতিশীল চেতনার মাঝে সাপে-নেউলে সম্পর্ক থাকার কোনো কারণ নেই। সম্পূর্ণ সাপে-নেউলে সম্পর্কটি কেবলমাত্র শ্রমজীবী জনগণ ও পুঁজিপতি-ভূস্বামী-সাম্রাজ্যবাদীদের মাঝে। এই সংগ্রামে জনগণের প্রগতিশীল ধর্মীয় চেতনা ও সাম্যবাদী সংগ্রামের মাঝে সৌহার্দ্য আবশ্যক। তবে অবশ্যই শাসকশোষক গোষ্ঠী ও সুবিধাভোগী-সুযোগসন্ধানীরা ধর্মকে যেভাবে ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত ও বৃহৎ শ্রেণিস্বার্থে ব্যবহার করে তার সঙ্গে প্রগতিশীলদের আপোষের ন্যূনতম সুযোগ নেই। সেজন্য প্রয়োজন ধর্মের মানবতাবাদী, সমাজবাদী, সাম্যবাদী ও নিপীড়ন-নির্যাতনবিরোধী ভূমিকাকে জনগণের সামনে নিয়ে আসা। বাংলাদেশে আমাদের এমন শিক্ষা আছে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জীবনে ও সাহিত্যে, আবার আমাদের ‘লাল মাওলানা’ বলে খ্যাত ভাসানীর সংগ্রামী ঐতিহ্যেও। ধর্মের প্রকৃত শোষণবিরোধী ও প্রতিবাদী ব্যাখ্যায় না গিয়ে ধর্মকে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রতিক্রিয়াশীলদের হাতে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। অথচ ধর্ম-প্রবর্তকদের জীবনের সংগ্রামী ঐতিহ্যকে প্রগতিশীল ব্যাখ্যায় আলোকিত করা প্রয়োজন ছিলো। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতান্ত্রিক নেতা ইউজিন ডেবসের সংগ্রামী জীবনে ও লেখালেখিতে এর চমৎকার প্রতিফলন আছে।  

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রগতিশীল নেতা বার্নি স্যান্ডার্সের রাজনৈতিক আদর্শের গুরু ডেবস। ২০১৬ ও ২০২০ এ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রতিদ্বন্দ্বিতাকালে তাই বার্নি স্যান্ডার্সের কার্যালয়ের দেয়ালে ঝুলছিল এই সমাজতান্ত্রিক নেতার ছবি। ডেবস যুক্তরাষ্ট্রের সোশালিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে ১৯০০ সালে প্রথমবারের মত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এরপর থেকে ১৯২০ সাল পর্যন্ত মোট পাঁচবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দাঁড়ান। ১৯১২ সালের নির্বাচনটি ছিলো আশাব্যঞ্জক, যখন তিনি প্রায় ১০ লাখ ভোট পান যা মোট ভোটের ৬ শতাংশ। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠতেই দেশজুড়ে ‘লাল ভীতি’ ছড়িয়ে দেয়া হয় এবং শুরু হয় সমাজতন্ত্রীদের দমন-পীড়ন। সমাজতন্ত্রীদের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়, পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং সমর্থক গোষ্ঠীর লোকজনকে ধরপাকড় শুরু হয়। আটক হন তিনিও।

১৯১৪ সালে তাঁর ‘জেসাস, দা সুপ্রিম লিডার’ শীর্ষক একটি সহজ সুখপাঠ্য লেখায় ডেবস যীশু খ্রিস্টকে বলেছেন ‘শ্রেষ্ঠ সর্বহারা বিপ্লবী’। যীশু সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘তিনি একটি শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করছিলেন এবং প্রস্তুত করছিলেন শ্রমিক বিপ্লবের পথ।’ ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য নিপীড়িত অনুসারীদের প্রতি যীশুর নির্দেশ: ‘তোমরা একে অপরকে ভালবাসবে; আমি তোমাদেরকে যেভাবে ভালবেসেছি, তোমরাও তেমনি একে অপরকে ভালবেসো।’ ডেবস একই বাণী শুনতে পেয়েছেন কয়েক শতাব্দী পরে কার্ল মার্ক্সের ‘দুনিয়ার মজুদর এক হও’ এই আহ্বানে।

ইউজিন ডেবস প্রচলিত ধর্ম পালন করতেন না, কিন্তু মনেপ্রাণে ছিলেন একজন খাঁটি খ্রিস্টান, বলার অপেক্ষা রাখে না খাঁটি কম্যুনিস্টও। ১৯১৪ সালে ডিসেম্বরে তিনি মিশিগানের জেলখানায় এক বন্দীর একটি চিঠি স্থানীয় পত্রিকায় ছাপা হয়েছে দেখতে পান। বন্দীটি গুড ফেলো ক্লাব নামে একটি সামাজিক সেবা সংগঠনকে ২ ডলার দান করেছে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদেরকে খেলনা কিনে দেয়ার জন্য। ঘটনাটি ডেবসকে আলোড়িত করে। বড়দিন উপলক্ষে ১৬ তারিখে তিনি মিশিগানে জ্যাকসোনের জেলে ৯৭৫৬ নম্বরধারী বন্দীকে চিঠি লিখে বলেন, খ্রিস্টান সমাজের যারা তাকে বন্দী করে রেখেছে তারা নয়, তিনিই যীশুর চেতনার প্রকৃত ধারক ও প্রতিনিধি। ডেবস লেখেন, ‘ভাই আমি জানি না তুমি কে। ... যীশু শিশুদেরকে যেমন ভালবাসতেন, তুমিও তেমনি তাদেরকে ভালবাসো। তুমি এখন জেলে আর তিনি হয়েছিলেন ক্রুশবিদ্ধ।’ (Eugene Debs on the Real Religion of Jesus, জ্যাকোবিন, ২৫ ডিসেম্বর ২০২০)

এরকম চমৎকারভাবে অসাধারণ কাব্যিক দক্ষতায় ডেবস মহান যীশু ও একজন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত সাধারণ দরিদ্র মানুষের জীবনের সমীকরণ করেছেন। কথা বলার ও বক্তৃতা করার এই যে অসামান্য গুণ-কোনো তাত্ত্বিক কচকচি না করে বিন্দুর মাঝে সিন্ধু দেখিয়ে দেয়ার ও কঠিন বিষয়কে সহজ করে বুঝিয়ে দেয়ার ক্ষমতা-ইউজিন ডেবসকে গণমানুষের প্রিয় নেতায় পরিণত করেছিল। ধর্মকে তিনি দেখেছেন মানবিক জায়গা থেকে। ধর্মবিশ্বাসী মানুষের সঙ্গে কোনো অযাচিত বিরোধে জড়াননি। শুধু তাই নয়, ধর্ম-প্রবর্তকের জীবনের ও কর্মকাণ্ডের সবচেয়ে প্রগতিশীল ও মানবিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করেছেন। লড়াইটা চালিয়েছেন ব্যাখ্যায়, প্রত্যাখ্যান ও উস্কানি দিয়ে নয়।    
 
ইউজিন ডেবসও শ্রমজীবী মানুষের কতটা প্রিয় ছিলেন ও তাদের ধারণা কী ছিলো তাও উল্লেখযোগ্য। ইলিনয়েসে এক বক্তৃতাকালে একজন মহিলা আরেকজনকে বলছিলেন, ‘যখন ডেবস আসে, মনে হয় যিশু খ্রিস্ট।’ সমাজতান্ত্রিক ধারণাকে তিনি দ্রুত গণমানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন কেননা তিনি মানুষের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতেন। তার দেয়া সমাজতান্ত্রিক ছবি ছিলো যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে পূর্ণ। যিশু খ্রিস্টের জীবনকে তিনি বিপ্লবী রাজনীতি হিসেবে গভীরভাবে সম্মান করতেন। আটলান্টায় তার কারাগারের দেয়ালে ঝুলানো ছিলো ক্রুশেবিদ্ধ যিশুর ছবি। ডেবস বক্তৃতা করতেন হৃদয় দিয়ে ও হাত নেড়ে যাতে তার কথামালা জীবন্ত হয়ে উঠত।

১৯০১ সালের ৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতারা সকল মানুষ সমান ঘোষণার মধ্যে আসলে কেবল নিজেদেরকেই মানুষ হিসেবে বুঝিয়েছেন। তারা নিগ্রোদেরকে অন্তর্ভুক্ত করেননি, যাদেরকে এখানে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এনে চরম দাসত্বের মাঝে নিক্ষেপ করা হয়েছে। বংশপরম্পরায় দাসত্ব ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসেবে তাদের মালিকানা লাভ ততদিনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘তুমি, তোমার সন্তান ও তোমার সন্তানের সন্তানেরা-যদি পুঁজিবাদ তাদের জন্ম পর্যন্ত টিকে থাকে-দাসজীবন যাপনের দণ্ডে দণ্ডিত এবং কোনো আশা নেই যদি পুঁজিবাদকে ছুঁড়ে ফেলে সমাজতন্ত্র বেছে নেয়া না হয়।’ (Eugene Debs, Independence Day Address, জ্যাকোবিন, ৪ জুলাই ২০২০)

যুক্তরাষ্ট্র প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়া থেকেই সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে ডেবস তার জ্বালাময়ী বক্তৃতা চালাতে থাকেন। তার বাগ্মিতার আকর্ষণে সভা-সমাবেশ দর্শক-শ্রোতার ভিড়ে উপচে পড়তো। ১৯১৮ সালে ওহাইয়োর ক্যান্টোনে যুদ্ধবিরোধী বক্তৃতাটির জন্য আবার তাকে মামলায় জড়ানো হয় গুপ্তচর বৃত্তি ও শত্রুকে সহায়তার মিথ্যা অভিযোগে। পরের বছর এপ্রিলে শুরু হয় ১০ বছর কারাদণ্ড ভোগ। তবে তিন বছরের কম সময়েই ১৯২১ এর ডিসেম্বরে ছাড়া পান তিনি। কারাগারে তার স্বাস্থ্যের যে অবনতি ঘটেছিল তা আর ভালো হয়নি। ১৯২৬ এর ২০ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করেন শ্রমজীবী মানুষের এই মহান নেতা।

যুক্তরাষ্ট্রের সমাজতন্ত্রীদের কাছে তিনি সবসময়ই অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত, প্রেরণার উৎস। আর প্রায় শতবর্ষ পরে আজও ইউজিন ডেবস পৃথিবীর দেশে দেশে মুক্তি-আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাছে প্রয়োজনীয় পাঠ্য।  

লেখক: সম্পাদক, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //