করোনার টিকা, বাণিজ্য ও কিছু পরামর্শ

করোনা টিকা এখন বিশ্বব্যাপী বড় আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। করোনার অতিমারি মোকাবেলায় ২৫ জানুয়ারির মধ্যে ভারত থেকে সেরাম ইনস্টিটিউটের টিকা অ্যাসট্রোজেনিকার প্রথম চালান বাংলাদেশে পৌঁছানোর কথা। বিশেষ অ্যাপসের মাধ্যমে ২৬ জানুয়ারি থেকে টিকা গ্রহণকারীদের নিবন্ধন শুরু হওয়ার কথা। টিকা প্রদানে প্রশিক্ষণের কাজও শুরু হওয়ার কথা জানানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন অনুযায়ী টিকা গ্রহীতাদের অগ্রাধিকার নির্ধারণের কথা বলা হয়েছে। আর স্বাস্থ্য বিভাগ ফেব্রুয়ারির শুরু থেকে মানুষকে টিকা দেওয়ার কথা জানিয়েছে। 

ভারত থেকে টিকা আমদানির চুক্তি নিয়ে এখনো বড় বিভ্রান্তি রয়েছে। সরকারি এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস বলছে, এটি তাদের সঙ্গে একটি বাণিজ্যিক চুক্তি; আর সরকারি তরফে বলা হচ্ছে, এটি সরকারের সঙ্গে সরকারের চুক্তি। সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের এই টিকা কিনতে বাংলাদেশকে ভারতের চেয়ে ৪৭ শতাংশ বেশি দাম দিতে হবে। ভারত সরকার যেখানে ২০০ রুপি বা ২.৭২ ডলারে টিকা কিনবে বাংলাদেশকে সেখানে ৩৪০ টাকা বা ৪ ডলারে এই টিকা কিনতে হচ্ছে। কেন এতো বাড়তি টাকা বাংলাদেশকে দিতে হবে, মধ্যস্বত্বভোগী এজেন্ট হিসেবে বেক্সিমকোই বা টিকাপ্রতি কতো টাকা বাড়তি নিচ্ছে, সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ব্যাখ্যা নেই। কোন প্রক্রিয়ায় কোনো দরপত্র ছাড়া কীভাবে বেক্সিমকোকে এই দায়িত্ব দেওয়া হলো তারও নির্দিষ্ট তথ্য নেই। আর সেরামের কাছ থেকে তিন কোটি টিকা পেতে কত মাস লাগবে তা এখন পর্যন্ত নিশ্চিত নয়। 

এর মধ্যে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স আবার জানিয়েছে বেক্সিমকোর বাইরে সেরামের কাছ থেকে ৫০ লাখ টিকা কিনবে। এর একাংশ তারা সরকারের কাছে বিক্রি করবে; আর বড় অংশ নিজেরাই বাজারে ছাড়বে, যার দাম পড়বে ১,১২৫ টাকা। এসবের অর্থ হচ্ছে- তারা গাছেরটা খাবে, আবার নিচেরটাও কুড়াবে।

ক’মাস আগেই চীনা টিকা ‘সিনোভ্যাক’ বাংলাদেশে তাদের টিকার ট্রায়ালে বিশেষ উদ্যোগী ছিলো; দুটি ধাপ তারা অতিক্রমও করে এসেছিলো। সরকারও প্রথম দিকে আগ্রহ দেখিয়েছিলো। তারপর হঠাৎ করে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের ঢাকা সফরের পর গণেশ উল্টে গেলো, বাংলাদেশ সরকার সিনোভ্যাকের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেললো। সিনোভ্যাক অন্য দেশে তাদের ট্রায়াল ও বিনিয়োগে ঝুঁকে পড়লো। দেখা গেলো সরকার করোনার অতিমারি মোকাবেলায় দেশের গবেষক, বিশেষজ্ঞ ও ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার চেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনাকেই প্রাধান্য দিয়ে আসছে। এ মুহূর্তে ভারত অক্সফোর্ডের অ্যাসট্রোজেনিকার টিকার পাশাপাশি আরো চারটি টিকার ট্রায়াল দিয়ে চলেছে। তাহলে বাংলাদেশকে কেন সুযোগ থাকার পরও কেবল একটি টিকার ওপর নির্ভর করতে হবে, বাংলাদেশ কেন অন্যান্য বিকল্পের অনুসন্ধান করবে না; এসব প্রশ্নের কোন সদুত্তর নেই।

বাংলাদেশের গ্লোব বায়োটেক সম্প্রতি ‘মডার্নার’ প্রযুক্তি ব্যবহার করে ‘বঙ্গভ্যাক্স’ নামক টিকার ট্রায়াল মে-জুন মাস নাগাদ শুরুর কথা জানিয়েছে। তাদের টিকা কেবল একটি ডোজই নাকি নিতে হবে। এদের টিকার দাম নিয়ে অবশ্য বড় উদ্বেগ রয়েছে। সরকারকে দেশীয় এসব উদ্যোগকে কার্যকরী সহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের মতো এসব উদ্যোগও যাতে দেশীয় ও আঞ্চলিক রাজনীতির শিকারে পড়ে বিপর্যস্ত না হয় তা নিশ্চিত করা দরকার।

দুনিয়াব্যাপী করোনার টিকাও এখন রাজনীতি ও রাজনৈতিক অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদানে পরিণত হয়েছে। প্রায় শত বিলিয়ন ডলারের এই টিকা ব্যবসায় ইতিমধ্যে বিভিন্ন দেশ ও কোম্পানির মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতাও শুরু হয়েছে। দেশ ও জনস্বাস্থ্যের বিষয়কে সর্বাগ্রে রেখেই বাংলাদেশকে এই সংক্রান্ত যাবতীয় নীতি-কৌশল ও পদক্ষেপ নিতে হবে। করোনাভাইরাস মোকাবেলায় টিকাকে জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ‘জনপণ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। এই টিকা বা জনপণ্য যেন কোনো ওষুধ কোম্পানি, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান, বিশেষ কোনো কায়েমী গোষ্ঠী বা ব্যক্তির মুনাফা অর্জনের বিষয়ে পরিণত না হয়, তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বিশেষ কোনো ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট যেন জনগণকে জিম্মি করতে না পারে, তা আমলে নেওয়া জরুরি।

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়সহ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানসমূহ, তাদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, আমলাতান্ত্রিকতা, দীর্ঘসূত্রতা, কেনাকাটার দুর্নীতি-জালিয়াতিসহ নানা বিষয়ে এখনো জনঅসন্তোষ ও জনবিক্ষোভ রয়েছে; ঘাটতি রয়েছে দায়িত্বশীলতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার ক্ষেত্রে। এই দুরবস্থা থেকে অচিরেই আমাদের বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে করোনার টিকা, করোনা দুর্যোগ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিম্নোক্ত জরুরি পরামর্শগুলো বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত, করোনার টিকাকে জনস্বাস্থ্য সুরক্ষায় ‘জনপণ্য’ হিসেবে বিবেচনা করে সরকারি ব্যবস্থাপনায় দেশের প্রত্যেক নাগরিকের টিকা প্রাপ্তি নিশ্চিত করা। এ জন্য দেশের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সংক্রান্ত সমগ্র অবকাঠামো এবং চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্য সহায়কসহ সংশ্লিষ্ট সমগ্র জনশক্তিকে উপযুক্ত নির্দেশনা, প্রশিক্ষণসহ দক্ষতা ও যোগ্যতার সঙ্গে কাজে লাগানো প্রয়োজন। টিকা গ্রহীতাদের রেজিস্ট্রেশনও সরকারি উদ্যোগে সম্পন্ন করা দরকার। 

দ্বিতীয়ত, করোনা টিকার আমদানি, ব্যবস্থাপনা, প্রয়োগসহ গোটা পদক্ষেপ রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় সম্পন্ন করা। করোনা টিকা নিয়ে মুনাফাকেন্দ্রিক যে কোনো প্রকার ব্যবসা ও মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।

তৃতীয়ত, করোনা টিকা আমদানিতে জরুরিভিত্তিতে বিকল্প উৎসসমূহ বের করতে হবে; প্রয়োজনে স্বল্পতম সময়ে বাংলাদেশে তার ট্রায়ালের ব্যবস্থা করা।

চতুর্থত, দেশীয় সংস্থা করোনার টিকা উৎপাদন করে যৌক্তিক মূল্যে তা সরকারের কাছে বিক্রি করবে। জন চাহিদা বিবেচনা করে সরকার তা ক্রয় করবে। দেশীয় সংস্থাকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করাও দরকার।

পঞ্চমত, টিকা প্রদানের অগ্রাধিকারে যে কোনো রাজনৈতিক, দলীয় ও প্রেসার গ্রুপগত বিবেচনা পরিহার করা।

ষষ্ঠত, টিকা ও করোনার পরীক্ষা এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো ধরনের দুর্নীতি, চুরি, দায়িত্বহীনতা ও অব্যবস্থাপনাকে দ্রুত শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও বিশেষ বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন এসব টিকা গ্রহীতাদের।

সপ্তমত, টিকাকে করোনাভাইরাসের একমাত্র সমাধান হিসেবে বিবেচনা না করে মাস্ক, স্যানিটাইজার, পরিচ্ছন্নতা, জনসচেতনতা, শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ করোনার পরীক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে কার্যকর করে তোলা। 

অষ্টমত, সর্বোপরি করোনার টিকা ও চিকিৎসা সংক্রান্ত যে কোনো সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ গ্রহণে রাজনৈতিক বিবেচনা পরিহার করে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।

-সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //