ভেটো সদস্য: না বুঝ ভারতের অবুঝ কামনা

আপনি গরিব মুটে-মজুর; মানুষের জিনিস বয়ে আপনার দিন যায়। আপনি নিজের এই স্টাটাস সম্পর্কে জানেন ও সচেতন; কিন্তু না। 

হঠাৎ করে নতুন শতকে এসে আজব ঘটনার মুখে আপনি পড়লেন। কারণ এক বড় ভাই আপনার পিঠে হাত রেখেছেন; কিন্তু তাতে আপনার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। এখন আর কোনোকিছুতেই আপনি আপনাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। আপনার সমস্ত অর্গল, নিজেকে নিয়ন্ত্রিত রাখার আগের সব মেকানিজম ফেল করে যাচ্ছে। নাকি আপনি নিজেই নিজেকে অচেতন করে রেখে যেন বিরাট কিছু হয়ে গেছেন কল্পনা করে ভীষণ সুখবোধ করছেন। আপনার নিয়ন্ত্রণ আর আপনার হাতে নেই। বরং কল্পনার সুখবোধে আপনি দিশাহারা! এই হলো আজকের ভারতের দশা। 

তবে একটা ব্যতিক্রম হলো এখন যারা ক্ষমতাসীন তারা মারাত্মক অর্থনৈতিক দূরবস্থায় পতিত হয়েছে। কল্পনার সুখবোধ আর তেমন কাজ করছে না। কঠিন বাস্তবতা কঠোরভাবে বারবার সামনে এসে ভিড় করছে। সরকারের পক্ষে একটাই সুবিধা যে ‘করোনার কারণে’ এই খারাপ অবস্থা হয়েছে বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ আছে। যদিও ন্যূনতম বিচারবোধ ও তথ্য যাদের কাছে আছে, তারা জানেন করোনা শুরুর অন্তত বছর খানেক আগে থেকেই ভারতের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে ঢলে পড়েছে। এতদিনের সুখবোধ গল্পের তাহলে এখন কী হবে? সেটা নিয়ে তামাশা হলো- সরকার আর কল্পনার সুখবোধের গল্প আউড়ানো বন্ধ করলেও, মিডিয়া কিন্তু তা চালিয়ে যাচ্ছে। কারণ গল্পটাও না বলতে পারলে তারাই বা খাবে কী?

এটা অবশ্যই সত্যি কোনো বড় ভাই তার পিঠে হাত রাখুক আর না রাখুক, ভারতের কিছু হবার সম্ভাবনার একটা বড় দিক হলো তার বিপুল জনসংখ্যা। মানে তার বিপুল খাতক অভ্যন্তরীণ বাজার; কিন্তু ঠিক খাতক না, ‘হবু খাতক’। এমন হওয়ার এক বিশাল সম্ভাবনা; কিন্তু যা হয়নি এখনো। তাই যদি হয় তবে এটি বিশাল এসেট হতে পারে, আর না হওয়া পর্যন্ত এটি ততই বিশাল এক দায়- লায়াবিলিটি। 

কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিকর বিষয়টি হলো ভারত এ নিয়ে অবসেশনে পড়েছে। মানে এক মিথ্যা আবেশে আচ্ছন্নতার তলে হারিয়ে যাচ্ছে। তেমনই এক বড় আচ্ছন্নতা হলো- ভারতের জাতিসংঘের ভেটোক্ষমতাধর সদস্য-দেশ হওয়া, এ’এক বিচারবোধ-শূন্য খায়েশ, এক অবসেশন!

গত ১ জানুয়ারি থেকে ভারত নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী-সদস্য-দেশ হয়েছে। মোট ১৫ সদস্যের জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ, যেটি জাতিসংঘের সব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল এক কমিটি ও সবচেয়ে ক্ষমতাধর বডি। এর মধ্যে আছে পাঁচ ভেটো ক্ষমতাসম্পন্ন সদস্যদেশ আর সাথে আরো ১০ ভেটো প্রদানের ক্ষমতা নেই- এমন অস্থায়ী কিন্তু নির্বাচিত সদস্য দেশ। তবে ভেটো ক্ষমতাওয়ালারাই হলো একমাত্র স্থায়ী সদস্য। আর অস্থায়ী সদস্য দেশের আয়ু মাত্র দুবছরের জন্য। আর অস্থায়ী সদস্য দেশ এরা নির্বাচিত হয় গ্লোবাল ভুগোলে অঞ্চলভিত্তিক সদস্য প্রার্থীদের থেকে। তবে নির্বাচিত করা হয় সাধারণ পরিষদের সব সদস্য দেশের ভোটে। ভারত এবার ২০২১-২২ টার্মে ‘এশিয়া ও প্যাসিফিক’ অঞ্চলের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে। এ নিয়ে ভারতের এটি অষ্টমবার নির্বাচিত হওয়া। 

একটি ছোট তুলনা করে বলা যায়, স্বল্পদিন হলো সদস্য হওয়া বাংলাদেশ ইতিমধ্যে দু’বার নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য হয়েছে। মানে অস্থায়ী সদস্যদেশ হওয়া বড় কোনো ব্যাপার না। অর্থাৎ সদস্যদেশ হতে গেলেও জনসংখ্যায় বা অর্থনীতিতে বড় হতে হবে এমন কোনো ব্যাপার নেই। 

তবে আরেকটি কথা, ১০ অস্থায়ী সদস্যপদ যা ভৌগোলিক অঞ্চল থেকে প্রতিনিধি-দেশ হিসেবে প্রার্থী হওয়া যায়, সেই ভাগটি হলো- পাঁচ সদস্য দেশ এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চলের জাতিসংঘ সদস্য-রাষ্ট্রগুলো, একটি পূর্ব-ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে, দুটি ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রগুলো থেকে ও দুটি নেয়া হয় পশ্চিম-ইউরোপীয় দেশ আর বাকি অন্য দেশগুলো থেকে। 

কিন্তু সার কথাটি হলো, নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্যপদ পাওয়া খুবই রুটিন একটি ঘটনা, যার বিশেষ কোনো তাৎপর্য নেই। কারণ পরিষদে ভোটের গুরুত্ব মূলত ভেটো ক্ষমতাওয়ালাদের; অর্থাৎ অস্থায়ী সদস্য-দেশের ওপর তা একেবারেই নির্ভর করে না। নির্ভর করে পাঁচ স্থায়ী ও ভেটো ক্ষমতাধর যেকোনো একটি সদস্য দেশের ওপর। কারণ ভেটোকথার মানে হলো একাই এমন দেশের কোনো প্রস্তাবে না বলে দিলে ওই প্রস্তাব বাতিল গণ্য করতেই হবে, বাকি ১৪ রাষ্ট্র প্রস্তাবের পক্ষে থাকলেও কিছু হবে না। 

এ দিকটির গুরুত্ব না বোঝা থাকলে জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠান ও এর ভেটো ক্ষমতাকেই বোঝা যাবে না। এক কথায় বুঝতে হবে জাতিসংঘের জন্ম ও এর তাৎপর্য তাই নেহেরুর আমল থেকেই আমরা দেখেছি; কিন্তু ভারতের না-বোঝা রয়ে গেছে। 

আর একালে প্রণব মুখার্জিদের আমলেও একই অবস্থা। বুশ থেকে ওবামার আমল পর্যন্ত আমেরিকা বুঝে যায়, ভেটোসদস্য পদ ভারতের কেমন কাম্য আর কীভাবে পাওয়া যায়, তা নিয়ে ততধিক ভারতের অজ্ঞতা আছে। আর এটিকেই আমেরিকা নিজের কাজে লাগিয়েছে। বিশেষ করে ওবামা আমলে মিথ্যা ধারণা দেয়া হয়েছে যে, আমেরিকা এখনো যেন ভেটো সদস্যপদ দাতা, অথচ এটা আর একবিন্দু সত্য নয়। যদিও একথা সত্য যে, জাতিসংঘের আইডিয়ার জন্মদাতা আমেরিকা, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাল থেকেই। তাই সে সময় এর পূর্বনাম ছিল- ‘লীগ অব নেশন’। আর সেটির কার্যকারিতা ভেঙে যায় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের আমলে। ১৯৪৪ সাল থেকে নতুন করে আরো গুছানো নাম হলো- ‘জাতিসংঘ’; কিন্তু রুজভেল্ট হলেন আইডিয়ার প্রস্তাবক মাত্র। মূলত স্টালিন নিজ দেশের স্বার্থ বুঝে এতে সমর্থন দিতে রাজি হলেন। আর এটি বুঝতে পেরে রুজভেল্ট এবার প্রথম প্রস্তাব সংশোধন করে ভেটো সদস্যপদের জাতিসংঘ করার প্রস্তাব করেন ও তা গৃহীত হয়। এর মানে এটি মূলত ওই পাঁচ ভেটো সদস্যদের ক্লাব হয়ে যায়। যেখানে একের আপত্তি থাকলেও কোনো সিদ্ধান্ত হবে না। এরই নিশ্চয়তা চেয়েছিলেন স্তালিন। অন্যদিক থেকে এটি মূলত গ্লোবাল নেতাদের প্রভাবাধীন প্রতিষ্ঠান।

যার অর্থ ঢলেপড়া আমেরিকান গ্লোবাল ক্ষমতার দিনগুলোতে আমেরিকার আর কাউকে ভেটোক্ষমতা প্রদান বা কেড়ে নেয়ার সক্ষমতা নেই। তাহলে আমেরিকা কী ভারতে কিছু পাইয়ে দেবার ক্ষমতা আসলে রাখে? এটিও ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কেউ ধরতেই পারেনি। এ ছাড়া এ কালে আমেরিকা যদি ভারতকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেয়ার ক্ষমতা রাখে আর তাতে তা অবশ্যই চীনা স্বার্থবিরোধীই হবে। তাহলে চীন ভেটো ক্ষমতাধারী হয়ে সেটা চুপ করে বসে দেখবে ও সমর্থন করবে কেন? এই সহজ কথাটি বুঝবার ক্ষমতা ভারতের নেই। অথচ ভারত অযথাই অনুযোগ করে- কেন জাতিসংঘের ভেটোক্ষমতার সংস্কার করা হলো না, কেন ভারতের নাম প্রস্তাব করা হলো না। 

ভারতের তাই প্রথম কাজ হবে, জাতিসংঘ প্রতিষ্ঠানের ধরন বোঝা, এর জন্ম ইতিহাস জানা। আর অযথাই কারও লেজুর ধরে এগোনোর চিন্তা থেকে বের হয়ে আসা। মূলত দুনিয়ায় গ্লোবাল নেতা বদলে নিজেই ওর নেতা হওয়া অথবা নতুন নেতার কাছের ঘনিষ্ট স্বার্থের দেশ হওয়া ছাড়া ভারতের ভাগ্যে কিছুই জোটার কোনো সম্ভাবনা নেই।

- লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //