পাটকল-চিনিকল বন্ধের নেপথ্য কাহিনি

করোনার আঘাতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্বের অর্থনীতি। জীবন বাঁচানো নাকি জীবিকা রক্ষা কোনটি প্রধান এই বিতর্কে শ্রমজীবী মানুষ ভাবছে, জীবিকা রক্ষা না পেলে তো জীবন বাঁচবে না। সেই দুঃসময়ে একের পর এক মৃত্যুঘণ্টা বাজছে বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্পগুলোর। স্বাধীনতার পর ৭২ সালে রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশে যে পাট, চিনি শিল্প রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর প্রাক্কালে সেগুলো বন্ধ করা হচ্ছে। কারখানাগুলো আলাদা আলাদা হলেও কারণ কিন্তু আলাদা নয়। সেই পুরনো কথা- লোকসান।

বলা হচ্ছে, এই বিপুল লোকসানের ভার দেশ আর বহন করতে পারছে না; কিন্তু সমাধান কি? সেও একই কথা, বন্ধ কর এবং বিক্রি কর। প্রশ্ন জাগে, লোকসানের কারণগুলো চিহ্নিত করা এবং তা দূর করার কার্যকর উদ্যোগ না নিয়ে বন্ধ করার কথা বলা হচ্ছে কেন? এ কি পরিকল্পিত লোকসান, যা কারখানা বিক্রির পটভূমি রচনা করেছে? 

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা শুধু একটি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শব্দ নয়। একটি দেশকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিচার করার মাপকাঠিও বটে। কোনো দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর নির্ভর করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। অর্থনীতিতে কম্পন বা ঝাঁকুনি লাগলে রাজনীতিও টালমাটাল হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক অবস্থা খারাপ একথা বলে ক্ষমতাসীনরা রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরও কড়াকড়িভাবে আরোপ করে, সে দৃষ্টান্ত দেশে এবং বিদেশে আমরা অহরহ দেখছি। অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা অর্জন ও রক্ষা করতে হলে দেশের অর্থনীতিতে কিছু স্থায়ী ভিত্তি লাগে। শুধু বিদেশের বাজারের দিকে তাকিয়ে পণ্য উৎপাদন বা মূল্য সংযোজন কিংবা আমদানিকরা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা, যে ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ তা সবাই জানেন। যেসব দেশের এ ধরনের নির্ভরশীলতা আছে, তারা করোনাকালে এই সত্য হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে সবচেয়ে খারাপ দৃষ্টান্তের অন্যতম। ইউরোপ, আমেরিকার জনগণ কাপড় কেনা কমিয়ে দিলে বাংলাদেশের রফতানি আয়ের ৮২ শতাংশের দাবিদার তৈরি পোশাক শিল্প যে মুখ থুবড়ে পড়ে, কিংবা ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করলে পেঁয়াজের দাম যে আকাশচুম্বী হয় অথবা চালের বাজারে কী ধরনের চালবাজি হয় তা বাংলাদেশের চাইতে ভালো কোন দেশ আর কী বুঝতে পারে? আর ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেট যে কত শক্তিশালী তা বুঝতে অসুবিধা অন্তত বাংলাদেশের ভোক্তাদের হওয়ার কথা নয়। আমন মৌসুমেও ২০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হচ্ছে। 

পৃথিবীর যে দেশগুলোকে পুঁজিবাদী অর্থেও উন্নত বা শক্তিশালী দেশ বলা হয় তারাও তাদের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে এক ধরনের সুরক্ষা ব্যবস্থা রাখে। জাপানের মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। সেখানে এক কেজি চালের দাম বাংলাদেশের টাকায় ৩৮০ টাকার বেশি; কিন্তু জাপান কখনো চিন্তাও করে না যে বাংলাদেশ থেকে কাটারিভোগ চাল আমদানি করবে। ইউরোপে দুধ উৎপাদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই গরু পালনের জন্য ভর্তুকি দেয় তারা। প্রতিটি গরুর জন্য প্রতিদিন হিসেবে ২.৫ ডলার ভর্তুকি দেওয়া হয়, বাংলাদেশি টাকায় গরু প্রতি বছরে ৭০ হাজার টাকা হয়। মাথাপিছু ২ ডলারের উপর দৈনিক আয় হলে নাকি দারিদ্র্যসীমার উপরে ওঠা যায়। সেই হিসেবে ইউরোপের গরু যে ভর্তুকি পায় তা দিয়ে এশিয়া আফ্রিকার মানুষ দারিদ্র্যসীমার উপরে উঠে যেতে পারতো। আমেরিকার গম, ব্রাজিলের চিনি- কোথায় ভর্তুকি নেই। বিশ্বের মোট উৎপাদনের অর্ধেকের মতো চিনি উৎপাদনকারী দেশ ব্রাজিল ২.৫ বিলিয়ন ডলার বা বাংলাদেশের টাকায় ২০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়। ভারত এ বছর ৬০ লাখ টন চিনি রফতানি করবে বলে পরিকল্পনা করছে। ভারত সরকার চিনি শিল্পে ৩৫ বিলিয়ন রুপি ভর্তুকি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যদিও ভারতের চিনি শিল্পের সঙ্গে যুক্তদের দাবি ছিল আরও বেশি। এই ভর্তুকি দেশের শিল্প রক্ষা, কৃষক রক্ষা, কর্মসংস্থান ও পরিবেশ রক্ষার পাশাপাশি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন বলে তারা মনে করেন। আর বাংলাদেশের ১৫টি চিনিকল ৯৭০ কোটি টাকা লোকসান করেছে। দুর্নীতির ছিদ্র পথ বন্ধ হলে এবং সময়মতো আধুনিকায়ন হলে চিনিকলগুলোতে এই লোকসান হতো না, এ কথা জোরের সঙ্গেই বলা যায়। 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল- বৈষম্যমুক্ত স্বনির্ভর অর্থনীতি। অনেকে দুঃখের সঙ্গে ব্যঙ্গ করে বলেন, স্বনির্ভর হবো কি ভাই, দেশটার ওপর যেন শনির ভর হয়েছে। স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ পেয়েছিল পাটকল, চিনিকল, চা এবং চামড়া শিল্প। স্বাধীনতার ৫০ বছরের মধ্যেই এর সবগুলো ব্যক্তিখাতে তুলে দেওয়ার কাজ শেষ করা হচ্ছে। গত জুনে ২৫টি রাষ্ট্রীয় পাটকল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে ১৫টি চিনিকলের (যার ৩টি ব্রিটিশ আমলে, ৯টি পাকিস্তান আমলে এবং ৩টি বাংলাদেশ আমলে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল) মধ্যে প্রথম দফায় কুষ্টিয়া, পাবনা, রংপুর, শ্যামপুর, সেতাবগঞ্জ ও পঞ্চগড় এই ৬টি চিনিকলের মৃত্যু পরোয়ানায় স্বাক্ষর করা হয়েছে। এর ফলে বেকার হয়ে পড়বে স্থায়ী, অস্থায়ী, মৌসুমি মিলে ২৫ হাজার শ্রমিক। ক্ষতিগ্রস্ত হবে ৫ লাখ আখচাষি এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত ৫০ লাখ মানুষ। 

চিনিকল বন্ধের যুক্তি হিসেবে সরকারের পক্ষ থেকে হাজির করা হচ্ছে সেই পুরনো অজুহাত- লোকসান; কিন্তু লোকসানের কারণ সমুহ দূর করার কথা একবারও বলা হচ্ছে না। লোকসানের কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অপচয়, অদক্ষতা। এর কোনোটির সঙ্গেই আখচাষি, চিনিকল শ্রমিক ও দেশবাসী যুক্ত নন। একদিকে লুটপাট করে কারখানাকে লোকসানি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হচ্ছে আবার লোকসানের অজুহাতে চিনিকলের ১৯ হাজার একর জমি ও ২৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি অতীতের বিরাষ্ট্রীয়করণকৃত কারখানাগুলোর মতো কিছু বিশেষ ব্যক্তির হাতে তুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে। ফলে পরিণতি হবে আগের কারখানাগুলোর মতই। অর্থাৎ শ্রমিক হারাবে কাজ, জনগণ হারাবে সম্পদ আর প্রায় বিনামূল্যে রাষ্ট্রীয় সম্পদের মালিক হবে এক শ্রেণির লুটপাটকারী।

দেশের চিনির চাহিদা বিবেচনা করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে আধুনিকায়ন করলে চিনিকল লাভজনক করা সম্ভব। কারণ দেশে চিনির চাহিদা প্রায় ২০ লাখ টন এবং তা প্রতি বছর বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো উৎপাদন সক্ষমতা ২ লাখ ১০ হাজার টন, ফলে প্রয়োজন চিনির উৎপাদন বাড়ানো; কিন্তু উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় মাত্র ৮২ হাজার টন। সেই চিনিও আবার অবিক্রিত থাকে। ৫টি বেসরকারি চিনি পরিশোধন কারখানা বিপুল পরিমাণ অপরিশোধিত চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করে তা পরিশোধন করে বাজার সয়লাব করে ফেলছে। চিনি বর্জ্য নদীতে ফেলে এরা ধ্বংস করছে পরিবেশ এবং দেশকে বিদেশি চিনির ওপর নির্ভরশীল করে ফেলছে। দেশের স্বার্থের কথা ভাবলে চিনিকলগুলো আধুনিকায়ন করা, চিনির উপজাত চিটাগুড়, ছোবড়া ও প্রেসমাডকে কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করে অনেক সহায়ক শিল্প গড়ে তোলা যেত। কাগজ, এলকোহল, জৈব সার, সানিটাইজার উৎপাদন এবং আখের ছোবড়া ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যেত; কিন্তু জনগণের কথা কে ভাববে? 

কোন দেশের অর্থনীতির অন্যতম ভিত্তি সে দেশের স্থায়ী শিল্প। বাংলাদেশে কৃষিভিত্তিক শিল্প হিসেবে গড়ে উঠেছিল পাট এবং চিনি শিল্প; কিন্তু একের পর এক সেই শিল্পসমূহ ব্যক্তিখাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। দেশের শ্রমিক, কৃষক ও সাধারণ মানুষকে পুঁজিপতিদের কাছে জিম্মি করে ফেলা হচ্ছে। এদের কাছে দেশ পরিবেশ, শ্রমিক, কৃষক বড় কথা নয়, মুনাফাই মুখ্য। অর্থাৎ দেশবাসীর ট্যাক্সের টাকায় পরিচালিত কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্প বন্ধ করে এই খাতকে পুঁজিপতিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। এভাবে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থ রক্ষা করা যাবে না। তাই রাষ্ট্রীয় চিনিকল বন্ধ নয়, চালু ও আধুনিকায়ন করা, লোকসানের জন্য দায়ী ভুলনীতি পরিহার করা এবং দুর্নীতিবাজ আমলাদের শাস্তি দেওয়ার কাজটা ছিল জরুরি। তা না করে কারখানা বন্ধ এবং বিক্রি করার আয়োজন চলছে। এর ফল যে ভালো হচ্ছে না, তা বুঝতে আর কতদিন লাগবে?

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //